অভিমত

আদর করে শিশুর হাতে কী তুলে দিচ্ছেন?

ইউটিউবে শিশুদের প্রিয় একটি অ্যানিমেশন ভিডিও সিরিজ আছে। এর মূল চরিত্রের নাম ইয়ামিন। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ইয়ামিন তার বাবাকে ফোন করে বাসায় ফেরার সময় পিজ্জা আনতে বলে। তার বাবা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ফোনে কথা বলতে থাকেন। এমন সময় একটি গাড়ি এসে তাকে ধাক্কা দেয়। মারাত্মক আহত হন তিনি।

ইউটিউবে শিশুদের প্রিয় একটি অ্যানিমেশন ভিডিও সিরিজ আছে। এর মূল চরিত্রের নাম ইয়ামিন। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ইয়ামিন তার বাবাকে ফোন করে বাসায় ফেরার সময় পিজ্জা আনতে বলে। তার বাবা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ফোনে কথা বলতে থাকেন। এমন সময় একটি গাড়ি এসে তাকে ধাক্কা দেয়। মারাত্মক আহত হন তিনি।

ভিডিওতে দেখা যায়, ইয়ামিনের বাবা শিশুপুত্রের আবদার শুনতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ অভিভাবক তাদের শিশুদের এসব জাঙ্ক ফুডের চাহিদা পূরণ করে তাদের আজীবন দুর্ঘটনার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। অনেকে অসচেতনতার কারণে এমনটা করছেন। আবার অনেকে নিতান্ত অপারগ হয়ে সন্তানদের দাবি মেটাতে তাদের এসব খাবার কিনে দিচ্ছেন। ফলে শিশুরা জীবনের একেবারে শুরু থেকেই নানাবিধ শারীরিক জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাদের বেড়ে ওঠা যথাযথভাবে হচ্ছে না। এর নেতিবাচক প্রভাব পর্যায়ক্রমে তাদের সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তাদের সর্বনাশের পথ ত্বরান্বিত হচ্ছে।

সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য শিশুর সুষম পুষ্টির প্রয়োজন। কিন্তু চকোলেট, চিপস, কোমলপানীয়, বার্গার, পিজ্জাসহ যাবতীয় জাঙ্ক ফুডে কোনো ভিটামিন, মিনারেলস, ফাইবার বা অন্য কোনো পুষ্টি উপাদান নেই। ফলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক গঠনে এসব খাবার কোনো ভূমিকাই রাখতে পারে না। জাঙ্ক ফুডে বিভিন্ন মাত্রায় প্রিজারভেটিভও দেয়া হয়, যা শিশুস্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে পারে। অধিক মাত্রায় এ খাবারগুলো খাওয়ার কারণে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট হচ্ছে। ফলে পরবর্তী সময়ে তাদের শরীরে নানাবিধ জটিল রোগ দেখা দিচ্ছে। 

জাঙ্ক ফুড শিশুদের কাছে আকর্ষণীয়। এসব খাবারে অনেক বেশি পরিমাণে লবণ, চিনি ও চর্বির উপাদান থাকে। এগুলো শরীরে ডোপামিনের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। তাই শিশুরা এসব খাবার খেতে মুখিয়ে থাকে। নিজেদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার নির্বাচনের মতো বুঝ শিশুদের থাকে না। তাই এক্ষেত্রে অভিভাবকদেরই সর্বোচ্চ সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে। 

জাঙ্ক ফুড খাওয়ার কারণে শিশুদের দেহ ও মনের সুষম বিকাশ হয় না। আমাদের চারপাশে স্থূলকায় শিশুর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) অনুসারে, তাদের উচ্চতা ও বয়সের তুলনায় তাদের ওজনের কোনো সামঞ্জস্যই নেই। এখানে বলে রাখা ভালো, বডি শেমিং করা কোনোভাবেই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। এখানে যে স্থূলতার কথা বলা হচ্ছে, চিকিৎসাবিজ্ঞান তাকে অসুস্থতা বলে চিহ্নিত করেছে। তাই শিশুদের ক্ষেত্রে এ অসুস্থতার কারণ চিহ্নিত করে অভিভাবকদের সচেতন করার উদ্দেশ্যেই এ আলোচনা। বয়সের তুলনায় স্থূলকায় এসব শিশু অল্প পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে যাচ্ছে। শারীরিক ব্যায়ামেও তারা আগ্রহ পায় না। তাই দিনে দিনে তাদের শরীর বিভিন্ন রোগের বাসা হয়ে উঠছে। অভিভাবকদের জন্য কখনই তাদের সন্তানের এমন পরিণতি কাম্য হতে পারে না। চকোলেট ও কোমলপানীয় খাওয়ার কারণে শিশুদের দাঁত, চোখ ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চারপাশে চোখ বোলালে দেখা যায়, অনেক শিশুরই দাঁতে পোকাসহ নানা ধরনের সমস্যা। অভিভাবকরা তাদের নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ডেন্টিস্টের কাছে দৌড়াচ্ছেন। অনেক শিশুর আবার চোখে চশমা। অর্থাৎ, স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা বলতে যা বোঝায়, তা যেন দিনে দিনে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। 

চলতি বছরের ২৩ আগস্ট ভারতীয় গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদনে পুষ্টিবিদ অনুপমা মেনন হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেন, ‘বর্তমানে শিশুদের স্থূলতা এবং আনুষঙ্গিক স্বাস্থ্য জটিলতা মারাত্মক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাঙ্ক ফুড খাওয়া এর অন্যতম কারণ। অতিমাত্রায় প্রক্রিয়াজাত, অতিরিক্ত ক্যালরিসমৃদ্ধ ও অপুষ্টিকর এসব খাবার শিশুদের খাদ্যতালিকায় অনুপ্রবেশ করেছে। ফলে শিশুদের স্বাস্থ্য ও সামগ্রিক উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে।’ হিন্দুস্তান টাইমসের এ প্রতিবেদনে আশঙ্কাজনক অনেক বিষয় উঠে এসেছে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাঙ্ক ফুড খাওয়ার ফলে শিশুরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তারা ফ্যাটি লিভার ডিজিজে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটছে।

হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনটিতে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ১০টি খাবারের তালিকা দেয়া হয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, অধিকাংশ অভিভাবকই তাদের সন্তানদের এগুলো খাওয়াচ্ছেন। তালিকার প্রথমেই আছে বিভিন্ন ধরনের সিরিয়াল, যেগুলোর মাধ্যমে সাধারণত অভিভাবকরা সন্তানদের ব্রেকফাস্টের পাট চুকান। এগুলো চিনি দিয়ে ভর্তি থাকে। কোনো পুষ্টি উপাদান নেই বললেই চলে। তারপরে আসে ইনস্ট্যান্ট নুডলসের নাম। এগুলোতে অতিরিক্ত মাত্রায় সোডিয়াম থাকে। অনেক নুডলসে বিভিন্ন ধরনের ফ্লেভার যুক্ত করা হয়, যেগুলোতে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান থাকে। তালিকার তিন নম্বরে থাকা খাবারটির নাম পটেটো চিপস। এমন কোনো শিশু খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা পটেটো চিপস খায় না বা খেতে পছন্দ করে না। অথচ এ পটেটো চিপসে থাকে অ্যাক্রিল্যামাইডের মতো বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান, যা শিশুদের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অতিরিক্ত পটেটো চিপস খাওয়ার কারণে শিশুদের হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপও হতে পারে। তালিকার চার নম্বরে আছে চিকেন নাগেটস বা চিকেন ফিঙ্গারস। এতে টারশিয়ারি বিউটাইল হাইড্রোকুইনোন (টিবিএইচকিউ) নামে এক ধরনের উপাদান থাকে, যা খাওয়ার ফলে শিশুরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারে। পাঁচ নম্বরে আছে কোমলপানীয়ের নাম। এসব কোমলপানীয়ে অতিরিক্ত পরিমাণে চিনি থাকে। ফলে শিশুরা স্থূলকায় হয়ে যায়। তাদের টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। কোমলপানীয় শিশুদের দাঁতের জন্যও ক্ষতিকর। তালিকার ছয় নম্বরে আছে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের মতো বিভিন্ন ধরনের ভাজা খাবার। এসব খাবারে ট্রান্স ফ্যাট, সোডিয়াম ও ক্যালরির পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। ট্রান্স ফ্যাট শরীরে লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিনের (এলডিএল) পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে শিশুদের হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তালিকার সাত নম্বরে আছে ক্যান্ডি, চকোলেট ও অন্যান্য মিষ্টান্ন। এগুলো খাওয়ার কারণে শিশুদের ওজন বাড়ছে। তাদের দাঁত নষ্ট হচ্ছে। তালিকার আট নম্বরে আছে সসেজ, হটডগ, ফ্রোজেন নাগেটস ইত্যাদি প্রক্রিয়াজাত মাংস। এগুলোতে অত্যধিক পরিমাণে সোডিয়াম থাকে। ফলে শিশুদের ক্যান্সার ও হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। তালিকার নয় নম্বরে আছে কুকিজ, ক্র্যাকারস ইত্যাদি প্যাকেটজাত খাবার। আর দশ নম্বরে আছে বার্গার ও পিজ্জা। খেয়াল করে দেখুন, শিশুরা কিন্তু প্রতিনিয়ত এসব খাবারের মধ্যেই আছে।

মনে রাখতে হবে, শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই তাদের সুষ্ঠু উপায়ে বড় করে তোলার মাধ্যমেই কেবল আমরা সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারি। তাই শিশুদের খাদ্যরুচি তৈরিতে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। সেজন্য আমাদের বেশকিছু অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। শিশুদের এসব জাঙ্ক ফুড খাওয়ার অভ্যাস কোনোভাবেই করানো যাবে না। পরিবর্তে তাদের ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যকর খাবারে অভ্যস্ত করাতে হবে। কোমলপানীয়, চকোলেট ইত্যাদির পরিবর্তে তাজা ফল খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। সময় নিয়ে যত্ন করে শিশুদের এসব জাঙ্ক ফুডের ক্ষতিকর দিক বুঝিয়ে বলতে হবে। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তাই শিশুদের সামনে এসব খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কেবল নিজের সন্তানের ক্ষেত্রেই নয়, সচেতন হতে হবে অন্যের সন্তানের ক্ষেত্রেও। তাই আপনি যখন কারো বাসায় অতিথি হয়ে যাচ্ছেন, খেয়াল করুন সে বাসার শিশুদের জন্য আপনি কী নিয়ে যাচ্ছেন। কোনো জাঙ্ক ফুড না নিয়ে বরং স্বাস্থ্যকর কোনো খাবার বা ফলমূল আপনি নিয়ে যান। আদর করে কোনো শিশুকে যখন আপনি কিছু কিনে দিচ্ছেন, তখন তার হাতে কোনো চকোলেট বা চিপস না দিয়ে বরং পুষ্টিকর কিছু তুলে দিন। শিশুদের জাঙ্ক ফুড খাওয়ানোর বা উপহার দেয়ার একটি সংস্কৃতি আমাদের অসচেতনতার কারণে গড়ে উঠেছে। এবার প্রয়োজন তার একটি পাল্টা সংস্কৃতি তৈরি করা। আমাদের সন্তানদের সুস্বাস্থ্যের স্বার্থে। একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাতিরে।

নিজাম আশ শামস: লেখক ও সংবাদকর্মী

আরও