তারুণ্যের স্বপ্নের বাংলাদেশ কোন পথে?

এ দেশের তরুণরা এখন দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। বিগত সময়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাওয়া অনেক তরুণই এখন দেশে থাকতে চায়। দেশে ভালো কিছু করতে চায়। স্বদেশের মাটিকে ভালোবেসে দেশের জন্য কিছু করতে চাওয়া তরুণদের স্বপ্নকে কিছুতেই দমানো যাবে না।

‘আই হেট পলিটিকস’ প্রজন্ম অবশেষে রাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের ছাত্র রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নের চক্রে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, আর দেশের মেধাবী প্রজন্ম ব্যস্ত থেকেছে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্নে। বিগত সরকারের সময় যখন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ সরকারি চাকরিতে কোটা ফিরে এল, তখনই তরুণদের মনে দ্রোহ জেগে উঠল। পর্যায়ক্রমে তা কোটার গণ্ডি পেরিয়ে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের বৃত্তে উপনীত হলো।

অথচ দীর্ঘদিন তরুণরা ভোট দিতে পারেনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করতে হয়েছে। গেস্টরুমে অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছে ভর্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আসা শিক্ষার্থীদের। হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলো পরিণত হয়েছে রিডিং রুমে। লাইব্রেরির সংগ্রহে থাকা দুষ্প্রাপ্য বইয়ে ধুলো জমেছে, আর টেবিলে ঠাঁই পেয়েছে বিসিএস ও সরকারি চাকরির বই।

প্রচণ্ড বিসিএস ম্যানিয়ায় ডুবে রয়েছে প্রজন্মের বড় একটি অংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা পরিণত হয়েছে সনদ অর্জনের প্রতীকে। বিশ্ববিদ্যালয়েও কাঙ্ক্ষিত গবেষণা নেই। পিএইচডি থিসিস এমনকি জার্নালেও চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠছে অহরহ। সময়োপযোগী গবেষণা না থাকায় শিক্ষা কার্যক্রমেও তার প্রভাব পড়ছে। তরুণরা ক্লাস করতে আগ্রহ পায় না, কিন্তু পরীক্ষার জন্য বাধ্যতামূলক ৬০ শতাংশ ও ১০ নম্বরের জন্য ৯০ শতাংশ উপস্থিতির শর্তে ক্লাসে থাকতে বাধ্য হয়। কর্মজীবনে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারে এ রকম শিক্ষার অনুপস্থিতিও লক্ষণীয়। কিন্তু জেলায় জেলায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা। অন্যদিকে বিশ্বে দক্ষ শ্রমশক্তি রফতানিতে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। প্রয়োজনীয় সফট স্কিলের উন্নতিতে দৃশ্যমান অগ্রগতিও লক্ষণীয় হয়নি। কিন্তু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে দেদার।

দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছিল। যে কারণে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি অকাতরে প্রবেশ করেছে। সরকারি অফিসে ঘুস ছাড়া ফাইল নড়েনি। বিশ্বের সর্বোচ্চ ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে সড়ক। উন্নয়নের কথা বলে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে মূল্যস্ফীতির খড়্গ। কোথাও যেন শৃঙ্খলার দেখা মিলছিল না। স্বজনপ্রীতি আর অনিয়ম নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। বেকারত্ব ক্রমে বেড়ে গিয়েছিল, শিক্ষাজীবন শেষ করে পরিবারের হাল ধরতে না পারা তরুণদের সংখ্যা বাড়ছিল। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির কারণে বঞ্চিত হচ্ছিল প্রকৃত মেধাবীরা।

এ বৈষম্য ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত, ২০১৮ সালে পরিপত্র জারির মাধ্যমে কোটা পদ্ধতির বিলুপ্তি ঘটলেও হাইকোর্টের রায়ে আবার ফিরে আসায় তরুণরা রাজপথে নেমে এল। এ দাবির সঙ্গে ক্রমে জমে ওঠা ক্ষোভের রেশ জড়ো হলো। ফলে আন্দোলন আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। ছড়িয়ে পড়ল সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। রূপ নিল সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে। পরিশেষে ছাত্র-জনতার আন্দোলন সফলতা পেল। পতন হলো স্বৈরাচার হয়ে ওঠা শাসক শেখ হাসিনার। দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে গেলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হলো। এ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে দুজন ছাত্র উপদেষ্টাও রয়েছেন।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ছাত্র-জনতার দাবি অনুযায়ী সংস্কারের দিকে মনোযোগী হয়েছে। সর্বস্তরের প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। সংস্কারের জন্য কমিশনও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এ সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল। সহযোগী একটি পত্রিকার শিরোনাম হলো ‘দাবির কোনো শেষ নেই’। সবাই দাবি নিয়ে রাজপথে নামছে, রাস্তা বন্ধ করে রাখছে। এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে ধৈর্য ধরতে বললেন।

বস্তুত এখন ধৈর্য ধরারই সময়। গত ১৭ বছরে যে কথা বলতে পারেনি সাধারণ মানুষ, সে কথা এখন বলতে পারছে, এমন দৃশ্য কি কল্পনা করা গেছে? জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। কিন্তু সব তো রাতারাতি পরিবর্তন হবে না। এ বাস্তবতা সবাইকে বুঝতে হবে। বিশেষ করে দেশটাকে তরুণদের নেতৃত্ব ও অভিজ্ঞদের প্রাজ্ঞ দিকনির্দেশনার আলোকে পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণদের স্বপ্নের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে।

এ দেশের তরুণরা এখন দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। বিগত সময়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাওয়া অনেক তরুণই এখন দেশে থাকতে চায়। দেশে ভালো কিছু করতে চায়। স্বদেশের মাটিকে ভালোবেসে দেশের জন্য কিছু করতে চাওয়া তরুণদের স্বপ্নকে কিছুতেই দমানো যাবে না। তাই সংস্কারের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা অনুযায়ী আগামীর বাংলাদেশ গড়া এখন সময়ের দাবি। এ কাজে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হলে সংস্কারের আশা ফিকে হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তরুণদের ভূমিকাকে মূল্যায়ন করা উচিত। মেধাভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। হলগুলোয় গণরুম বিলুপ্ত করে মেধার ভিত্তিতে আসন বণ্টনের যে ধারা শুরু হয়েছে, সেটি ধরে রাখা উচিত। আবার ছাত্র রাজনীতির অনুপস্থিতিতে মব জাস্টিস যেন না হয়, সেটিও খেয়াল রাখতে হবে। তরুণদের রক্ত গরম, এটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মোদ্দাকথা এক্ষেত্রে উষ্ণ হৃদয় ও ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের সম্মিলনটাই বেশি জরুরি।

তরুণরা দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখুক, এ স্বপ্নের ধারাবাহিকতাকে ধরে রাখতে হবে। যে তরুণরা ট্রাফিক পরিচালনার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা দেখিয়েছে, তারা দেশ পরিচালনার প্রতিটি স্তরেও দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, এটিই সবার কাম্য।

তৌফিকুল ইসলাম: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা

আরও