বিশ্বের বাজারে প্রথম কোমল পানীয়ের আবির্ভাব ঘটে সপ্তদশ শতাব্দীতে। তখনকার সফট ড্রিংকস ছিল পানি, লেবু ও মধুর মিশ্রণ, যা প্রাকৃতিকভাবে মিষ্টি ও সতেজ ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোমল পানীয় তৈরির প্রক্রিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে এসব পানীয়তে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন কৃত্রিম ফ্লেভার, চিনি (প্রায় ১২ শতাংশ) এবং স্বাদের জন্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস। বেশির ভাগ সফট ড্রিংকসে এত পরিমাণ চিনি থাকে যা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক গ্রহণযোগ্য সীমার চেয়েও বেশি। অতিরিক্ত এই চিনি গ্রহণের ফলে শরীরে মেটাবলিক সিনড্রোম দেখা দিতে পারে। এটি একটি জটিল উপসর্গসমষ্টি, যেখানে উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে অতিরিক্ত চিনি, পেটের চর্বি ও কোলেস্টেরলের ভারসাম্যহীনতা একসঙ্গে দেখা দেয়। ফলে হৃদরোগ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। তবে এসব ক্ষতিকর দিক ছাড়াও বর্তমানে কোমল পানীয়তে ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিকেরও অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে।
খাদ্যশৃঙ্খলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রবেশ ও এর ক্ষতিকারক প্রভাব নিয়ে বহু গবেষণা ও প্রতিবেদন এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণত ৫ মিলিমিটার (৫,০০০ মাইক্রোমিটার) বা তার চেয়ে ছোট কণাগুলোকেই মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার এক ধরনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এবং এটি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে কোমল পানীয় বা সফট ড্রিংকস গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে, যা আধুনিক জীবনযাপনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরাঞ্চলে পার্টি, আড্ডা বা অফিসের বিরতিতে সফট ড্রিংকস সহজলভ্য ও জনপ্রিয় একটি পানীয় হিসেবে পরিচিত। তবে এ পানীয়ের জনপ্রিয়তার পাশাপাশি তা থেকে উদ্ভূত স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ও পরিবেশগত প্রভাবও রয়েছে। বাংলাদেশে কোমল পানির গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বাড়ছে, বিশেষত শহরাঞ্চলের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে। গবেষণা অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৭০ দশমিক ১২ শতাংশ পরিবার সফট ড্রিংকস ও জুসজাতীয় পানীয় গ্রহণ করে। একসময় এটি ছিল শুধু উচ্চবিত্তদের পানীয়, কিন্তু বর্তমানে গ্রামাঞ্চলেও এর চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশে একজন মানুষ গড়ে প্রতি বছরে প্রায় ১৭টি ২৫০ মিলিলিটার সাইজের সফট ড্রিংকস পান করে, যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানিতে এ সংখ্যা প্রায় ৪৫০ বোতল এবং মেক্সিকোতে তা ৬০০ বোতল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এই পরিসংখ্যান বিশ্বব্যাপী সফট ড্রিংকসের জনপ্রিয়তা ও ভোক্তা অভ্যাসের ভিন্নতা তুলে ধরে। বাংলাদেশের সফট ড্রিংকসের বাজার ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং ২০২৫ সালে এর উৎপাদন ও ব্যবহার প্রায় ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন লিটার পর্যন্ত পৌঁছবে। বিশ্বব্যাপী সফট ড্রিংকসের মোট বাজার ২০২৫ সালে ৩৩৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন লিটারে পৌঁছবে। যদিও বাংলাদেশের বাজার গ্লোবাল বাজারের তুলনায় ছোট, তবে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রবৃদ্ধির পেছনে নগরায়ণ, জীবনধারার পরিবর্তন এবং তরুণ জনগণের সফট ড্রিংকসের প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশে ৬ থেকে ১৭ বছর বয়সী স্কুলগামী শিশুদের নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৪৮ শতাংশ শিশু নিয়মিতভাবে সফট ড্রিংকস পান করছে এবং আশ্চর্যজনকভাবে এদের মধ্যে মেয়েদের হার ছেলেদের তুলনায় বেশি। গবেষণায় আরো দেখা যায়, যারা নিয়মিত কোমল পানীয় পান করে, তাদের মধ্যে স্থূলতার হার তুলনামূলকভাবে বেশি এবং একাডেমিক পারফরম্যান্সও অপেক্ষাকৃত দুর্বল। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কোমল পানীয়ের প্রতি আসক্ত, যদিও তারা এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন। তবে সাম্প্রতিক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোবায়োজিওকেমিস্ট্রি এবং পলিউশন কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে পরিচালিত একটি গবেষণায় এ কোমল পানীয়গুলোর মধ্যে বিপুল পরিমাণে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক কণিকা খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
সাধারণত পানীয় ও খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করে, যা ২০১৯ সালের এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক বিভিন্ন উপায়ে খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করতে পারে, যেমন জলজ প্রাণীর মাধ্যমে, খাদ্যের প্যাকেটজাতকরণ, পরিবহন ও সংরক্ষণের সময়, কিংবা খাদ্য তৈরির উপকরণ যেমন পানি, চিনি ও লবণের মাধ্যমে। বাংলাদেশে এখনো কার্বনেটেড কোমল পানীয়তে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ নিয়ে সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি গবেষণা ছাড়া অন্য কোনো গবেষণা হয়নি। তবে বিশ্বব্যাপী গবেষণায় পানীয়তে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়ার প্রমাণ মিলেছে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগজনক। গবেষণার শুরুতে বাংলাদেশে জনপ্রিয় ২১টি সফট ড্রিংকস ও এনার্জি ড্রিংকস নির্বাচন করা হয় এবং ১১টি ভিন্ন স্থানের দোকান থেকে এগুলো যথাযথ মেয়াদের তারিখ দেখে সংগ্রহ করা হয়। এসব পানীয় বিভিন্ন ধরনের বোতলে বাজারজাত করা হয়, যেমন পলিইথিলিন টেরেফথালেটের বোতল, অ্যালুমিনিয়াম ক্যান ও কাচের বোতল। গবেষণায় তিন ধরনের বোতলের নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, পলিইথিলিন টেরেফথালেটের বোতলের তুলনায় কাচের বোতলে থাকা পানীয়তে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি। সাধারণত প্লাস্টিকের বোতলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের মাত্রা বেশি হওয়ার ধারণা থাকলেও গবেষণায় ভিন্ন তথ্য উঠে আসে। প্রতি লিটার পানীয়তে প্লাস্টিক বোতলে ৯০টি, কাচের বোতলে ১৫০টিরও বেশি এবং ক্যানের বোতলে প্রায় ১৩৫টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া যায়। তুরস্কে প্রতি লিটারে দুটি, থাইল্যান্ডে ১৮টি, স্পেনে ১৭টি, দক্ষিণ আফ্রিকায় নয়টি, মেক্সিকোতে ২৮টি, ইরানে চারটি, হংকংয়ে ৪৯টি এবং জার্মানিতে ১১টি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এর তুলনায় বাংলাদেশে কার্বনেটেড কোমল পানীয়তে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ অনেক বেশি। এই বেশি পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রাথমিক উৎস হতে পারে প্যাকেজিং পণ্য এবং উৎপাদনে ব্যবহৃত উপাদান। এছাড়া প্লাস্টিকের বোতল থেকেও মাইক্রোপ্লাস্টিক নিঃসৃত হতে পারে। গ্লাসের বোতলে প্লাস্টিকের বোতল থেকে বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়ার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে বোতলগুলো একাধিকবার ব্যবহার করা। বহির্বিশ্বের অন্যান্য গবেষণা ফলাফল থেকে জানা গেছে, ড্রিংকস প্রস্তুতকালে ব্যবহৃত উপাদান যেমন পানি, চিনি ও লবণ মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের অন্যতম কারণ হতে পারে। দূষিত পরিবেশ থেকে পানি ব্যবহার করা এটির একটি প্রধান কারণ হতে পারে। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রাপ্ত মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণের সঙ্গে ব্যবহৃত চিনির একটি পারস্পরিক সম্পর্কও পাওয়া গেছে, যা চিনির উৎস থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।
মানুষের শরীরে ১৩০ মাইক্রোমিটারের ছোট ব্যাসের মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হতে পারে, যা প্লাস্টিকের গুণমান বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হতো। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক কিডনি রোগীদের রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। বাতাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করা মাইক্রোপ্লাস্টিক অতিরিক্ত ধুলা, অক্সিডেটিভ চাপ এবং কোষের ক্ষতির কারণ হতে পারে। টেক্সটাইল শ্রমিকদের ফুসফুসে ক্ষত এবং বাহ্যিক কণার উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা সম্ভবত কাপড়ের ধুলা থেকে এসেছে। ফুসফুসের ক্যান্সার রোগীদের টিস্যুতেও প্লাস্টিক ও তন্তুজাতীয় কণা শনাক্ত হয়েছে। এক গবেষণায় মানব প্রস্রাব ও কিডনির টিস্যুতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে, যা সম্ভবত পানির মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করেছে। এছাড়া পানীয় গ্রহণ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পাওয়া গেছে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ ও পুনরুজ্জীবিত গ্রহণ করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে বর্জ্য ও দূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব। সফট ড্রিংকসের ক্ষেত্রে এটি প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানির সংরক্ষণ এবং টেকসই উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেয়। সফট ড্রিংকসের বোতল সাধারণত পলিইথিলিন টেরিফথ্যালেট (PET) দিয়ে তৈরি, যা পুনর্ব্যবহারযোগ্য হলেও বিশ্বব্যাপী বর্জ্য সমস্যা তৈরি করছে। বর্তমানে অনেক বড় কোম্পানি, যেমন কোকা-কোলা ও পেপসি, Closed-loop bottle policy অনুসরণ করছে, যার মাধ্যমে ব্যবহৃত বোতল পুনর্ব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হয়। এতে ১০০% পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক (rPET) ব্যবহারের মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণ হ্রাসের চেষ্টা করা হচ্ছে। পানীয় উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের মান নিয়ন্ত্রণ, পানির পরিশোধন প্রক্রিয়া উন্নত করা, প্লাস্টিক বোতলের পরিবর্তে নিরাপদ বিকল্প ব্যবহারের প্রচলন, পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং গ্রহণ, গবেষণা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা উন্নত করা। কোমল পানীয়ের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে তরুণ সমাজকে প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর পানীয়ের দিকে উৎসাহিত করা জরুরি। লেবু পানি, ডাবের পানি কিংবা ঘরোয়াভাবে তৈরি তাজা ফলের রস—এসব সহজলভ্য, সাশ্রয়ী ও পুষ্টিকর বিকল্প হতে পারে সফট ড্রিংকসের। আমাদের খাদ্যাভ্যাসে এসব পানীয়ের স্থান করে দিতে পারলে কোমল পানীয়র ওপর নির্ভরশীলতা অনেকাংশেই কমে যাবে।
বাংলাদেশে সফট ড্রিংকসের বাজার ক্রমেই বাড়লেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পুনর্ব্যবহারের কার্যকর ব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। পুনর্ব্যবহারযোগ্য বোতল সংগ্রহের যথাযথ নীতি না থাকা, রিসাইক্লিং প্লান্ট ও প্রযুক্তির অভাব এবং ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। তবে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো, বিকল্প উপকরণ (যেমন বায়োপ্লাস্টিক) ব্যবহারের প্রচলন এবং কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কার্যক্রমের মাধ্যমে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব। সফট ড্রিংকস শিল্পে সার্কুলার ইকোনমি বাস্তবায়ন করা হলে এটি শুধু পরিবেশের জন্যই নয়, বরং অর্থনীতির জন্যও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাস, পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণের ব্যবহার এবং ভোক্তা সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা সফট ড্রিংকস শিল্পকে আরো টেকসই করতে পারি। এজন্য সরকার, উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ও ভোক্তা—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে পরিবেশবান্ধব ও দায়িত্বশীল শিল্প ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যায়। পাশাপাশি, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আরো কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও সরকারিভাবে প্লাস্টিক ব্যবহারের বিকল্প প্রচলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। বিশ্বব্যাপী গবেষণার ফলাফল পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের সমস্যা নয়, বরং এটি বৈশ্বিক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। এটির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থেকে বাঁচতে সরকার, গবেষক ও ভোক্তাদের সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ নিশ্চিত করতে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে আমাদের এখনই পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
আজকের বাজারে কোমল পানীয়ের বিজ্ঞাপনগুলোকে এতটাই লোভনীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয় যে এর ক্ষতিকর দিকগুলো সহজেই আড়ালে পড়ে যায়। আকর্ষণীয় প্যাকেজিং, জনপ্রিয় তারকাদের ব্যবহার এবং নানা উৎসব-অনুষ্ঠানে সফট ড্রিংকসের জোরালো উপস্থিতি—সব মিলিয়ে এটি তরুণ প্রজন্মের কাছে একধরনের ‘লাইফস্টাইল সিম্বল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু এই চকচকে বাইরের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে ভয়ংকর স্বাস্থ্যঝুঁকি, যার প্রমাণ আমরা আমাদের গবেষণায় স্পষ্টভাবে পেয়েছি। এ বাস্তবতা সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরতে এখনই সময় সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালানোর। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক সচেতনতা কর্মসূচির মাধ্যমে কোমল পানীয় সম্পর্কে মানুষকে জানানো এবং তাদের বিকল্প পুষ্টিকর পানীয় বেছে নিতে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
এছাড়া ভবিষ্যতে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ এবং কোমল পানীয়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে আরো গভীর ও বিস্তৃত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাদ্য ও পানীয় পণ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নির্ণয় এবং এর দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য প্রভাব পর্যবেক্ষণের জন্য একটি নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা কাঠামো তৈরি করা জরুরি। আমরা যদি এখনই এ বিষয়ে সচেতন না হই, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবেশ দুটোই ভয়ংকর বিপদের মুখে পড়তে পারে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ ও সফট ড্রিংকসের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটি (বিএফএসএ) এবং বিএসটিআই (বিএসটিআই) সফট ড্রিংকসে ব্যবহৃত উপকরণ ও মান নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, যেখানে তারা সফট ড্রিংকসের লেবেলে ক্ষতিকর উপাদান সম্পর্কে সতর্কতা চিহ্ন সংযোজন বাধ্যতামূলক করতে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই) প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাস ও পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে উৎপাদন ও প্যাকেজিং ব্যবস্থার ওপর নজরদারি করতে পারে। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে পারে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্কুল ও কলেজে স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষা কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। স্থানীয় সরকার বিভাগ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনতে পারে, যেখানে পরিবেশবান্ধব এনজিও ও সিএসআর কার্যক্রম সমন্বয় করে মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। একই সঙ্গে লেবু পানি, ডাবের পানি, ফলের ঘরোয়া জুস ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিকল্প পানীয় উৎপাদন ও সরবরাহ সহজলভ্য করতে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা প্রদান করা প্রয়োজন। এসএমই ফাউন্ডেশন এবং বিএসসিআইসি-এর সহযোগিতায় ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের এ খাতে উৎসাহিত করা যেতে পারে। সর্বোপরি সরকার, উৎপাদক, গবেষক ও সাধারণ জনগণকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে, যাতে স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প নিশ্চিত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ পথ তৈরি করা সম্ভব হয়।
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক: অধ্যাপক, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ফেলো, রয়্যাল কেমিক্যাল সোসাইটি