২০২৪ সাল আমাদের জন্য ছিল আত্মোপলব্ধির বছর। আর্থসামাজিক সংকট, রাজনৈতিক পরিবর্তন আর বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা বিপর্যয়ের মধ্যেও আশার বার্তা নিয়ে এসেছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। ২০২৪ সাল আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে সামনের দিনগুলোয় আমাদের প্রজন্ম, যারা বেবি বুমার বা জেন এক্স, তারা আর অর্থনৈতিক বা সামাজিক পরিবর্তনের মূল ভূমিকায় থাকব না। এখন থেকে এ পরিবর্তনগুলো আসবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম, মিলেনিয়ালের হাত ধরে। কারণ পরিবর্তনের যুগোপযোগী রেসিপি তারাই ভালো জানে।
আমাদের উচিত, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনাকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সঠিকভাবে কাজে লাগানো। দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায় উঠে আসছে যে আমরা আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে পারব। তবে দেশের শ্রমশক্তির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ বলে যে দেশের শ্রমবাজারের বাস্তবতা কিছুটা বিপরীতমুখী। আমাদের দেশের উৎপাদনশীল শ্রমশক্তির মধ্যে নিট তরুণদের (শিক্ষা, কাজ বা প্রশিক্ষণে যুক্ত নেই এমন) সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দেশের ১৫-২৪ বছরের জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০ শতাংশই নিট জনগোষ্ঠী, যা বৈশ্বিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ এবং এর বড় অংশই নারী (৬২ শতাংশ)। এ পরিসংখ্যান আমাদের একটি রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি করিয়ে দেয়—আমরা তরুণদের জন্য যথেষ্ট কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারছি না।
আমাদের জন্য আরো আশঙ্কা আর অস্বস্তির বিষয় হচ্ছে যে আমাদের অর্থনীতির চিরাচরিত কর্মসংস্থানের লেবার ইনটেনসিভ খাতগুলোয়, যেমন তৈরি পোশাক শিল্পে প্রত্যাশা অনুসারে বিনিয়োগ বা কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা আর প্রতিযোগিতার কারণে আমাদের রফতানিমুখী শিল্পগুলো একটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে নতুন নতুন ক্ষেত্র আর সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু এ পরিবর্তিত পরিস্থিতির মোকাবেলা করা ও নতুন সুযোগকে যথাসময়ে কুক্ষিগত করার জন্য আমাদের যথেষ্ট পরিকল্পনা আর প্রস্তুতি রয়েছে কিনা তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
পেছনের কথা নিয়ে বেশি আলোচনা না করলেও আমাদের দ্রুতই এ পরিবর্তনগুলোকে আশঙ্কার পরিবর্তে সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। যেমন বিভিন্ন বৈশ্বিক মার্কেট রিসার্চ প্রতিষ্ঠানের পূর্বাভাস মতে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত এআই ডাটা ট্রেনিংয়ের বৈশ্বিক বাজারে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশেরও বেশি হবে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ এর বাজার ৭ বিলিয়ন ইউএস ডলারের বেশি হবে এবং এর বড় একটি অংশ বিপিও হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে সার্ভিস হিসেবে ডেলিভারি করার পাশাপাশি এ খাতে যথেষ্ট পরিমাণ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু এ ধরনের ভবিষ্যতের কাজের জন্য আমাদের দক্ষ মানবসম্পদ, প্রযুক্তিগত অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নয়ন করার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
এ ধরনের পদক্ষেপগুলো মূলত আমাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিয়ে আসবে। কিন্তু এ মুহূর্তে আমাদের বেশি প্রয়োজন হবে স্বল্পমেয়াদি সমাধান। আমাদের অর্থনীতির জন্য কর্মসংস্থানের একটি কুইক ফিক্স হতে পারে আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) ব্যবসা করার পরিবেশ সৃষ্টি ও বিদ্যমান ব্যবসার উন্নয়ন ও বিকাশে বিশেষ মনোযোগ দেয়া। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে আমাদের দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশ আর জিডিপির প্রায় ৪৫ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আসে।
বর্তমান সময়ের উদ্যোক্তারা মার্কেটের চাহিদা তৈরি ও তা পূরণে যথেষ্ট উদ্ভাবনী। একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে বলি, আমার মায়ের বয়স প্রায় ৮০ ছুঁইছুঁই। মায়ের সঙ্গে কিছুদিন আগে দেখা করতে গিয়ে জানতে পারলাম যে তিনি অনলাইন থেকে খাঁটি গুড় কিনেছেন এবং তাই দিয়ে বানিয়েছেন শীতের পিঠা। আমি বেশ অবাক হলাম যে আমার এ বয়সী মাও তার শপিং করার অভ্যাস পরিবর্তন করে অনলাইনে একজন তরুণ উদ্যোক্তার পণ্য দেখে তা কিনে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন।
আজ আমাদের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে এসব উদ্যোক্তার ব্যবসায়িক উদ্যমকে অনুপ্রাণিত করা ও তাদের ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য যে মূলধন প্রয়োজন তার জোগানের পথগুলো সহজ করা। পুঁজির সংকট যেকোনো ব্যবসার শুরুকে অনুৎসাহিত করে এবং আজও কাঠামোগতভাবে ব্যাংক খাতের মতো প্রাতিষ্ঠানিক অঙ্গনে এ সাধারণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পদচারণা খুব বেশি নয়। যদিও এসএমই খাতে ঋণ প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ খাতে অর্থায়নের পরিমাণ তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির তুলনায় এখনো অনেক কম। তাই অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য আমাদের এসএমই অর্থায়নের নীতিমালার দ্রুত পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
কীভাবে এসএমই ঋণ কর্মসংস্থানে কাজে লাগতে পারে, তার একটি উদাহরণ হতে পারে ইউনিলিভারের রিটেইলাররা। ইউএন ক্যাপিটাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের প্রতিবেদন অনুসারে আমাদের দেশের রিটেইলারদের ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বা পুঁজির অভাব। এক্ষেত্রে রিটেইলাররা যদি সহজে এসএমই ঋণ পায়, তাহলে তাদের জন্য ব্যবসা বড় করে সেখানে নতুন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। যেমন এখনো বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সাবান, শ্যাম্পু বা ডিটারজেন্টের মতো পণ্য পৌঁছে দিতে আমরা কিছু পল্লী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে সম্পৃক্ত করি, যাদের আমরা বলি পল্লীদূত। এ পল্লীদূতদের যদি আমরা যথাযথ ঋণ সুবিধা প্রদান করে পুঁজির সংস্থান করে দিই, তারা নিজেদের কার্যক্রম আরো বিস্তৃত করতে সক্ষম হবে, যার ফলে সেই পল্লীগুলোতেও নতুন কিছু কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি এ ঋণ প্রদান ও ঝুঁকি হ্রাসের জন্য ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে সহজ কোনো অ্যাপভিত্তিক সিস্টেমে যদি এসএমইদের ক্রেডিট রেটিংয়ের জন্য হিসাব রাখার কথা বলা হয়, তাহলে এ খাতেও ডেভেলপমেন্ট, ডিপ্লয়মেন্ট বা সার্ভিস প্রভাইডের জন্য বেশকিছু নতুন তথ্যপ্রযুক্তি-সংক্রান্ত কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি আমাদের রিটেইলারদের ব্যবসার পদ্ধতিও এফিসিয়েন্ট আর ডাটাভিত্তিক হবে। এ ধরনের অটোমেশন বা আপগ্রেডের কারণে নতুন কর্মসংস্থান অনেক খাতেই করার সুযোগ রয়েছে।
কিন্তু আমাদের দেশের এসএমই খাত বর্তমানে বেশ চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাংক লোনের ইন্টারেস্টের হার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫-১৬ শতাংশ হয়ে যাওয়ায় এসএমইগুলো অস্বস্তিতে আছে। ব্যাংক লোনের ইন্টারেস্টের হারের এ বৃদ্ধি বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর থেকে এসএমইদের জন্য বেশি চ্যালেঞ্জিং। কারণ এসএমইদের কাছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে দরকষাকষির সক্ষমতা আর বিকল্প উৎস নেই। এসএমই খাতকে লোন নেয়ার জন্য বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্স আর ডকুমেন্টেশনের প্রক্রিয়া একই। পাশাপাশি এসএমইদের জন্য জামানতবিহীন লোন পাওয়ার সুযোগ অনেক কম, যা এ খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যেমন নিজেদের ক্যাশ ফ্লো বা ইনভেন্ট্রি (কাঁচামাল) জামানত হিসেবে দেখিয়ে সহজেই লোন পাওয়া সম্ভব, এসএমইদের জন্য ব্যাপারটা ততটাই কঠিন।
আপাতদৃষ্টিতে এসএমই ঋণের প্রক্রিয়া সহজ করাকে অনেকেই আমাদের বহুল আলোচিত আর্থিক খাতের জন্য নতুন ঝুঁকি হিসেবে যুক্তি দিতে পারেন। কিন্তু আমাদের সামনে এসএমই খাতের কারণে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংকটে পড়ার উদাহরণ নেই। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এ ঋণগুলোর রিকভারি হার, ব্যাংকের আয় ও ঋণের মান অত্যন্ত সন্তোষজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য অনেক উন্নয়ন সহযোগীও এ খাতে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। ঋণগ্রহীতার সংখ্যা অনেক বেশি হলেও সামগ্রিক ব্যাংক খাতের অর্থায়নের পরিমাণের তুলনায় এসএমই ঋণের এক্সপোজার বেশ কম। তাই এসএমই অর্থায়নের কারণে আমাদের অর্থনীতিতে নতুন কোনো সংকট সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা তরুণদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য এসএমই ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালার একটি বড় সংস্কার করা উচিত ঋণ বিতরণ, ব্যবস্থাপনা আর কোন খাতে অর্থায়ন করা যাবে তা সম্প্রসারণ করতে। বিদ্যমান নীতিমালা অনুসারে, এসএমই খাতের অর্থায়ন মূলত উৎপাদনমুখী শিল্প খাত আর কৃষি ক্ষেত্রে করা হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতির আকার যখন বৃদ্ধি পায়, তখন এর কম্পোজিশনে সেবা (সার্ভিস) খাতের শেয়ারও তখন বৃদ্ধি পায়। আমাদের সেবা খাতের এসএমইগুলোর, বিশেষ করে চিরাচরিত আইসিটি উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত।
কিন্তু এ খাতগুলো থেকেই আমাদের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে অনেক বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই আমাদের উচিত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, যেমন ফেসবুকের মাধ্যমে যারা ব্যবসা করছে, তাদের ব্যবসা বিকাশেও অর্থায়নের সহযোগিতা নিশ্চিত করা। এতে কর্মসংস্থানের যেমন সুযোগ সৃষ্টি হবে, তেমনি এ ব্যবসাগুলোও আনুষ্ঠানিক খাতে চলে আসবে ও সরকারের ভবিষ্যতের রাজস্ব আয়ের একটি নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে।
এসএমই ঋণের পাশাপাশি তরুণদের অর্থায়নের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হচ্ছে দক্ষতা বৃদ্ধি। নিট জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি পাওয়ার আরো একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে অভিবাসন। আমাদের অর্থনীতির অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে প্রবাসী আয়, এক্ষেত্রে ভ্যালু সৃষ্টির বড় একটি ক্ষেত্র হচ্ছে দক্ষ আর বিশেষায়িত খাতের জন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থান। সরকারি পর্যায়ে ও বিশেষায়িত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ছাড়া এ খাতে বিনিয়োগের তেমন কোনো উদাহরণ নেই। কিন্তু বিশেষায়িত বা দক্ষ পেশাজীবী হিসেবে আমাদের তরুণদের গড়ে তুলতে কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি, ভাষা শিক্ষা ও জব প্লেসমেন্টের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে অর্থায়নে আমাদের আরো অনেক বেশি অপশন প্রয়োজন। তাহলেও আমাদের তরুণদের বড় একটি অংশের জন্য কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হবে। ভারত, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামে এ ধরনের ব্যবস্থা চালু আছে এবং দেশগুলো এ খাত থেকে যথেষ্ট রিটার্ন পেয়েছে।
আপনাদের বিবেচনায় নিতে হবে যে তরুণ প্রজন্মের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করাটা আমাদের দায়িত্ব। এরই মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হইনি। এক্ষেত্রেও যদি আমরা সফল হতে না পারি, তাহলে আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থার অবনতি ঘটবে এবং অস্থির ও বিশৃঙ্খল একটি পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আমাদের তারুণ্যের অপ্রতিরোধ্য শক্তিকে দেশের অগ্রগতি বা অর্থনৈতিক উন্নয়নকাজে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন বাস্তবধর্মী, প্রাসঙ্গিক, সমন্বিত ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা আর সেই পরিকল্পনার দ্রুত, দায়িত্বশীল ও সৎ বাস্তবায়ন।
মোহাম্মদ জাভেদ আখতার: চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড