আলোকপাত

বিইআরসি আইন সংশোধনে জনস্বার্থ বিপন্ন

বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন সংশোধন করে বিশেষ সময়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ ক্ষমতা নিজেদের দখলে নিয়ে নিজের ক্ষমতা সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। অবশ্য আইন লঙ্ঘন করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ অনেক আগে থেকেই অবৈধভাবে তরল জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করে আসছে। এখন আর অবৈধ

বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন সংশোধন করে বিশেষ সময়ে বিদ্যুৎ গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ ক্ষমতা নিজেদের দখলে নিয়ে নিজের ক্ষমতা সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। অবশ্য আইন লঙ্ঘন করে জ্বালানি খনিজ সম্পদ বিভাগ অনেক আগে থেকেই অবৈধভাবে তরল জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করে আসছে। এখন আর অবৈধ বলা যাবে না। এতে কার লাভ কার ক্ষতি হলো তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। তবে তরল জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের একক ক্ষমতা বিইআরসি আইন অনুযায়ী বিইআরসির। ক্ষমতা কার্যকর করার লক্ষ্যে ক্যাব যে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, তাতে ভাটা পড়বে। কিন্তু তরল জ্বালানি সরবরাহে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় মুনাফা প্রতিরোধ কার্যক্রম থেকে ক্যাব সরে আসবে না, বিইআরসি আইনের ওই সংশোধন বাতিলের দাবি থেকেও ক্যাব পিছপা হবে না।

দুই.

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩-এর ৩৪-এর ধারা সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। আইনের মূল সংশোধনে বলা হয়েছে, আইনের অন্যান্য বিধানে যা কিছু থাকুক না কেন, বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার প্রজ্ঞাপন দিয়ে ভর্তুকি সমন্বয়ের জন্য জনস্বার্থে কৃষি, শিল্প, সার, ব্যবসা-বাণিজ্য গৃহস্থালি কাজের চাহিদা অনুযায়ী এনার্জির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে এসবের উৎপাদন, এনার্জি সঞ্চালন, মজুদকরণ, বিপণন, সরবরাহ, বিতরণ এবং ভোক্তা ট্যারিফ নির্ধারণ, পুনর্নির্ধারণ বা সমন্বয় করতে পারবে।

তিন.

বিইআরসি আইন লঙ্ঘন করে জ্বালানি তেলের ট্যারিফ বা মূল্যহার সরকার তথা জ্বালানি খনিজ সম্পদ বিভাগ বরাবরই প্রজ্ঞাপন দিয়ে নির্ধারণ করে আসছে। বিইআরসি আইন অনুযায়ী বিইআরসি কেবল গ্যাস সঞ্চালন বিতরণ মূল্যহার এবং ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের খুচরা এবং বিদ্যুতের পাইকারি খুচরা মূল্যহার নির্ধারণ করে। পিডিবির মালিকানাধীন প্লান্টগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণ করত বিইআরসি। অন্যসব সরকারি বেসরকারি কোম্পানির প্লান্টগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণের এখতিয়ার বিইআরসির নয়। তবে বিদ্যুৎ সঞ্চালন বিতরণ মূল্যহার নির্ধারণ করত বিইআরসি। এসব সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করে বহু বছর আমরা বিইআরসি আইন সংস্কারের কথা বলে আসছি, কিন্তু সরকার তা আমলে নেয়নি। আমরা বিশেষভাবে বলেছি, বিদ্যুৎ এবং কয়লা অনিঃশেষযোগ্য জ্বালানিসহ সরকারি-বেসরকারি খাত নির্বিশেষে সব জ্বালানি সরবরাহের পর্যায়ে ব্যয় মূল্যহার নির্ধারণের একক এখতিয়ার বিইআরসির কাছে থাকতে হবে। না হলে সঠিক মূল্যহারে বিদ্যুৎ জ্বালানি ক্রয়ে ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত হবে না। গণশুনানি হওয়ায় বিদ্যুৎ গ্যাসের মূল্যহার নির্ধারণে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল। তাতে তারা বুঝতে পারত ব্যবসায়ীর মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাব ন্যায্য যৌক্তিক কিনা। আইন সংশোধনে সেই সুযোগ রহিত হলো।

চার.

গণশুনানির কারণে কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা জবাবদিহি নিশ্চিত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কোম্পানিগুলোও যেনতেন হিসাব উপস্থাপন করে মূল্যহার বাড়ানোর ব্যাপারে কঠিন চ্যালেঞ্জর সম্মুখীন হয়। তবে জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে ভোক্তারা সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকেন। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে থাকে না। কারণ গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ হয়। গণশুনানি ছাড়া দাম নির্ধারণ হলে সংস্থা কোম্পানিগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা বাড়ে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে (বিপিসি) তার আওতাধীন কোম্পানিই দৃষ্টান্ত।

পাঁচ.

বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধির প্রক্রিয়া গণশুনানির মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়ায় সরকারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। শুনানিতে প্রকাশ পায় অন্যায়, অযৌক্তিক তথা লুণ্ঠনমূলক ব্যয় মুনাফা কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকা সমন্বয় না হলে বিদ্যুতে আর্থিক ঘাটতি থাকে না। দাম বৃদ্ধি হয় না। ভর্তুকি লাগে না। একই প্রক্রিয়ায় জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ না হওয়ায় জ্বালানি তেল সরবরাহ ব্যয়ে কী পরিমাণ লুণ্ঠনমূলক ব্যয় সমন্বয় হয় এবং আর্থিক ঘাটতি বাড়ে এবং তা সমন্বয়ে জ্বালানি তেলের মূল্যহার বৃদ্ধি হয়, তা প্রকাশ পায়নি। তাতেও সরকারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। চাপ মোকাবেলায় আইন সংশোধন করে গণশুনানি রদ করা জনগণের কণ্ঠ রোধের শামিল।

ছয়.

নির্ধারিত মূল্যহার তখনই ন্যায্য যৌক্তিক হয়, যখন মূল্যহার নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান স্বাধীন নিরপেক্ষ হয়। বিদ্যুৎ জ্বালানি বাণিজ্যিক পণ্য। বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে ব্যবসায়ী সরকারি, বেসরকারি যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি/সংস্থাগুলো। ওইসব কোম্পানি/সংস্থাগুলোর পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান পরিচালক বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্য কর্মকর্তারা। বিপিসি নিজে তরল জ্বালানি ব্যবসায়ী তথা বিইআরসির লাইসেন্সি। তা সত্ত্বেও ফার্নেস অয়েলের মূল্য বিপিসিই নির্ধারণ করে। ওইসব কোম্পানির প্লান্টগুলোয় উৎপাদিত বিদ্যুৎ ক্রয় এবং জ্বালানি তেলের ক্রয়-বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়। সেখানে সিস্টেম লসের নামে তেল চুরি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেল কয়লা ব্যবহার বেশি দেখানো হয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে। তা দেখার কেউ নেই।

সাত.

আমদানি বাজারে যখন জ্বালানির দর কমে, তখন খুচরা মূল্যহারে তা সমন্বয় না করায় লুণ্ঠনমূলক মুনাফা বাড়ে। আবার দর বৃদ্ধি হলে আর্থিক ঘাটতি ভর্তুকি বা মুনাফার অর্থে সমন্বয় না করে খুচরা মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। মূল্যহার নির্ধারণে এমন প্রক্রিয়া বিইআরসি আইনের পরিপন্থী। মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া সংশোধিত আইনের সঙ্গেও সামঞ্জস্যহীন। জ্বালানি বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সরকারের রাজস্ব আহরণের নীতি ভ্রান্ত। জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়লে বিশ্বের সব দেশ জ্বালানি থেকে প্রাপ্য রাজস্বের হার কমানো হয়, কিন্তু বাংলাদেশে তা হয় না বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়ে। বোঝা জনগণের কাঁধে চাপে।

আট.

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩-এর আওতায় প্রতিষ্ঠিত হলেও ২০০৭ সালে থেকে এর কার্যক্রম শুরু হয়। সেখানে মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে পক্ষগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। তবে গণশুনানিতে যা যা যৌক্তিক বলে প্রমাণিত হয় বিইআরসির আদেশে তা প্রতিফলিত হয় না। আদেশে কোম্পানি/সংস্থাগুলোর স্বার্থই সুরক্ষা পায়। তার পরও গণশুনানির কারণে ন্যায্য যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়ে, রেগুলেটরি কালচারে জাতি সমৃদ্ধ হয়। জাতির প্রগতিশীল চরিত্রের বিকাশ ঘটে। আইনি ক্ষমতা প্রয়োগে রেগুলেটরি প্রশাসনিক সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বিইআরসি আইন সংশোধন করায় সেসব অগ্রগতি ধ্বংস করা হলো।

নয়.

সরকার যেখানে নিজেই ব্যবসায়ী, সেখানে তার পণ্য বা সেবার মূল্যহার সে নিজে কখনই নির্ধারণ করতে পারে না। আইন করে সে ক্ষমতা দখলেও তা বৈধ হয় না। একটি গণতান্ত্রিক দেশের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো স্বচ্ছতা জবাবদিহি নিশ্চিত করা। তা রোধ কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনে না। এটিই প্রকৃতির অপ্রতিরোধ্য বিধান।

দশ.

বাংলাদেশে রেগুলেটরি সংস্কৃতি চর্চা ছিল না বললেই চলে। বিইআরসির মাধ্যমে কিছুটা হলেও সে চর্চা শুরু হয়েছিল। আইন সংশোধনে তা বিলুপ্ত হলো, কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল, আইন সংশোধনে কেন অতিমাত্রায় তাড়াহুড়া করা হলো। সংশোধন বিল সংসদে আনা হলো না। অধ্যাদেশ জারি করে বিইআরসি আইন সংশোধন করা হলো। সংশোধন অসাধু ব্যবসাকে সুরক্ষা দেবে। তাই মানুষ সংশোধনকে জনস্বার্থবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক বলে।

এগারো.

সারা বিশ্বেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে এসব সংস্থা অকার্যকর করা হচ্ছে। এর কারণ দ্বিমুখী: () সরকারি কোম্পানি স্বশাসিত সংস্থায় অতিমাত্রায় নিজ নিজ প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের খবরদারি বৃদ্ধি। সেসব কোম্পানি সংস্থার পরিচালনা বোর্ডে পদাধিকারবলে মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্য কর্মকর্তা কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান পরিচালক। সরকার একদিকে পলিসি রেগুলেটর, অন্যদিকে ব্যবসায়ী হিসেবে বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের ওইসব কোম্পানি সংস্থার মাধ্যমে সর্বোচ্চ রাজস্ব এবং মুনাফা আহরণকারী। ব্যবসায়ী হওয়ায় সরকার রেগুলেটর হিসেবে স্বার্থসংঘাত যুক্ত এবং অকার্যকর। () স্বার্থসংঘাতই বিইআরসিকে অকার্যকর করেছে এবং ক্ষমতা সুরক্ষা নিশ্চিত করার নামে সরকারি কোম্পানি স্বশাসিত সংস্থায় মন্ত্রণালয়ের অবাধ খবরদারি প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সরকার বিইআরসি আইন সংশোধন করে মাঠ পর্যায়ের রেগুলেটরি ক্ষমতা দখলে নিয়ে পুরো রেগুলেটরি ব্যবস্থাকে অকার্যকর করেছে।

বারো.

বিইআরসি আইন সংশোধন এবং দ্রুত বিদ্যুৎ জ্বালানি সরবরাহ আইন বিদ্যুৎ জ্বালানি খাত উন্নয়নে সরকারের সব অর্জন এবং সাফল্যকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। বিইআরসি আইন সংশোধনের চেষ্টা শুরু হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সাল থেকে। কিন্তু সে-চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বর্তমান সরকারের আমলে তা সফল হলো। সফলতায় সরকার উন্নয়ন উভয়ই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। 

তেরো.

সংশোধনের কারণ হিসেবে বলা হয়, বিদ্যুৎ জ্বালানির মূল্যহার দ্রুত পরিবর্তন প্রয়োজন। পরিবর্তনে বিইআরসির সময় লাগে ৯০ দিন। তাই আইন পরিবর্তন করে মূল্যহার পরিবর্তনের ক্ষমতা সরকারকে নিজের হাতে নিতে হয়েছে। তথ্য যুক্তি কোনোটি সঠিক নয়। বিভ্রান্তিকর। লোডশেডিংমুক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের শর্তে শতাংশ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ধরে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার নির্ধারণের সব আনুষ্ঠানিকতা বিইআরসি শুনানি পরবর্তী এক মাসের মধ্যে শেষ করে। এরই মধ্যে প্রচণ্ড লোডশেডিং শুরু হয়। এমন অবস্থায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আদেশ ঠেকিয়ে রাখা হয়। আইন রক্ষার্থে ৯০ দিনের মাথায় অযৌক্তিক অগ্রহণযোগ্য অজুহাত দেখিয়ে মূল্য অপরিবর্তন রেখে বিইআরসি আদেশ দেয়। যদি ঘটনা হয়, তাহলে মূল্য পরিবর্তনে বিইআরসির সময় লাগে ৯০ দিন, এমন কথা বলা প্রতারণা/অসদাচরণের শামিল।

অতএব আমরা আশা করি, সরকার অচিরেই জনস্বার্থবিরোধী উল্লিখিত সংশোধন বাতিল/প্রত্যাহার করবে এবং নিজেকে স্বার্থসংঘাত মুক্ত করার তাগিদে বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের কোম্পানি এবং সংস্থাগুলোর পরিচালনা বোর্ড থেকে মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তাকে সরিয়ে নেবে। তাতে সরকারের ক্ষমতা নয়, রাষ্ট্রের দর্শন দায় সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। সেটিই মানুষ চায়। কারোই চাওয়া না বুঝতে পারার কোনো কারণ নেই।

. এম শামসুল আলম: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

আরও