ড. এম শামসুল হক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক। ঢাকার মেট্রোরেল ও হাতিরঝিল প্রকল্পসহ অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দিদারুল হক
আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিশেষ করে সড়কপথের উন্নয়নে অনেক দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ হলেও সড়ক দুর্ঘটনা কেন কমানো যাচ্ছে না?
আমাদের সড়কগুলোয় শৃঙ্খলা নেই। বরং এ বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য দিন দিন বাড়ছে। সড়কের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দুর্ঘটনা কমার একটি সরাসরি সম্পর্ক থাকে। রাস্তাঘাটের উন্নতি হলে সেখানে সুশৃঙ্খল থাকবে এবং সড়ক দুর্ঘটনা কম ঘটবে। কিন্তু আমাদের দেশে বিশৃঙ্খলভাবে সড়ক ব্যবহার হয়। ধারাবাহিক নজরদারিও থাকে না। ফলে অহেতুক দুর্ঘটনাগুলো ঘটে। মানুষ অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করে। যেমন ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। রাস্তার অবকাঠামো, ডিজাইন ও পরিকল্পনা খুবই আধুনিক ও উন্নত। এ কারণে মহাসড়কটি প্রকৃতভাবেই নিরাপদ হবে। কিন্তু সড়ক তো নিজে নিজে নিরাপদ হতে পারে না। সড়কে কে কীভাবে প্রবেশ করবে, কে কীভাবে গাড়ি চালাবে, শৃঙ্খলা হয় কিনা—এসব বিষয় সারা বছর ধরে দেখভাল করতে হয়। দেখভালের জন্য লোকজন থাকে না। তবে এর চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে জবাবদিহিতা থাকে না। সড়কে এত বিনিয়োগের পরও আমরা সড়ক দুর্ঘটনা থেকে বের হয়ে আসতে পারছি না।
বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে ঈদ। আমাদের রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে। তার পরও ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের সড়কে ভোগান্তি বেড়ে যায়। এ ভোগান্তির কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
অফিসে যাওয়ার সময় ভোগান্তি বাড়ে। এটি পৃথিবীজুড়েই একই চিত্র। কেননা তখন সব মানুষ একসঙ্গে চলাফেরা করে। ফলে ভোগান্তির মাত্রা অনেক বেশি হয়। চাহিদা অনুপাতে রাস্তা কম। আমাদের এখানেও ঈদের সময় সবাই একসঙ্গে বাড়িতে যায় এবং একমুখী যান চলাচল করে। তখন সড়কে যাত্রী ও গাড়ির চাপ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এই চাপ সহ্য করার জন্য বিশ্বের অন্য দেশগুলো যে পরিকল্পিত উন্নয়ন করেছে সেটি আমাদের দেশে নেই। এছাড়া আমরা নৌপথের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাই না। সড়কপথের উন্নয়নে আমরা বিনিয়োগ করি বেশি। বিনিয়োগ বেশি করলে স্বাভাবিক কারণেই সে জায়গার প্রতি মানসিক যে চাপ আসে, সেই চাপ নিতে পারে না। তার মধ্যে সেই জায়গাও আবার বিশৃঙ্খল। যখন যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে যায় তখন অতিরিক্ত গাড়ির চাহিদাও বেড়ে যায়। তখন শহরের ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোই মহাসড়কে যাত্রী পরিবহন করে। ছোট ছোট গাড়ির সংখ্যাও বেড়ে যায়। ফলে এসব গাড়ি যানজটের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সাধারণত দূরপাল্লায় মোটরসাইকেল চলা উচিত না। এটি নিরাপদ না। সেই হিসেবে বিশৃঙ্খল সড়কে ছোট ছোট মোটরসাইকেলে বাড়িতে যাওয়ার জন্য সুযোগ দিই। যে গাড়ি পরিবহনের জন্য ফিট না, এমনকি ট্রাক মূলত মাল পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হলেও মানুষ পরিবহন করা হচ্ছে। তখন ড্রাইভারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় হেলপার গাড়ি চালায়। পুলিশ তখন রাস্তাকে চলমান রাখার জন্য শ্রম নিয়োগ করে। এ সময় কাগজপত্র দেখার সুযোগ থাকে না এবং আইন প্রয়োগও করা যায় না। বিশ্বের অন্যান্য দেশ বছরজুড়েই এ কাজগুলো করে। সড়কের অসংগতি নিয়ন্ত্রণ রাখা, হাইওয়েতে ধীরগতির গাড়ি না আসা, টোল প্লাজাকে শতভাগ ডিজিটাল করে ফেলা—এসব নজরদারি সারা বছর সমন্বিতভাবে করা দরকার। যেটি আমাদের দেশে হয় না। ফলে মানুষের ভোগান্তি ও সড়ক দুর্ঘটনা বাড়তে থাকে।
ছুটির মৌসুমে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায়?
যদি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন পরিকল্পিতভাবে হতো তাহলে বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হতো। পদ্মা ব্রিজ করার কারণে নৌপথের ব্যবহার শেষ হয়ে গেছে। কেন শেষ হবে? নৌপথকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এটিকে বলা হয় সরকারের কৌশল। নৌপথ পরিবেশবান্ধব ও উৎসবের সময় বিরাট সহযোগিতা করে। সড়কের উন্নয়নের পাশাপাশি নৌপথসহ অন্যগুলোর উন্নয়ন করতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ পরিকল্পিত উন্নয়ন করে। তবে তাদেরও চাপ থাকে। তবে চাপটি দুর্ভোগে পরিণত হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে দুর্ভোগ তো আছেই, দুর্ঘটনাও আছে। আমরা পেশাদারত্ব বজায় রাখতে পারছি না। সড়কের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট রয়েছে তারা সম্পূর্ণভাবে অদূরদর্শী ও অপেশাদারি লোক। এ দেশে সব জায়গায় সবকিছু জোড়াতালি দিয়ে চলে। কোনোভাবে গায়েগতরে প্রাগৈতিহাসিক কায়দায় ঠেকা দেয়া হয়। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে ও স্বনিয়ন্ত্রিতভাবে মানুষের ব্যবহার কমিয়ে কৌশল ব্যবহারের জন্য যে দূরদর্শী ও পেশাদারত্ব দরকার—প্রতিষ্ঠানগুলোর তা নেই। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করে পরিকল্পিতভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোয় যদি পেশাদার ব্যক্তি দায়িত্ব পায় তাহলে তারা বলবে, এ বছর যেহেতু বিশৃঙ্খলা কমাতে পারিনি, তাই আগামী তিন বা পাঁচ বছর সময় ধরে এ সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। মহাসড়কে ছোট ছোট গাড়ি চলবে না, হাটবাজারগুলো মহাসড়ক থেকে দূরে থাকবে, যান চলাচল কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হবে না। যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা কাজ করে, কাজ না করলে তাদের জবাবদিহি করতে হবে—এ সংস্কৃতি আমাদের দেশে নেই। আমরা জোড়াতালি দেয়ার সংস্কৃতিতে, অপেশাদারি সংস্কৃতিতে আছি। জনগণের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে সেগুলোও জানে না কীভাবে পেশাদারি করতে হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোয় অপেশাদার ও অক্ষম লোক রয়েছে। টেকসই সমাধান করতে হলে আমাদের অনেক দূর হাঁটতে হবে। বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। পরিকল্পিত ও দূরদর্শীভাবে সারা বছর ধরে নিরাপত্তা ও যানজটের উৎসস্থল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভবিষ্যতে আমাদের পরিবহন চাহিদা কী হবে এবং সেটাকে কীভাবে সামাল দেব—সেগুলোর আগাম চিন্তা করার পেশাদারি প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে। গতানুগতিক পদ্ধতিতে পরিবহন ব্যবস্থা কখনই পরিবর্তন হবে না। বরং পরিবহন ব্যবস্থা বিশৃঙ্খলা হবে। কারণ অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত হয়ে যাচ্ছে। মাস্তানি করলে অনেক টাকাপয়সা আয় করা যায়। তাই একটি পক্ষ এ খাতে শৃঙ্খলা আসতে দেবে না। কারণ তারা জানে শৃঙ্খলা হলে চাঁদাবাজি করা যাবে না। বিশৃঙ্খল জায়গায় কিংবা কোনো চালক কিংবা গাড়ি অবৈধ থাকলে সেখানে চাঁদাবাজি করা যায়। এখন যদি পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনা না যায় তাহলে ভবিষ্যতে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাব না।
গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাস অতিবাহিত হয়েছে। এই সাত মাসেও রাজধানীসহ বড় বড় শহরের সড়কে এখনো শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং ও ফুটপাত দখল করায় শহরে যানজট চরম আকার ধারণ করেছে। আবার যারা ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করেছিল তাদের কেউ কেউ এখন সরকারে রয়েছে। তার পরও কেন সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসছে না?
কোনো কিছুই ম্যাজিক না। কোনো কিছুতে যখন পচন ধরে তখন তাকে ম্যাজিকের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে যদি একটি বডি বিবেচনা করা হয় তাহলে এর প্রতিটা প্রতিষ্ঠানে বা অর্গানে পচন ধরে গেছে। কোনো ব্যক্তিই রাতারাতি একে সুস্থ করে তুলতে পারবে না। রাস্তায় যানবাহন নামায় বাংলাদেশে রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। বিআরটিএ চালায় কারা? আমলারা। আর আমলা দিয়ে বিশেষায়িত কাজ সম্ভব নয়। বিআরটিএ কিছুই করতে পারে না। পুলিশও কাজ করে না। সবগুলো প্রতিষ্ঠানে ধস নেমেছে। সত্যিকার অর্থে যদি পরিবহনে কোনো কিছু করতে হয় তাহলে বিশেষায়িত লোক দরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয়।
বিআরটিএর মতো একটা টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠান চালায় আমলারা। এখানে দরকার স্পেশালাইজড লোক। যে লোক জেনারেল পড়াশোনা করছে, সারা জীবন সাধারণ কাজ করে আসছে তাকে যদি বিআরটিএর প্রধান করে দেয়া হয় তাহলে তো ভালো আউটপুট পাওয়া সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোথাও কোনো আমলা বিআরটিএর মতো টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠান চালায় না। আর আমলারা মনে করে তারা সব বিষয়ে এক্সপার্ট কিন্তু একজন মানুষ তো সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে পারে না। এ আমলাদের কারণেই দেশের সব প্রতিষ্ঠানে পচন ধরেছে। আমলাতন্ত্র থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে এ পচন ঠেকানো সম্ভব না। কোনো একজন ব্যক্তি এসে ম্যাজিক দিয়ে ভালো কিছু করে ফেলবে তা ভাবাই বোকামি। আবার ট্রাফিক পুলিশও ঠিকঠাকমতো কাজ করে না, পথচারীরা আইন মানে না, উল্টো পথে গাড়ি চালায়-এ সবকিছু মিলিয়েই চরম বিশৃঙ্খলা।
এ জাতীয় সমস্যা সমাধানের প্রথম ও প্রধানতম উপায় বিআরটিএসহ সব টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেয়া এবং কাজের স্বাধীনতা দিতে হবে। পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দুবাইয়ের বিআরটিএতে প্রতিটা নিয়োগ দেয়া হচ্ছে যোগ্য ও পেশাদার ব্যক্তিকে। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিআরটিএতে কেবল আমলাদের পাওয়া যাবে।
এছাড়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে আমলাদের বদলি হয় দু-তিন বছর অন্তর। ফলে দুর্নীতি-অনিয়মের দায় ঢালাওভাবে পূর্বতনের ওপর চাপানো হয়, থাকে না কোনো স্বচ্ছতা কিংবা জবাবদিহিতার বালাই। উন্নত বিশ্বে আমলাদের যেখানে নিয়োগ হয় সে জায়গা থেকেই অবসরে যেতে হয়, এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার জ্ঞান ও দক্ষতার বিশেষায়ণ হয় এবং নিয়মতান্ত্রিকতাও সুনিশ্চিত হয়।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কোথাও ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণের কথা বলা হয় না। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে সর্বজনীন প্রবেশযোগ্যতা দিয়ে রাস্তাঘাট বানাতে হবে। অথচ আমাদের দেশে আমলারা তাদের ৫০-৬০ বছর আগের ধ্যানধারণা থেকে একের পর এক ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করেন, মানুষ পার হয় তার নিচে দিয়ে। যদি এ জায়গাগুলোয় পরিবহন বিশেষজ্ঞ কাউকে দায়িত্ব দেয়া হতো তাহলে আমরা একই চিত্র দেখতে পেতাম না। নিউইয়র্ক ও টোকিওর মতো ব্যস্ত শহরের কোথাও ফুট ওভারব্রিজ নেই। তারা ৫০-৬০ বছর আগেই ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ বাদ দিয়েছে। পরিববহন বিশেষজ্ঞ কেউ বলে দেশীয় রাস্তা, অবকাঠামো বিবেচনা করে তিনি একটা কার্যকর সমাধান দিতেন। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ডিজিটালি সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পথচারীরা রাস্তা পার হয়, সেটাও অনুসরণ করতে পারতেন।
জনগুরুত্বপূর্ণ এ খাতে আমলাতন্ত্রের লালফিতা থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা যায়?
আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান বা দক্ষতা না থাকার পরও তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তা হয়ে যান। তাদের ভার আছে কিন্তু ধার নেই। অর্থাৎ জবাবদিহি নেই। তাহলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? খুবই সহজ—আমলাকে সাপোর্ট সিস্টেম বা ব্যাকবোন হিসেবে রাখা; বিশেষজ্ঞদের কাজকে সহজ করতে, তাদের কাজের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আমলারা কাজ করবে, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কাজ আমলারা করবে না। সড়কে এত বিনিয়োগের পরও জনগণ কেন সুফল পাচ্ছে না—এসব কারণ উদ্ঘাটন করে গণমাধ্যম মানুষের চোখ খুলে দিতে পারে। একই সঙ্গে সম্ভাব্য সমাধানের পথ বাতলে দিতে পারে। প্রতিটি সমস্যার কারণ বের করা হলে তা রাজনৈতিকভাবেও দৃষ্টি লাভ করবে এবং এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। ফলে চালক নিয়ম মানে না বা জনগণ নিয়মের তোয়াক্কা করে না—এসব মুখস্থ বুলি না আউড়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে তৎপর হতে হবে। পরিকল্পনা যদি স্মার্ট হয় আইন প্রয়োগের বাধ্যবাধকতা সত্যিকার অর্থে থাকে কি? হাতিরঝিলে ট্রাফিক পুলিশ ছাড়াই প্রত্যেকে নিয়ম মেনে গাড়ি চালাচ্ছে। এটি খোদ ঢাকার বুকেই। তাহলে অন্য জায়গায় কেন সেটা সম্ভব হচ্ছে না?
নদীবিধৌত আমাদের দেশের নদীপথকে কীভাবে আরো উন্নত করা যায় বলে আপনি মনে করেন?
রেল, সড়ক ও নৌ—এ তিন পথের মধ্যে সড়কপথের উন্নয়ন হয়ে যায় সামগ্রিক উন্নয়ন। গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় সড়কপথে মানুষ তাদের বাড়ি পৌঁছতে পারে। এজন্য সড়কপথের যেকোনো উন্নয়নের সুবিধাভোগীরা লাফিয়ে চলে আসে।
কিন্তু রেলস্টেশন বা নদীবন্দর বানানোর পর মানুষ সেখানে নামার পর কীভাবে যাবে তার সংযোগ সড়ক দেয়া হয়নি। ফলে এ সেবা যতই সাশ্রয়ী হোক না কেন মানুষের ভোগান্তি বাড়ায়। কিন্তু টার্মিনালে নেমে বাসায় যাওয়া এবং বাসা থেকে টার্মিনালে যাওয়ার ব্যবস্থাকে বলা হয় সামগ্রিক উন্নয়ন। বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কাজটি করে সরকারের পরিকল্পনা কমিশন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে পরিকল্পনা কমিশনে কোনো পরিকল্পনাবিদই থাকেন না। ফলে সামগ্রিক উন্নয়নের পরিবর্তে খণ্ডিত উন্নয়ন হয়।
সদরঘাট টার্মিনালকে কার্যকর করতে কোন ধরনের সংস্কার জরুরি বলে মনে করেন?
সদরঘাটের মতো নৌ টার্মিনাল যদি কোনো উন্নত দেশে হতো তাহলে তারা উন্নয়নের জন্য প্রথমেই যাত্রীদের ওঠানামার সুপ্রশস্ত রাস্তা, বিশ্রাম নেয়ার যথোপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি এবং টার্মিনাল থেকে বের হয়ে যেকোনো মাধ্যমে বাকি পথ যাওয়ার সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করত। টার্মিনালে ওঠানামার জন্য বড় জায়গা থাকত। সড়কপথে যাতায়াতের সুব্যবস্থা থাকত। পুরো পৃথিবীই এভাবেই নৌপথের উন্নয়ন করে। অর্থাৎ নৌপথকে সড়কপথের সঙ্গে সমন্বিত করে ফেলে উন্নত দেশগুলো। এ পথে বাস চলাচল করবে। উন্নত দেশের পরিকল্পনাবিদরা এভাবেই নৌপথকে সড়কপথের সঙ্গে সমন্বিত করেন।
কিন্তু বাংলাদেশে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নৌবন্দর হয়, টার্মিনাল হয় এবং ড্রেজিংয়ের কাজ হয়। কিন্তু সড়কপথের সঙ্গে সংযোগ করা হয় না নৌবন্দরের। ফলে ভোরে/রাতে যাত্রীরা টার্মিনালে পৌঁছার পর সিএনজি দিয়ে অধিক ব্যয়ে যাতায়াত করতে হয়। কারণ সকালে মানুষের চলাচল কম থাকায় বা বাস না থাকায় তখন মানুষ জিম্মি হয়ে পড়ে রিকশা বা সিএনজিচালকদের কাছে। আমাদের দেশে পেশাদার লোকের অভাব। নৌপথ তো আলাদা কিছু নয় এবং নৌপথের দুই প্রান্তে সংযোগ সড়ক সরকারকেই দিতে হবে। এ ধরনের সুবিধা না থাকায় রেল বা নৌ টার্মিনালে যাওয়া-আসার পথে যাত্রীদের সময়, ব্যয় ও বিড়ম্বনা বেড়ে যায়। এমনকি হয়রানির শিকার হতে হয়। তাই টার্মিনালে আসা থেকে শুরু করে নামার পর গন্তব্যে পৌঁছা পর্যন্ত সড়কপথের সংযোগ সুনিশ্চিত করা, যানবাহনের ব্যবস্থা করা এবং জানমালের নিরাপত্তা দেয়া সরকারেরই দায়িত্ব। এসব পরিকল্পনামাফিক করতে হবে।
বাইরের দেশের টার্মিনালে কোনো দালাল বা ভেন্ডর বা কোনো বাইরের লোক থাকে না। সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে। যাত্রীদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তার উল্টো। সেবাধর্মী এ ধরনের খাতে যোগ্য, দক্ষ ও পেশাদার ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দায়িত্ব অবহেলা করলে প্রয়োজনে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এতে প্রতিষ্ঠানটি সেবাধর্মী ও পেশাদারি হয়ে গড়ে উঠবে।