ছোট-বড় যেকোনো
দেশেরই ‘স্বাধীনতা পদক’ শব্দটি শুনলেই
আমার মনটা
আপ্লুত হয় এবং আমি
নমিত হই।
সব রকমের
স্বীকৃতি-পদকের
মূল্য অনেক,
কিন্তু ‘স্বাধীনতা’ পদকের একটি অন্য
রকমের ব্যঞ্জনা
আছে আমার
কাছে। সেটা
স্বাধীনতা পদক
বেশির ভাগ
দেশের সর্বোচ্চ
বেসামরিক সম্মাননা
বলে নয়, বরং তা একটি দেশের
স্বাধীনতা-সম্পৃক্ত
বিষয়ের জন্য
জীবনব্যাপী বিশাল
ও অর্থবহ
এক অবদানের
স্বীকৃতি বলে।
স্বাধীনতা পদক
তাই আমার
কাছে শুধু
গুরুত্বপূর্ণই নয়, পবিত্রও বটে।
কোনো বিজ্ঞজনের একটি রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্তিতে যখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষ মন্তব্য করে, ‘যোগ্য মানুষকেই সম্মান করা হয়েছে’ কিংবা ‘ওর অনেক আগেই এ স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল’, তখন বুঝতে হবে সম্মাননা যথাস্থানেই পৌঁছেছে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পদকপ্রাপ্তিতে কারো কোনো প্রশ্ন নেই। এই যেমন আফসান চৌধুরীকে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা বিষয়ে যখন ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ দেয়া হয়েছিল, তখন আমরা সবাই বলেছিলাম যে ‘যোগ্যতম ব্যক্তিকেই পুরস্কৃত করা হয়েছে’ কিংবা এ বছর যখন স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়েছে, তখন অনেকেই বলছেন, ‘অনেক আগেই তাঁকে এ সম্মাননা দেয়া উচিত ছিল।’ এ-জাতীয় মন্তব্য হচ্ছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের অনুমোদন।
এ মন্তব্য দুটোর বাইরে যখন পদকপ্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তখনই বিষয়টি জটিল হয়ে ওঠে। যেমন পদক যিনি পেলেন, তার অবদান বিষয়ে অস্বচ্ছ হলে কিংবা তার কাজের মানের ব্যাপারে অস্বাচ্ছন্দ্য প্রকাশ করলে। বছর দুই আগে সাহিত্য বিষয়ে স্বাধীনতা পদক নিয়ে রইজ উদ্দীন আহমেদের ক্ষেত্রে এমনতর অনভিপ্রেত ব্যাপারটি ঘটেছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে তার পদক প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
আমার এক বন্ধু বলেন, ‘পদক পেয়ে মানুষ মহিমান্বিত হন না, মহিমান্বিত মানুষদেরই পদক দিয়ে পদক সম্মানিত হয়।’ অন্য কথায়, পদক দিয়ে মানুষ চেনাতে হলেই মুশকিল। সেটা হলে সাধারণ মানুষের চোখে পদকপ্রাপ্তের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। শহীদ মোফাজ্জেল চৌধুরী স্বাধীনতা পদক পেলে, পদকপ্রাপ্তি দিয়ে তাকে চেনাতে হয়নি, স্বাধীনতা পদক অর্থবহ হয়েছে তাকে এ পদকে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে।
তবে কখনো কখনো ন্যক্কারজনক কোনো ব্যক্তিকে স্বাধীনতা পদক দিয়ে এর পবিত্রতাকে খর্বও করা হয়েছে। যেমন ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী শর্ষিনার পীর আবু সালেহকে স্বাধীনতা পদক প্রদান। আবু সালেহ্র মতো চিহ্নিত মানবতার শত্রুকে দেশের সর্বোচ্চ পদক দিয়ে তাকে মহিমান্বিত করা হয়নি, বরং তাকে এটি প্রদানের মাধ্যমে সে বছরেই অন্য দুজন স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে খাটো করা হয়েছে। সে দুজন অনন্যসাধারণ মানুষ হলেন প্রয়াত জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী।
স্বাধীনতা পদক প্রদান প্রক্রিয়াটি আমি নানাজনের লেখা পড়ে বুঝতে চেষ্টা করেছি। এর কিছু বিষয় আমার কাছে বোধগম্য, কিছু বিষয় আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির বহির্ভূত। যেমন আমি বুঝতে পেরেছি আমাদের স্বাধীনতা পদক প্রদানের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে একটি আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। জেনেছি প্রক্রিয়াটির শুরু এভাবে— প্রথমে একজনের নাম প্রস্তাব করে একটি ফর্দ পূরণ করে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে জমা দেন। স্থানীয় আমলা সেটাকে সুপারিশ করে ঊর্ধ্বতন আমলার কাছে পাঠান। তিনি সে সুপারিশ অনুমোদন করে সম্ভবত একটি বাছাই পর্ষদের কাছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পাঠান। ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হলে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সরকারের উচ্চতর পর্যায়ে পেশ করা হয়। সেখানে অনুমোদিত হলে তার ফল তখন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। হয়তো আমার ব্যাখ্যাটি একটি জটিল প্রক্রিয়ার সরলীকরণ, তবে প্রক্রিয়াটির মূল উপাদানগুলো এখানে বিধৃত হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।
এ চলমান প্রক্রিয়ার যেসব বিষয় আমি বুঝতে পারি না, তার প্রথমটি হলো, আমলাতন্ত্র কেন এ রকম একটি সৃজনশীল বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করবে! আমলারা আমাদের প্রশাসন চালাবে নিশ্চয়ই কিন্তু আমাদের শিল্প-সাহিত্যের মতো সুকুমার বিষয়গুলো কেন তাদের কব্জায় থাকবে? তাদের সুপারিশ ও সিদ্ধান্তেই কেন পুরো ব্যাপারটি নির্ধারিত হবে?
দ্বিতীয়ত, পাসপোর্টের জন্য আমরা নিশ্চয়ই ফর্দ পূরণ করব, রাষ্ট্রের কাছে অর্থ সাহায্য চাইলেও ফর্দ পূরণ করা প্রত্যাশিত হতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্যে ফর্দ পূরণ করা নিতান্তই অপমানজনক। ফর্দ পূরণের মানে হচ্ছে একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় একটি স্বীকৃতির জন্য আবেদন করছেন। স্বীকৃতি প্রদত্ত হয়, স্বীকৃতি আবেদনের মাধ্যমে পেতে হয় না। স্বাধীনতা পদকের মতো স্বীকৃতি যখন একজনকে দেয়া হচ্ছে, তার পরিচিতি, অবদান, মর্যাদা সম্পর্কে রাষ্ট্র প্রাক-অবহিত থাকবে। ফর্দের মাধ্যমে তার পরিচিতি জানতে চাওয়ার দুটো মানে—একটি হচ্ছে বিবেচনাধীন মানুষটি যোগ্য হলে তাকে অপমান করা, আর অন্যটি হচ্ছে বিবেচনাধীন মানুষটির যোগ্যতা অজ্ঞেয়, তাই ফর্দের মাধ্যমে তার সম্পর্কে তথ্য জানতে হবে।
তৃতীয়ত, স্বাধীনতা পদকের চূড়ান্ত বাছাই পর্ষদে কারা বসেন, আমাদের মতো আমজনতা তা জানি না। কিন্তু দেশের সাধারণ একজন মানুষ দাবি করতেই পারে, যেহেতু তার দেশের স্বাধীনতা পদকের বিষয়টি এখানে জড়িত, সেহেতু এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যারা গ্রহণ করছেন, তাদের নামগুলো জানার অধিকার দেশের একজন নাগরিক হিসেবে তার আছে।
চতুর্থত, চূড়ান্তভাবে যখন স্বাধীনতা পদকের তালিকাটি জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়, তার আগে সে তালিকার প্রতিটি নাম অতিসাবধানতার সঙ্গে কেন নিরীক্ষিত হয় না? কোনো নাম সম্পর্কে অস্বচ্ছতা থাকলে বা সে ব্যাপারে প্রশ্ন উঠলে সেগুলো কি পুনর্বিবেচিত হয়?
পঞ্চমত, স্বাধীনতা পদক যখন প্রত্যাহার করা হয় (যেমন রইজ উদ্দীনের ক্ষেত্রে), তখন কী কী বিবেচনায় তা প্রত্যাহার করা হয়? সে প্রত্যাহারের প্রক্রিয়াটি কী? সেটিও কি একটি আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত, নাকি রাষ্ট্রের উচ্চতর পর্যায়ে সে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল? আবার শর্ষিনার পীর আবু সালেহর স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহার কেন করা হচ্ছে না? কোন বিবেচনায় একজন চিহ্নিত ও প্রমাণিত কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীকে দেয় সে পদক বহাল তবিয়তেই আছে?
বোঝা না-বোঝার এ অবস্থান থেকে যদি অনুমতি করেন তাহলে আমি পাঁচটি প্রস্তাব করতে চাই। প্রথমত, স্বাধীনতা পদকের প্রক্রিয়াটিকে একটি গ্রহণযোগ্য, সম্মানজনক ও বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করুন। আমি প্রস্তাব করছি যে বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীনতা পদকের জন্য সে বিষয়ে অতীতের তিনজন স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তি কোনো একটি নাম প্রস্তাব করলে তবেই তিনি পদকের জন্য বিবেচিত হবেন।
দ্বিতীয়ত,
একটি সময়সীমার
মধ্যে প্রস্তাবিত নামগুলো একটি পূর্বগঠিত
বাছাই পর্ষদের
কাছে পাঠাতে
হবে বিবেচনা
ও বাছাই
করার জন্য।
আমি প্রস্তাব
করছি, দেশের
বিশিষ্টতম বিজ্ঞজনদের নিয়ে এ পর্ষদ
গঠন করা হোক এবং সে পর্ষদ
সদস্যের তালিকা
জনসমক্ষে প্রকাশিত
হোক। এতে স্বাধীনতা পদক প্রণয়ন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে।
তৃতীয়ত, আমি প্রস্তাব করছি, যেসব নির্ণায়কের ভিত্তিতে স্বাধীনতা পদকের প্রাপক নির্ধারিত হবেন, সুনির্দিষ্টভাবে সেসব নির্ণায়ক প্রণয়ন করে তা জনসমক্ষে তুলে ধরা হোক। এতে পুরো প্রক্রিয়ার দৃশ্যমানতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হবে।
চতুর্থত, আমি প্রস্তাব করছি স্বাধীনতা পদকের তালিকা চূড়ান্ত করার আগে সুপারিশকৃত নামগুলো পুনরায় পরীক্ষিত ও নিরীক্ষিত হোক। এতে পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহারে প্রশ্ন উঠবে না এবং রাষ্ট্রের উচ্চতর পর্যায়কে পরবর্তী সময়ে কোনো অনভিপ্রেত অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হবে না। এ ভিন্ন একটি দেয় পদক প্রত্যাহার তার প্রাপক ও তার প্রিয়জনদের কাছে একটি সুখকর অভিজ্ঞতা হতে পারে না।
পঞ্চমত, আমি একক ও যূথবদ্ধভাবে দৃঢ় কণ্ঠে দাবি জানাচ্ছি যে শর্ষিনার পীর আবু সালেহের স্বাধীনতা পদক শর্তহীনভাবে অবিলম্বে প্রত্যাহার করা হোক। এটা না করা হলে একজন যুদ্ধাপরাধীকে স্বাধীনতার যোদ্ধা বলে স্বীকার করা হবে, একটি দুষ্কর্মকে স্থায়ীভাবে সমর্থন করা হবে, জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর মতো ব্যক্তিত্বদের অপমান করা হবে এবং স্বাধীনতা পদকের অবমাননা করা হবে।
স্বাধীনতা পদক বাংলাদেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। পবিত্রতা সর্বদা আবেগ নয়, বরং বিভিন্ন সময়ে এক ধরনের বস্তুনিষ্ঠতা দাবি করে। তাই স্বাধীনতা পদক, পদকের নির্বাচন প্রক্রিয়া, পদকপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে আবেগ দ্বারা তাড়িত নয়, বরং বিবেক দ্বারাই চালিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র