সময়ের ভাবনা

অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি ও আর্থিক ক্ষতির খতিয়ান

গত কয়েক দিনে বাংলাদেশে বেশকিছু ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে ঢাকা শহরের সিদ্দিকবাজার ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। মাত্র এক বছরেরও কম সময়ে সীতাকুণ্ডে বড় দুটি (এর আগে ২০২২ সালের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ড উপজেলার একটি কনটেইনার ডিপোতে আগুন লেগেছিল) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। এ থেকে স্পষ্ট, পূর্বের

গত কয়েক দিনে বাংলাদেশে বেশকিছু ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে ঢাকা শহরের সিদ্দিকবাজার ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। মাত্র এক বছরেরও কম সময়ে সীতাকুণ্ডে বড় দুটি (এর আগে ২০২২ সালের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ড উপজেলার একটি কনটেইনার ডিপোতে আগুন লেগেছিল) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। এ থেকে স্পষ্ট, পূর্বের ঘটনা থেকে আমরা কোনো ধরনের শিক্ষা নিইনি।

 অগ্নিকাণ্ডের কারণে একটি দেশ বিভিন্ন দিক দিয়ে ক্ষতির শিকার হয়। অসংখ্য মানুষের প্রাণ চলে যায়। জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে যারা কোনো রকমে বেঁচে যান, তারা আজীবন মানসিক সংকট নিয়ে দিনাতিপাত করেন। শারীরিক অপূর্ণাঙ্গতা তো আছেই। মানসিক ও শারীরিক জটিলতা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া তাদের জন্য দুরূহ হয়ে ওঠে। এর ফলে একটি দেশের মানবসম্পদ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

একেকটি অগ্নিকাণ্ডের কারণে একটি দেশ বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়। চূড়ান্ত বিচারে তা দেশটিকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেশটি আর্থিকভাবে কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও কতজন মানুষ আহত বা নিহত হয়েছে, তার একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরাই এ লেখার মুখ্য উদ্দেশ্য।

বর্তমানে মানবসৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে অগ্নিকাণ্ড অন্যতম। এটিকে নগরায়ণের অন্যতম অভিশাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জনসংখ্যার অধিক ঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন এবং নির্মাণ নীতিমালা (বিল্ডিং কোড) অনুসরণ না করার কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। ২০০৮ সালে সারা দেশে মোট ৯ হাজার ৩১০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আর ২০১৮ সালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ১৯ হাজার ৬৪২টি (বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৯)। এ হিসাব অনুসারে দেখা যাচ্ছে, ১০ বছরে বাংলাদেশে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ১১১ শতাংশ বেড়েছে। ২০০৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সারা দেশে প্রায় দুই লাখ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। এতে অন্তত ১ হাজার ৯৭০ জন নিহত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত ও আহত হয় ২০১১ সালে। সে বছর নিহতের সংখ্যা ছিল ৩৬৫। আহত হয়েছিল ১ হাজার ৩৮৫ জন। আর আর্থিক ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়েছিল ২০১৫ সালে। সে বছর সংঘটিত মোট ১৭ হাজার ৪৮৮টি অগ্নিকাণ্ডে বাংলাদেশের মোট আর্থিক ক্ষতি হয় ৮৫০ কোটি টাকা। 

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ‘বার্ষিক পরিসংখ্যান ডাটা-২০২২’ থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে মোট ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে মোট আর্থিক ক্ষতি হয় ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৯ টাকা। এ সংস্থার ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ২৩৩। মোট আর্থিক ক্ষতি ২৮৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২০ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে মোট ২৪ হাজার ৭৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ১৮৪ জন নিহত হয়। আহতের সংখ্যা ৫৬০। 

এ তো গেল অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি ও আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ। এবার আমরা দেখি সাধারণত কী কী কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের বার্ষিক পরিসংখ্যান ডাটা-২০২২ অনুসারে, সে বছর বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। এ কারণে মোট ৯ হাজার ২৭৫টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। শতকরা হার ৩৮ দশমিক ৪৮। এতে মোট ক্ষতি হয় ১৩৩ কোটি ৬৭ লাখ ৪৮ হাজার ৪৯৭ টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে। মোট অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ৩ হাজার ৮৭৮। শতকরা হার ১৬ দশমিক শূন্য ৮। এ কারণে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড থেকে এক বছরে মোট আর্থিক ক্ষতি হয় ৩৪ কোটি ৬৪ লাখ ৮৭ হাজার ১৬৪ টাকা। অগ্নিকাণ্ডের তৃতীয় প্রধান কারণ হলো চুলা (ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটির চুলা ইত্যাদি)। এ কারণে মোট ৩ হাজার ৩৬৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। শতকরা হার ১৩ দশমিক ৯৮। এ কারণে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৮৩ কোটি ৫১ লাখ ২০ হাজার ৮২৯ টাকা। চতুর্থ সর্বোচ্চ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে গ্যাস সরবরাহ লাইনের আগুনের কারণে। এ কারণে মোট ৭৯৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। শতকরা ৩ দশমিক ৩০। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৯০৩ টাকা। অগ্নিকাণ্ডের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা। এ কারণে এক বছরে মোট ৬০২টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। শতকরা হার ২ দশমিক ৫০। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি ৫৬ লাখ ৪৩ হাজার ১২৫ টাকা। এছাড়া অন্যান্য কারণের মধ্যে আছে খোলা বাতি ব্যবহার (৩২৭টি), উত্তপ্ত ছাই বা জ্বালানি (৪৮৮টি), যন্ত্রাংশের ঘর্ষণজনিত (১৬৭টি), শত্রুতামূলক ও উচ্ছৃঙ্খল জনতা কর্তৃক অগ্নিসংযোগ (১৫৭টি), বজ্রপাত ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ (৪৮টি), বাজি পোড়ানো (৯৪টি), মাত্রাতিরিক্ত তাপ (১৬৫টি), মেশিনের মিসফায়ার (১৬০টি), স্বতঃস্ফূর্ত প্রজ্বালন (২৯টি) ইত্যাদি।

 ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি আগুন লেগেছে বাসাবাড়ি বা আবাসিক ভবনে। অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ৬ হাজার ৫৫৮। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৬৫ কোটি ১৮ লাখ ৫৫ হাজার ৩৭৫ টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে রান্নাঘরে। সংখ্যা ২ হাজার ২৮৭। আর্থিক ক্ষতি ২০ কোটি ১৪ লাখ ৯২ হাজার ৬২৬ টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বিভিন্ন দোকান ও টংয়ে। অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ২ হাজার ১১৪। আর্থিক ক্ষতি ২৭ কোটি ৫০ লাখ ৯১ হাজার ২৫৫ টাকা। ২০২২ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়) মোট ১৫৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আর্থিক ক্ষতি হয় ২ কোটি ৪৫ লাখ ২৯ হাজার ৫০০ টাকা। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে (মসজিদ-মন্দির-গির্জা ইত্যাদি) ১২১টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। আর্থিক ক্ষতি হয় ১০ লাখ টাকার কিছু বেশি।

উল্লিখিত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। প্রাণহানি হচ্ছে অসংখ্য মানুষের। তাই অগ্নিকাণ্ডের হার ক্রমাগত কমিয়ে আনা ছাড়া গত্যন্তর নেই। বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে নগর এলাকায়। ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে পুরান ঢাকা এলাকায়। এ দেশের নগরগুলো অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। বাসাবাড়ি ও আবাসিক ভবনগুলোয় যথেষ্ট অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নেই। আবার অনেক এলাকায়, বিশেষত পুরান ঢাকায় রাস্তাগুলো অনেক সরু। ভবনগুলোও একটি অন্যটির গা ঘেঁষা। খোলা জায়গা নেই বললেই চলে। ফলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়। এক ভবন থেকে সহজেই অন্য ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তাগুলো সংকীর্ণ হওয়ার কারণে ফায়ার সার্ভিস দ্রুত পৌঁছতে পারে না। বাংলাদেশে পর্যাপ্তসংখ্যক ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ও ফায়ারফাইটার আছে কিনা সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১১ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা শহরে প্রতি ৭ লাখ ৪২ হাজার ১৭০ অধিবাসীর জন্য মাত্র একটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন আছে। অথচ দিল্লিতে প্রতি ৩৩ হাজার ৬০০ অধিবাসীর জন্য একটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন আছে। ব্যাংককে প্রতি ১৬ হাজার ২৯০ অধিবাসীর জন্য একটি ও ওকলাহােমা সিটিতে প্রতি ১৪ হাজার ৯২৫ জন অধিবাসীর জন্য একটি করে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন আছে। আবার বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক ভবনেই কিংবা আবাসিক ভবনের পাশেই স্থাপিত হয়েছে রাসায়নিক কারখানা। এ থেকেও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। নিমতলী (২০১০ সাল) ও চকবাজারের (২০১৯ সাল) অগ্নিকাণ্ড তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

অপিরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নে যুক্ত হয়েছে সুষ্ঠু তদন্ত, বিচার ও জবাবদিহির অভাব। এছাড়া আছে নাগরিকদের অসচেতনতা। অতএব অগ্নিকাণ্ডজনিত দুর্ঘটনা কমাতে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি নাগরিক কাঠামোকে পুনর্বিন্যাস ও নাগরিকদের সচেতন করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

নিজাম আশ শামস: সাংবাদিক

আরও