আলোকপাত

পেশাজীবী সমিতিতে সয়লাব দেশ, সেবা তথৈবচ

সম্প্রতি ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালের একজন ইউরোলজিস্টের কাছে গিয়েছিলাম। রোগীর বেশ ভিড়, তার খুব ব্যস্ততাও দেখলাম। পরিচয় দিইনি, সাধারণত দিই না। কিন্তু কেন জানি তিনি আমাকে বেশ সময় দিলেন।

সম্প্রতি ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালের একজন ইউরোলজিস্টের কাছে গিয়েছিলাম। রোগীর বেশ ভিড়, তার খুব ব্যস্ততাও দেখলাম। পরিচয় দিইনি, সাধারণত দিই না। কিন্তু কেন জানি তিনি আমাকে বেশ সময় দিলেন। এক পর্যায়ে তিনি তার একটা অভিজ্ঞতার কথা বললেন। তিনি কোনো এক পর্যায়ে প্রায় পাঁচ বছর ইংল্যান্ডে ছিলেন। তিনি সেখানে চিকিৎসকদের পেশাগত কোনো সংগঠন বা সমিতি দেখতে পাননি। অথচ বাংলাদেশে চিকিৎসকদের রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে বেশ কয়েকটি সংগঠন রয়েছে। এগুলোর দাপটে সব চিকিৎসকের প্রতিনিধিত্বকারী যে সংগঠন অর্থাৎ বিএমএ সেটি কার্যত নিষ্ক্রিয়, অচল। নেতৃত্ব প্রদানকারী চিকিৎসকরা রাজনৈতিক বিভাজনে বিভক্ত এবং স্বীয় মতাবলম্বী ডাক্তারদের নিয়ে ব্যস্ত। এতে চিকিৎসাসেবা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ এবং আইএলওর ১৯৪৮ সালের সংগঠনের স্বাধীনতা এবং কনভেনশন সংগঠিত করার অধিকারসংক্রান্ত ৮৭ নম্বর সনদ অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকের সংগঠন করার অধিকার স্বীকৃত। বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬-এর ১৭৬ ধারায় শ্রমিক ও মালিককে ট্রেড ইউনিয়ন বা সমিতি বা ফেডারেশন গঠন করার এবং তাতে যোগ দেয়ার অধিকার দেয়া হয়েছে। এছাড়া সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ২০ অনুযায়ী প্রত্যেকের‌ই শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশগ্রহণ ও সমিতি গঠনের স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে এবং কা‌উকে কোনো সংঘভুক্ত হতে বাধ্য করা যাবে না মর্মে উল্লেখ রয়েছে।

আমাদের দেশের কোনো কোনো বিশেষায়িত ক্ষেত্রে শুরুতে সংগঠন করার অধিকার সীমিত বা না থাকার কারণে বহু ধরনের চাপের কাহিনী কারো অজানা নয়। কথা বলার অধিকার, সংগঠন করার বা সমাবেশ করার অধিকার গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার সন্দেহ নেই। গণতন্ত্রের চর্চায় সুশাসনের স্বার্থে এসব সংগঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি যেকোনো দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী উপাদান, যা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত পেশাজীবীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ, মতামতকে সমাজে তুলে ধরে এবং সরকার ও সংশ্লিষ্ট সামাজিক শক্তির জবাবদিহিতা ও সুবিচার নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। এসব সংগঠনের উদ্দেশ্য সব কর্মচারীর কল্যাণে কাজ করা, কাজের পরিবেশ উন্নত রাখা, সেবাপ্রার্থীরা যাতে কাঙ্ক্ষিত সেবা যথাসময়ে পান সে লক্ষ্যে কাজ করা। তবে বাস্তবে এ দেশে এসব সংগঠন করার উদ্দেশ্য কী এবং এর ফলে ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রে তার কী প্রভাব পড়ে তা বিচার-বিশ্লেষণের দরকার রয়েছে।

এ দেশে ছোট-বড় রাজনৈতিক দলের সংখ্যা প্রচুর। এসব দলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক, পেশাভিত্তিক, বয়সভিত্তিক, এলাকাভিত্তিক অঙ্গ সংগঠনের সংখ্যা হিসাব করলে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। অন্যদিকে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, আমলা, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ প্রত্যেক পেশাজীবীর এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলভিত্তিক বা নিরপেক্ষ সংগঠন রয়েছে।

বাংলাদেশে অধিকাংশ পেশাজীবী সংগঠন/সমিতি কাগজে-কলমে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক হলেও বাস্তবে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের মতো দলীয় বা অনুগত পেশাজীবীদের স্বার্থে কাজ করে, সব পেশাজীবীর জন্য করে না। লেজুড়ভিত্তিক পেশাজীবীদের মধ্যে কখনো কখনো জন্ম নেয় অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। পেশাজীবী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বকীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। অধিকাংশ পেশাজীবী পেশার প্রতি বিশ্বস্ত ও নিষ্ঠাবান থাকছে না, যার ফলে সৃষ্টি হয় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি।

কত সংখ্যক পেশাজীবী সংগঠন আছে এ দেশে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। এ-সংক্রান্ত কোনো জরিপ বা সার্ভে করা হয়েছে বলে জানা নেই। সহজেই অনুমেয় পরিসংখ্যান নেয়ার বা জরিপ করার প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেননি। অন্যদিকে নিবন্ধনহীন এবং অনানুষ্ঠানিক প্রচুর সমিতি/সংগঠন রয়েছে, যার তথ্য কোথাও পাওয়ার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দলের মতো সমিতির সদস্যদের মধ্যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে বা তুচ্ছ কোনো কারণে মতপার্থক্য হলেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

সংগঠনের সংখ্যা সম্পর্কে দু-একটা উদাহরণ দেয়া যায়। সিভিল সার্ভিসে প্রতিটি ক্যাডারের জন্য একটি করে সমিতি অর্থাৎ ২৬টি মূল সমিতি রয়েছে। আবার প্রায় প্রতিটি ক্যাডারের ব্যাচভিত্তিক ফোরাম বা সমিতি রয়েছে, রয়েছে জেন্ডারভিত্তিক সমিতি। সমিতি আছে শ্রেণী/গ্রেডভিত্তিক, যেমন ডিপ্লোমা, স্নাতকভিত্তিক ইত্যাদি। তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের প্রচুর সমিতি রয়েছে। আছে পদনাম বা কৃত্যভিত্তিক সমিতি যেমন সাঁটলিপিকার সমিতি, মুদ্রাক্ষরিক সমিতি, চালক সমিতি, অফিস সহায়ক সমিতি বা গার্ড সমিতি ইত্যাদি। সব সমিতির রয়েছে কেন্দ্রীয়, অঞ্চল বা মাঠ পর্যায়ে শাখা-প্রশাখা। তদ্রুপ রাজনীতি থেকে শুরু করে শিক্ষা, সংস্কৃতি, এক কথায় সর্বত্র শুধু সমিতি আর সমিতি।

বৃহত্তর কৃষিসংশ্লিষ্ট সমিতির কথা ধরা যাক। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি, বাংলাদেশ সোসাইটি অব এগ্রোনমি, বাংলাদেশ সোসাইটি ফর হর্টিকালচারাল সায়েন্স, বাংলাদেশ ভেটেরিনারি সমিতি, বাংলাদেশ কৃষি প্রকৌশলী সমিতি, ফিশারিজ সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পশুপালন সমিতি ইত্যাদির ন্যায় রয়েছে এক ডজনের মতো কেন্দ্রীয় সংগঠন এবং সেগুলোর রয়েছে মাঠ পর্যায়ের অর্থাৎ বিভাগ, জেলা পর্যায়ে শাখা-প্রশাখা। আবার কৃষি খাতে ডিপ্লোমা সমিতিও রয়েছে প্রায় প্রতিটি ডিসিপ্লিনের। একটি করপোরেশনের কথা বলি, সেখানে কর্মকর্তাদের রয়েছে কৃষিবিদ সমিতি, প্রকৌশলী সমিতি, কৃষি প্রকৌশলী সমিতি, ডিপ্লোমা কৃষিবিদ সমিতি, ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতি, বেশ কয়েকটি বৃহত্তর জেলা সমিতি, জেলা সমিতি। অন্যদিকে কর্মচারীদের বিভিন্ন ইউনিয়ন/সমিতি ছাড়াও গ্রেড বা পদনামভিত্তিক বেশকিছু সমিতি রয়েছে। প্রতিষ্ঠানপ্রধান খুব ভাগ্যবান, নববর্ষে বা ঈদে নিজ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে প্রায় অর্ধশত শুভেচ্ছাকার্ড পান তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ভিত্তিক এবং বর্ষভিত্তিক, শিক্ষা বোর্ডের জাতীয় পরীক্ষার বর্ষভিত্তিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বর্ষভিত্তিক অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। শতবর্ষের পুরনো অনেক শিক্ষা-ব্যাচের সমিতি সাম্প্রতিক সময়ে গঠন করা হয়েছে। মজার বিষয়, সকাল-বিকালে ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি করতে গিয়েও বেশকিছু সমিতি/সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে সংগঠন সমিতিতে পরিপূর্ণ এক দেশ। বিশ্বের কোনো দেশে এত সংখ্যক, এত ধরনের সমিতি/সংগঠন আছে বলে জানা নেই। কেন এত সংগঠন এ দেশে তার উত্তর পাওয়া দুষ্কর। জানামতে, এ বিষয়টি কোনো দিন কোনো পর্যায়ে আলোচনা বা গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে বিবেচিত হয়নি। উপনিবেশের শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘদিনের সংগ্রাম আন্দোলন, ব্যক্তি/গোষ্ঠী স্বার্থরক্ষা, এককেন্দ্রিকতার বিকাশ, ঘনবসতি আর সীমিত সম্পদের অসম বণ্টন, সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশের অনুপস্থিতি এবং সুশাসনের অভাব প্রভৃতি কারণগুলো প্রাথমিকভাবে বিবেচনা করা যায়।

এ কথা সত্য যে অন্যায়, অনিয়ম, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা ও একনায়কত্ব প্রতিরোধকল্পে, প্রতিষ্ঠানের ভিশন মিশন অর্জনকল্পে কিংবা ন্যায়ভিত্তিক ও যুক্তিসংগত দাবি আদায়কল্পে নিয়মতান্ত্রিক পেশাজীবী সংগঠনের বিকল্প নেই, তবে রাজনৈতিক, ক্ষমতাধর, প্রভাবশালীদের লেজুড়বৃত্তির কারণে মূল লক্ষ্য ও আদর্শ থেকে কক্ষচ্যুত হয়ে সংগঠন-সংস্কৃতি এখন বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন। এসব সমিতি/সংগঠনের কিছু কার্যক্রম সমিতির সদস্য, সেবাপ্রত্যাশী, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এমনকি কখনো কখনো খোদ সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। শ্রমিক-কর্মচারীদের তথা পেশাজীবীদের যৌক্তিক স্বার্থরক্ষা করার মধ্যে তাদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো প্রশ্ন উঠত না।

আর এত এত সংগঠনের অস্তিত্বের ফলে প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারীকেই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় প্রচুর সমিতি/সংগঠনের সদস্য হতে হয়। সংগঠনের নেতাদের বা সাধারণ সদস্যকে শুধু আর্থিক সহায়তা/চাঁদা নয়, মিটিং-মিছিলসহ অন্যান্য কাজে প্রচুর সময় দিতে হয়। এসব সমিতি সংগঠন পরিচালনার জন্য প্রচুর অর্থ আর লজিস্টিক সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন হয়। সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে এত সব সংগঠনকে সন্তুষ্ট রাখতে হয়, সামাল দিতে হয়। সমিতিগুলো নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে এত এত সাংগঠনিক কর্মযজ্ঞের ভিড়ে সেবাপ্রত্যাশীদের সেবা দেয়ার বা সেবার মান উন্নত করার ফুরসুত থাকবে কোথায় পেশাজীবীদের?

সিকদার আনোয়ার: অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও সাবেক রেক্টর, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন একাডেমি

আরও