বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে কাজ করছেন। একাধারে তিনি শ্রমিক নেতা, লেখক ও শ্রম খাতের বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য। শ্রম আইন, শ্রমিক অধিকার, গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতি এবং শ্রম সংস্কার কমিশন নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবিএস ফরহাদ
শ্রম খাতের অন্যতম একটি অংশ গৃহকর্ম বা কেয়ার ওয়ার্ক। এ কাজে নিয়োজিত গৃহকর্মীদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাষ্ট্রের উদাসীনতার কারণ কী?
শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশের শ্রমশক্তির পরিমাণ ৭ কোটি ৩৭ লাখ। এ শ্রমশক্তি বিভক্ত হয়ে আছে ৪০৫ ধরনের কাজে। সেখানে সরকার মজুরি বোর্ড গঠন করেছে ৪৬টি খাতে। বাকিগুলো সরকারি হিসাবে নেই। অর্থাৎ তারা কাজে আছে কিন্তু স্বীকৃতিতে নেই। রাষ্ট্র প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমজীবীদের নিয়ে চিন্তা করে। এর পরিমাণ শ্রমশক্তির মাত্র ১৫ শতাংশ। বাকি ৮৫ শতাংশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। আরেকটি বিষয় হচ্ছে সমাজে যে কাজগুলো সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেখানে অপমানও বেশি। যেমন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও গৃহকর্মীরা সমাজে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। আমরা শ্রমিকদের উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করি। সমাজের একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় হচ্ছে যে শ্রমিকের ঘামে সমাজটা টিকে আছে, তাকে পায়ের নিচে রাখার প্রবণতা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশের শ্রমশক্তির বড় একটি অংশ গৃহকর্মে যুক্ত আছে। এর পরিমাণ ২০ থেকে প্রায় ৪০ লাখ। এ গৃহকর্মীরা দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহকে সচল রাখে। সরকারকে ৩ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট হিসেবে দেয়। অন্যদিকে গৃহকর্মীদের নীরব ভূমিকা অন্যদের সরব থাকতে সহযোগিতা করে। এখানে কাজ করছে শ্রম সংস্কার কমিশন। তাদের সমাজের স্বীকৃতির জায়গায় নিয়ে আসতে চাই। সংস্কার কমিশন মনে করে এখানে সমাজের অবজ্ঞা, রাষ্ট্রের অবহেলা ও গৃহকর্মীদের সংগঠিত হওয়ার দুর্বলতা আছে। অবজ্ঞা, উদাসীনতা ও দুর্বলতা খাতটিকে জটিল করে রেখেছে। সমাজের একজন মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তাদের কাজের মর্যাদা, মজুরির নিশ্চয়তা, কর্মকালীন সুরক্ষা এবং অবসরে বাকি জীবনের নিশ্চয়তা এসব বিষয় কমিশনের সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছি আমরা।
এ কর্মে নিয়োজিতদের জন্য গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ কতটুকু কার্যকর হয়েছে এবং রাষ্ট্র এখানে কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
আমাদের গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা হয়েছে। নীতিমালা একটি সদিচ্ছা। নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে আইন তৈরি হয়। আইন প্রয়োগে বিধিমালার প্রয়োজন। নীতিমালা, আইন ও বিধিমালার সমন্বয়ে আইন কার্যকর হয়। দেশে রাষ্ট্র নীতিমালা করেছে, আইন করেনি। যার কারণে বোঝা যাচ্ছে রাষ্ট্র দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে না। সমাজ দুটি জায়গায় ভয় পায়। প্রথমত গৃহকর্মীদের আইনের আওতায় আনলে তারা কি মজুরি ও অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হবে? সমাজ চায় তাদের অধিকার না দিয়ে কাজে লাগাতে। এটি সমাজের সুবিধাবাদী মানসিকতা। দ্বিতীয়ত আর্থিক বিষয়। আবার শ্রম আইনেও গৃহকর্মীদের সুরক্ষা দেয়া হয়নি। অথচ আইনের ভূমিকায় বলা হয়েছে সবার জন্য প্রযোজ্যের কথা। আবার আইনের একটি উপধারায় বলা হয়েছে গৃহকর্মীরা আইনের সুরক্ষায় পড়বে না। তাহলে রাষ্ট্রই প্রথমে আইনে তাদের সুরক্ষা দেয়নি। আইনে সুরক্ষা না দিলে অধিকারের সুরক্ষা আর থাকে না। সমাজও এ পেশার গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেবে না কিন্তু প্রয়োজনীয়তা আছে। যার ফলে স্বীকৃতি না দিয়ে প্রয়োজনীয়তা দেখার অদ্ভুত এক জটিলতা আছে সমাজে। এটা ভাঙতে দরকার আইন। কিন্তু রাষ্ট্র সেখানে উদাসীনতা দেখাচ্ছে। যার কারণে এখনো আমরা এটিকে আইনের অন্তর্ভুক্ত করতে পারিনি।
শ্রম খাতের অংশ হওয়া সত্ত্বেও এ পেশাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও আইনে অন্তর্ভুক্তির পথে কী কী বাধা আছে বলে আপনি মনে করেন?
দেখা উচিত, যে আইনটি করছি সেটি সমাজের মানুষকে সুরক্ষা দিতে নাকি বঞ্চিত করার জন্য। সর্বজনীন করছি, নাকি নির্দিষ্ট মানুষের জন্য করছি। অথচ আমাদের স্বাধীনতার মূলকথাই ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার। তাহলে রাষ্ট্রকে এসব জায়গায় নজর দেয়ার দরকার। কিন্তু রাষ্ট্র তার ঘোষিত দায়িত্বে সুবিচার করেনি। অন্যদিকে সমাজে মানুষ গৃহকর্মীর প্রয়োজন বোধ করে, কিন্তু সুরক্ষা দেয়ার প্রয়োজনটা বোধ করে না। আরেকটি বিষয় অর্থনৈতিক বৈষম্য। আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে একজন গৃহকর্মীর আর্থিক খরচ মেটানোর সক্ষমতা নেই। সে প্রয়োজন অনুভব করে, কিন্তু সক্ষমতা নেই। এখানেও একটি মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা আছে। সমাজের সব মানুষের স্বীকৃতি দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। শ্রমিক হিসেবে রাষ্ট্র তাদের সুরক্ষা ও স্বীকৃতি দেবে। স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ঘোষণা আর সুরক্ষার জন্য আইন লাগবে। এ দুটির মধ্যে একটি ঘাটতি রয়ে গেছে। তারা যদি শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে তারা স্বীকৃতি ও সুরক্ষার আওতায় আসবে। তাদের আইনের স্বীকৃতির আওতায় আনতে হবে।
গৃহকর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও তাদের অধিকার আদায়ে অক্সফামের সুনীতি প্রকল্প ও সার্বিক উদ্যোগকে কীভাবে দেখেন আপনি?
অক্সফাম বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের জন্য কাজ করে। শ্রমজীবীরা মজুরি না পাওয়ার কারণে বঞ্চিত হয়। আর এ কারণে সে সমাজের অন্যান্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়। আমরা মনে করি সমাজের প্রতিটি জিনিসকে এগিয়ে নিলেই কিন্তু সমাজটা এগিয়ে যায়। আমাদের সমাজে অন্যকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা আছে। সেখান থেকে অধিকার আদায়ে আন্দোলন ও আইন লাগে। আন্দোলন দাবি তুলে ধরে। আর আইন সে অধিকারকে সুরক্ষিত করে। অক্সফাম, ট্রেড ইউনিয়নসহ এ রকম সংগঠনগুলোর একটি সমন্বিত দাবি হচ্ছে যে গৃহকর্মীর আইনি স্বীকৃতি, সুরক্ষা ও অধিকারের নিশ্চয়তা। গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের জন্য প্রথমত প্রয়োজন আইন এবং মানসিক জগতের উন্নয়ন। আইনে সুরক্ষা থাকলে মানুষ অনেক কিছু করতে বাধ্য হয়।
শ্রম খাত সংস্কারে গঠিত কমিশনের একজন সদস্য আপনি। কমিশনের প্রস্তাবে কী কী সুপারিশ থাকা প্রয়োজন? এর মাধ্যমে শ্রম খাতের সংস্কার কি কার্যকর হবে?
আমাদের কার্যপরিধিতে শ্রমিকের আইনি অধিকার, সুরক্ষার অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তার কথা বলব। সেখানে আমরা শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা, বৃদ্ধ বয়স, মাতৃত্বকালীন, আন্তর্জাতিক নীতি-বিধিমালা অনুযায়ী আইনি কাঠামো তৈরির কথা বলব। কাজ হবে মর্যাদার অংশ। মজুরি ভিক্ষা নয় শ্রমের হিসেবে প্রাপ্য। কাজকে মর্যাদা ও মজুরিকে অধিকার হিসেবে দেখার জায়গা থেকে সুপারিশগুলো তৈরি হবে। এছাড়া চাকরির পর তার সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আসব। আমরা সব খাতের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। সব সেক্টরের দাবিগুলো আমরা নিয়ে আসার চেষ্টা করব। কমিশনের প্রস্তাব তিনটা জায়গায় ভূমিকা রাখবে। প্রথমত রাষ্ট্র মেনে চলার ব্যবস্থা করবে। মালিকদের কাছে দায়বদ্ধতা এবং শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ আন্দোলনের রূপরেখা দেবে। সংস্কার কমিশন সুপারিশ দিতে পারে, বাস্তবায়নের অধিকার নেই।
শ্রম আইন, বিধিমালা প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মালিকপক্ষের আধিপত্য বেশি থাকে। সেখানে শ্রমিকদের অংশগ্রহণের সুযোগ কম। এসব ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং শ্রমিক নির্যাতন আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন কী কী সুপারিশ করতে পারে?
দেশের মোট শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৭ লাখ। এর মধ্যে ৩৪ লাখ ট্রেড ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। অন্যরা এখনো এর বাইরে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ১৫ শতাংশ। আর ৮৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। তারা শ্রম আইনের সুরক্ষায় পড়েনি। এখানে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪৬ হাজার। ইউনিয়ন করতে পারে ২ লাখ। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা মাত্র দশ হাজার। যা মোট প্রতিষ্ঠানের ৫ শতাংশ। মোট শ্রমিকের ৪-৫ শতাংশ ট্রেড ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। ফলে বোঝা যায় শ্রমিকরা অসংগঠিত। আর অসংগঠিত মানেই অসহায়। ফলে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন করার জন্য এবং দাবিকে যুক্তিসংগত করার মতো শক্তি তাদের থাকে না। অন্যদিকে মালিকরা পুঁজি, রাষ্ট্রের সহায়তা ও সংগঠনের শক্তিতে বলীয়ান। শ্রমিকদের একমাত্র শক্তি সাংগঠনিক হওয়া। কিন্তু সেখানে তারা দুর্বল। এছাড়া তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমেও নানা রকম বিধিনিষেধ থাকে। এটি একটি অসম পরিস্থিতি হয়ে গেছে।
সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত ও প্রয়োজনীয় অংশ গৃহকর্মীরা যাতে মর্যাদাপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা পায়, সে লক্ষ্যে আমরা সংস্কার কমিশন সুপারিশ দেব। আমরা কর্মজীবনে নিরাপত্তা, অবসরের পরে বাকি জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার আলোকে সুপারিশটা তৈরি করব। যাতে তাদের আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং স্বীকৃতি দেয়া হয়।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর শ্রম খাতে অস্থিতিশীল অবস্থা দেখা যায়। যা অনেক স্থানে এখনো বিরাজমান। সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন এ অস্থিতিশীলতার পেছনে বিগত সরকার ও কয়েকটি বিদেশী রাষ্ট্রের ইন্ধন রয়েছে। আপনি কী মনে করেন?
এ যাবৎকাল যারাই সরকারে ছিল তারা শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজেছে। কিন্তু কেউ পায়নি। ষড়যন্ত্রে ট্যাগ দেয়াটা খুব সহজ কাজ। মজুরি, চাকরির নিরাপত্তার জন্য শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছে। সেখানে কেউ কেউ মদদ দিতেও পারে। সেখানে যদি মদদ দেয়াটাকে প্রধান করে শ্রমিকদের মূল দাবিকে আড়াল করি তাহলে এ অসন্তোষ থেকে সরকার বাঁচতে পারবে না। এখানে আন্দোলনের মূল কারণটিকে দেখা হলে শ্রমিক অসন্তোষ অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এখানে মূল জায়গায় যদি শ্রমিকরা সন্তুষ্ট থাকত, তাহলে বিদেশী রাষ্ট্র বা অন্য কেউ তাদের বিশৃঙ্খল করতে পারত না। এসব দোষ দেয়ার খেলায় শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে যেন ছিনিমিনি খেলা না হয় সেটাই আমরা চাই। বিশ্বায়নের যুগে দেখা যায় দেশের ভেতরে অসন্তোষ থাকলে বাইরের দেশ নাক গলাতে চায়। তাই সেটিকে না দেখে ভেতরের সন্তুষ্টিকে দেখা দরকার।