ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী ও অন্যতম বৃহত্তম শহর। ঢাকা শহরের আশপাশের নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা। শহরের পরিবেশ, জনজীবন ও অর্থনীতির জন্য যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একসময় এসব নদী স্বচ্ছ জলধারার মাধ্যমে ঢাকার পরিবহন, কৃষি ও বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম ছিল। তবে দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে এসব নদীর পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। শিল্প-কারখানার বর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য ও অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে নদীগুলোর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। ভূপৃষ্ঠে সবচেয়ে বেশি পানি দূষিত হয় নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও মানবসৃষ্ট কারণে। ঢাকা শহরের খাল ও পার্শ্ববর্তী নদীগুলো অত্যন্ত দূষিত। প্রতিদিন ৬০ হাজার ঘনমিটার বিপজ্জনক বর্জ্য তরল বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলা হয়, যা ঢাকা শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং সংযোগ করে তুরাগ, টঙ্গী খাল, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদী। উপরন্তু প্রতিদিন, নদীসংলগ্ন শিল্প-কারখানা থেকে দেড় মিলিয়ন ঘনমিটার বর্জ্য ঢাকার আশপাশের নদীতে পড়ে। এসব বর্জ্যের সিংহভাগই উৎপন্ন হয় ঢাকা এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ডিইপিজেড), নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, সাভার, গাজীপুর ও ঘোড়াশাল, যা প্রধান শিল্প এলাকা। সাভার উপজেলায় স্থানান্তরের আগে, ঢাকার হাজারীবাগ ও রায়ের বাজারে ট্যানারি থেকে প্রতিদিন ১৫ হাজার টন তরল বর্জ্য, ১৯ হাজার কেজি কঠিন বর্জ্য ও ১৭ হাজার ৬০০ কেজি পচনশীল বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলা হতো। এছাড়া ঢাকার বিশাল জনসংখ্যার ফলে প্রতিদিন প্রচুর গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এসব বর্জ্যের একটি বড় অংশ সরাসরি নদীতে ফেলা হয়। শহরের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব ও অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে ময়লা ও আবর্জনা নদীতে গিয়ে পড়ে। নগরীর বিভিন্ন স্থানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ব্যাগ, বোতল ও অন্যান্য কঠিন বর্জ্য নদীতে ফেলে দেয়া হয়। প্লাস্টিকের আবর্জনা নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করে এবং নদীতে তলদেশে জমে নদীর গভীরতা কমিয়ে দেয়। ঢাকার নদীগুলো নৌযান চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয়। এসব নৌযান থেকে নির্গত তেল ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ নদীতে মিশে পানিকে আরো দূষিত করছে। এছাড়া জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের সময় ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থও নদীর জন্য ক্ষতিকর। নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং ভূমি দখলের ফলে নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ও নদী ভরাটের কারণে নদীগুলোর প্রশস্ততা কমে যাচ্ছে এবং এতে পানির দূষণ আরো তীব্র হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোবায়োজিওকেমিস্ট্রি এবং পলিউশন কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে পরিচালিত একটি গবেষণায় ঢাকার আশপাশের নদীর পানির গুণগত মানের বর্তমান অবস্থার ওপর দ্রুত নগরায়ণের চিত্র ফুটে উঠেছে। পানির গুণগত সব পরিমাপকের মধ্যে দ্রবীভূত অক্সিজেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক মাপকাঠি। জলজ জীব বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রয়োজন। জলজ জীবনের জন্য, কম দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘনত্ব বিপজ্জনক। দ্রবীভূত অক্সিজেন ১৯৭৩ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমেছে। সত্তরের দশকে বুড়িগঙ্গা নদীর গড় দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘনত্ব ছিল ৬ মিগ্রা/লিটারের বেশি এবং ২০০৫ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘনত্ব ঋতুর ওপর ভিত্তি করে কমবেশি ছিল, কিন্তু ২০০৫-এর পর দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘনত্ব দ্রুতগতিতে হ্রাস পেয়েছে এবং ২০১৫ সালে এটি প্রায় শূন্যতে পৌঁছেছে, যা পরিবেশ অধিদপ্তরের সুপারিশকৃত মান থেকে অনেক নিচে অবস্থান করছে। ঘরোয়া বর্জ্যের সমান্তরালে বুড়িগঙ্গা উল্লেখযোগ্য শিল্পদূষণ দ্বারাও নদী দূষিত হচ্ছে। বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতিদিন ৬২৭টি ডায়িং, ৩৪৩টি ট্যানারি ও ১০৪টি শিল্প-কারখানা অপরিশোধিত বর্জ্য ছেড়ে দেয় এবং ৫ হাজার থেকে ৯ হাজার বর্গমিটার এলাকাকে দূষিত করে। এ দূষণকারীর ক্রমবর্ধমান প্রভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষয় হচ্ছে নদীর পানির গুণমান। এছাড়া তুরাগ নদীরও প্রায় একই প্রবণতা, যেখানে তুরাগে দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘনত্বের প্রাথমিক মান ছিল প্রায় ৬ মিগ্রা/লিটার, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি কমছে। ২০০৩-এর পর দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘনত্ব হ্রাস পেয়েছে এবং ২০১১ সালে প্রায় শূন্যতে পৌঁছেছে। তাছাড়া শীতলক্ষ্যার দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘনত্ব মান প্রাথমিকভাবে অন্যান্য দুটি নদীর মতো গড়ে ৬ মিগ্রা/লিটার ছিল, কিন্তু ১৯৯৪-এর পর এটি হ্রাস পেয়ে ২০০৬ সালে প্রায় শূন্যতে পৌঁছেছে। শীতলক্ষ্যার চারপাশে আরো অনেক বেশি শিল্প কার্যক্রম এবং অপরিশোধিত বর্জ্য পানি সরাসরি নদীতে প্রবেশ করে। এটি ইঙ্গিত করে যে এসব নদীর পানি অত্যন্ত দূষিত এবং জলজ জীবনের জন্য অনুপযোগী। বেশির ভাগ অংশে উচ্চ দূষণের হার উচ্চ বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ডের (বিওডি) মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। পানির বিওডি সূচক একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘনত্বের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। কারণ ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহারের ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন মাত্রা কমে যায় এবং বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড সূচক উচ্চ মাত্রায় থাকে। মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী পর্যাপ্ত দ্রবীভূত অক্সিজেনের অভাবে মারা যেতে পারে। কারণ অনেক ব্যাকটেরিয়া জৈব বর্জ্য পচনের জন্য অধিক পরিমাণে দ্রবীভূত অক্সিজেন গ্রহণ করে। সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্টের উপাদান, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, ট্যানারি, টেক্সটাইল থেকে শিল্প ও কৃষি বর্জ্য থেকে প্রচুর পরিমাণে জৈব বর্জ্য ঢাকার চারদিকে নদীতে প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে। বুড়িগঙ্গার বিওডি মান ২০০৫-এর আগে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু এরপর এর মান দ্রুতগতিতে বেড়ে চলছে। ২০১৫ সালে বুড়িগঙ্গা নদীতে সর্বোচ্চ পানির বিওডি সূচক মান ছিল ১৫১ মিগ্রা/লিটার। তবে পানির বিওডির মান নদীর সব জায়গায় অভিন্ন নয় এবং পরিবর্তিত হয়। তুরাগ নদীর বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড চাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে পরিবর্তন দেখা যায়। এর মান ক্রমাগত ওপরে ও নিচে ওঠানামা করে এবং তুরাগ নদীর টঙ্গী স্টেশনে সর্বোচ্চ ৩১ মিগ্রা/লিটার পানির বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড পাওয়া গেছে এবং শীতলক্ষ্যা নদীতে বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড মান পাওয়া গেছে ১৪৬ মিগ্রা/লিটার। এছাড়া ঢাকার চারদিকে নদীর পানির গুণগত মানের যথেষ্ট ঘাটতি আছে, যা অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের মনোযোগ প্রয়োজন। ঋতুগত তারতম্যের কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানির গুণমান সবচেয়ে বেশি খারাপ থাকে। ঢাকার চারদিকে সব নদীর মধ্যে শুষ্ক মৌসুমে পানির সর্বোচ্চ গুণগত মান সূচক পাওয়া গেছে, যা বর্ষা মৌসুমের তুলনায় অনেক গুণ বেশি। ১৯৯০ সালের আগে বুড়িগঙ্গা নদীর পানির গুণমান সূচক ভালো ছিল; যা সময়ের সঙ্গে এবং ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে ক্রমাগতভাবে পরিবর্তন হতে থাকে এবং বর্তমানে ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত। তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদী উভয়ের পানিও অতিমাত্রায় অনুপযুক্ত পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে, তাছাড়া ভারী ধাতুর দূষণ সূচকও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বর্তমানে ব্যবহারের জন্য অনুপযুক্ত।
পানির পরিমাপক এসব সূচকের মানদণ্ডে বিশ্বের অন্য নদীগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশের অন্যান্য নদীর তুলনায় ও ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর দূষণের মাত্রা অধিক। ঢাকার আশপাশের এসব নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মান সাধারণত দশমিক ৫-৩ দশমিক ৫ মিগ্রা/লিটার, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। যেখানে বাংলাদেশের অন্যান্য নদীর (যেমন মেঘনা, যমুনা, পদ্মা) পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মান ৫-৮ মিগ্রা/লিটার যা তুলনামূলকভাবে ভালো। বিশ্বের পরিচ্ছন্ন নদীর (যেমন অ্যামাজন, থেমস, ড্যানিউব) পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন সাধারণত ৭-১০ মিগ্রা/লিটার। ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর বিওডি চাহিদা সাধারণত ২০-৮০ মিগ্রা/লিটার (শুষ্ক মৌসুমে বেশি), যা মারাত্মক দূষণের নির্দেশক। যেখানে বাংলাদেশের অন্যান্য নদীতে বিওডি ৩-৭ মিগ্রা/লিটার, যা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ এবং বিশ্বের পরিচ্ছন্ন নদীতে সাধারণত বিওডি ২-৫ মিগ্রা/লিটার, যেখানে পানির স্বচ্ছতা ও জীববৈচিত্র্য ভালো থাকে।
পানির দূষণ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করে। দূষিত পানি পান ও ব্যবহারের ফলে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস ও ক্যান্সারের মতো রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ভারী ধাতু (যেমন সিসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম) ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মানবদেহে প্রবেশ করে স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা, কিডনি বিকল এবং শিশুদের বুদ্ধিগত বিকাশে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা বিশুদ্ধ পানির অভাবে দূষিত পানি ব্যবহার করে, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবেশগতভাবে দূষিত পানি জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, কারণ দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘাটতির ফলে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী মারা যায়। এছাড়া নদী ও জলাশয়ের স্বাভাবিক ইকোসিস্টেম বিনষ্ট হয়, যা খাদ্যশৃঙ্খল ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে মৎস্যসম্পদ হ্রাস পাচ্ছে এবং অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে। দূষিত পানি কৃষিতে ব্যবহৃত হলে ফসলের উৎপাদন কমে যায় এবং খাদ্যেও বিষাক্ত উপাদান প্রবেশ করে, সেই সঙ্গে মাটির উর্বরতা নষ্ট হতে পারে যা দীর্ঘমেয়াদে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া নদী থেকে সংগ্রহ করা পানির মাধ্যমে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে, যা দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কৃষিতে যখন কীটনাশক বেশি ব্যবহার হয়, তা বৃষ্টির মাধ্যমে কৃষিজমি থেকে নদীর পানি দূষণ করে। ক্রমবর্ধমান পানি দূষণ মাত্রার জন্য কোটি কোটি মানুষের শারীরিক ও পরিবেশগত হুমকির সম্মুখীন। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন ব্যক্তি ডায়রিয়াসহ পানিসংশ্লিষ্ট রোগ কলেরা, টাইফয়েড, পোলিও, অ্যাসকেরিয়াসিস ও ক্রিপ্টোস্পোরিডিওসিসে ভোগেন, এছাড়া পানি দূষণের কারণে বমি, মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট, বৈকল্য এবং মানবদেহের হাইপারঅ্যাকটিভিটি অবস্থাও হতে পারে। গবেষণা অনুযায়ী, শরীরের ভারী ধাতু এক্সপোজারের ফলে কিডনি রোগসহ ক্যান্সার, গর্ভপাত, আচরণ পরিবর্তন এবং কখনো কখনো এমনকি উচ্চ এক্সপোজারে মৃত্যু হতে পারে। এছাড়া মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণে নদীগুলো উদ্বেগজনক এবং জনস্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে। অসংখ্য স্বাস্থ্য সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে তুরাগ নদীর স্থানীয় বাসিন্দারা, যেমন ত্বকের সমস্যা, শ্বাসযন্ত্রের ব্যাধি, ডায়রিয়া, আমাশয়, রক্তাল্পতা এবং প্রসবের সময় অসুবিধা। এছাড়া এ অঞ্চলে পানিবাহিত ও ভেক্টরবাহিত রোগ, যেমন ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, জন্ডিস, কলেরাসহ অন্যান্য রোগ দেখা যায়।
সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যায় যে গত ৩০ বছরে শহরায়ণ এলাকা ২৮৮ শতাংশ বেড়েছে এবং জলাশয় ৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ গবেষণার মাধ্যমে আরো দেখা যায় যে ঢাকা শহরের আশপাশের নদীগুলোর পানির গুণমান টেকসই উন্নয়ন সবার জন্য বিশুদ্ধ পানি এবং স্যানিটেশন নিশ্চিত করার এ উদ্দেশ্যকে বাধাগ্রস্ত করছে। পানি সরবরাহ পুনরুজ্জীবিত করার জন্য নগর কর্তৃপক্ষের শুভদৃষ্টি কামনা করছি। বর্তমানে নদীগুলোকে রক্ষা করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও দূষণ রোধ ও নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। নদী দূষণ রোধে বিদ্যমান পরিবেশ সংরক্ষণ আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে পরিকল্পিত নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে পানির দূষণের মাত্রাও কমিয়ে আনতে হবে। ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর দূষণ কমাতে জনগণ ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর পরিবেশ আইন প্রয়োগ, শিল্প বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ রোধে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র স্থাপন বাধ্যতামূলক করা উচিত এবং যারা নিয়ম ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করতে পরিবেশবিষয়ক শিক্ষা ও প্রচারণা চালানো জরুরি, যাতে তারা নদীতে বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকে। বর্জ্য পুনর্ব্যবহার ও সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। শহরের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে যাতে গৃহস্থালি ও শিল্প বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়তে না পারে। শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে আরো উন্নত ও পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার। প্লাস্টিক ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তির প্রচলন করা উচিত। মানুষকে প্লাস্টিক কম ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে এবং বিকল্প উপকরণের প্রচলন বাড়াতে হবে। নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখার জন্য নিয়মিত নদী খনন ও দূষণমুক্তকরণ কর্মসূচি চালাতে হবে। এতে নদীর পানির গুণগত মান উন্নত হবে এবং নৌ-পরিবহন ব্যবস্থাও টেকসই হবে। প্রশাসন ও জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টায় ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর পানি দূষণ হ্রাস করা সম্ভব হবে, যা নগরবাসীর সুস্বাস্থ্য ও টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশে নদী দূষণ রোধে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আইন রয়েছে যা, পরিবেশ সুরক্ষা ও টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য প্রণীত হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫/২০২৩, “বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩, “জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩” এবং “পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০২১” উল্লেখযোগ্য। এসব আইনে নদীর পানি দূষণ রোধে কড়া বিধান রাখা হয়েছে। “বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫” অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি পরিবেশ দূষণমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তাহলে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি ও জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। “বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩” অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করে বা দূষিত করে, তাহলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩” অনুযায়ী, নদী দখল বা দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা কমিশনের রয়েছে এবং দোষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ভূমি দখল ও পানি দূষণের অপরাধে শাস্তির আওতায় আনা যায়। এছাড়া “পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০২১-এ নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি বর্জ্য নির্গমনের জন্য কারখানাগুলোকে জরিমানা ও লাইসেন্স বাতিলের বিধান রাখা হয়েছে। তবে আইন কার্যকর বাস্তবায়নের অভাব এবং যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় নদী দূষণ এখনো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি, যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে প্রতিটি নদীর পানির গুণমান সময়ের সঙ্গে হ্রাস পেয়েছে, যা নদী দূষণের হার বৃদ্ধির একটি উল্লেখযোগ্য ইঙ্গিত দেয়। নদীর আবশ্যক অতিরিক্ত অবক্ষয় রোধ করতে সুরক্ষিত ব্যবস্থা নেয়া এবং জলাশয় সংরক্ষণ করতে হবে। পানির গুণগত মানসূচক ক্রমবর্ধমান শহুরে এলাকার সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সম্পর্কযুক্ত, জলাশয় সংকুচিত হচ্ছে এবং জলের গুণমান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পাচ্ছে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি দূষণ একটি জটিল সমস্যা, যার সমাধানে প্রশাসন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আইন প্রয়োগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা এ দূষণ রোধ করতে পারি। আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিশুদ্ধ ও দূষণমুক্ত নদী নিশ্চিত করা যায়।
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক: অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ফেলো, রয়্যাল কেমিক্যাল সোসাইটি এবং চার্টার্ড পরিবেশবিদ, যুক্তরাজ্য