অভিমত

বাজেট নিয়ে অন্তর্বর্তীকালে কী ভাবছে সরকার?

২০২৫-২৬ অর্থবছর শুরু হতে আর মাত্র চার মাসেরও কম সময় বাকি। দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবর্তে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান থাকলে আসন্ন নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুতি নিয়ে এরই মধ্যে নিশ্চয় ব্যাপকভিত্তিক আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে যেত।

২০২৫-২৬ অর্থবছর শুরু হতে আর মাত্র চার মাসেরও কম সময় বাকি। দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবর্তে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান থাকলে আসন্ন নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুতি নিয়ে এরই মধ্যে নিশ্চয় ব্যাপকভিত্তিক আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে যেত। বিশেষত এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি ও সেসব কর্মকাণ্ডের অগ্রগতি, অংশীজনদের সঙ্গে তাদের আলাপ-আলোচনা ও সেসবের ফলাফল, সম্পদ সমাবেশের ব্যাপারে সরকারের চিন্তাভাবনা ও এক্ষেত্রে বৈদেশিক সহায়তাগ্রহণ কৌশল ইত্যাদি নিয়ে নানা খবরা-খবর, লেখালেখি ও কথাবার্তায় গণমাধ্যমগুলো এরই মধ্যে অনেকটা সরব হয়ে ওঠত। কিন্তু সে ধরনের সরবতার প্রায় কিছুই এখন লক্ষ করা যাচ্ছে না। অবশ্য রাজনৈতিক সরকারগুলোর আমলে এ ধরনের বাজেট-পূর্ব আলোচনার আধিক্য ছিল বলেই যে সে সময়ে অনেক ভালো বাজেট হয়েছে—এমনটি বলা যাবে না। তার পরও মানতেই হবে যে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় এ ধরনের আলাপ-আলোচনার বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। কিন্তু এ মুহূর্তে দেশে কোনো নিয়মিত রাজনৈতিক সরকার না থাকায় সে ধরনের আলোচনার সুযোগ অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়েছে। অবশ্য এর পরও আশা করব যে সরকার বিশেষত অর্থ মন্ত্রণালয় তাদের এ-বিষয়ক তৎপরতা সম্পর্কে সময়ে সময়ে জনগণকে অবহিত রাখবে।

  • অন্যদিকে বর্তমান সরকার যেহেতু কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, সেহেতু বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাদের উচিত হবে নিয়মিত সরকারের চেয়েও আরো অধিক মাত্রায় সতর্ক, সাবধানী ও সাশ্রয়ী হওয়া। এছাড়া অংশীজনদের গঠনমূলক মতামতকেও বিশেষ বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। তবে সরকার নির্বাচিত নয় বলেই নিজেদের দুর্বল ভেবে অংশীজনদের কোনো অন্যায্য প্রস্তাবের কাছে নতি স্বীকার করা সমীচীন হবে না, তা সে অংশীজনরা যত প্রভাবশালীই হোন না কেন। বাংলাদেশের দাপ্তরিক সংস্কৃতিতে বাজেটের আওতায় বাড়তি বরাদ্দ পাওয়ার জন্য বাজেট ঘোষণার প্রাক্কালে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ ও সহযোগী মন্ত্রণালয়গুলোর কাছ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের তদবির ও চাপের মুখোমুখি হতে হয়। বর্তমান সরকার অন্তর্বর্তীকালীন বলেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের বর্তমান কর্তৃপক্ষের উচিত হবে সেসব চাপ ও তদবির অত্যন্ত সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করা এবং অযৌক্তিক কোনো বিষয়কে বিবেচনায় না নেয়া। আর বৈদেশিক ঋণ, অনুদান ও বাজেট সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রেও অর্থ মন্ত্রণালয়কে যেকোনো বিতর্কিত সিদ্ধান্তের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। না হলে পরবর্তী সময়ে তাদেরকে এজন্য জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হতে পারে।
  • দেশে বর্তমানে যেহেতু কোনো জাতীয় সংসদ নেই, সেহেতু বাধ্য হয়েই বর্তমান সরকার তথা এর অর্থ উপদেষ্টাকে সংসদের বাইরে বসেই বাজেটের খসড়া জনগণের সামনে পেশ করতে হবে। আর সংসদ না থাকায় পেশকৃত খসড়ার ওপর সরাসরি আলোচনা করা বা মতামতদানেরও যেহেতু কোনো সুযোগ নেই, সেহেতু রেওয়াজ অনুযায়ী সরকার হয়তো একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ওই সময়ের মধ্যে মতামতদানের জন্য নাগরিক সাধারণের প্রতি আহ্বান জানাবে। কিন্তু অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এ ধরনের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে সাড়া এতটাই কম মেলে যে একে আর যা-ই বলা যাক ‘জনগণের মতামত’ বলা সমীচীন হবে না। এ অবস্থায় বাস্তব কথা হচ্ছে, কোনো ব্যাপকভিত্তিক জনমত ছাড়াই এ বাজেট চূড়ান্ত করতে হবে। সেক্ষেত্রে বাজেটে যদি সত্যি সত্যি জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে হয় তাহলে সরকারকেই নিষ্ঠাবান আগ্রহী হয়ে জনগণের চাহিদা ও প্রয়োজনগুলোকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। আর দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সেসব সম্ভাব্য পদক্ষেপের বিষয়ে কতিপয় প্রস্তাব নিম্নে তুলে ধরা হলো।
  • এক. দেশে ব্যবসায়ী ও অন্যান্য এমন নানা সংগঠিত পেশাজীবী শ্রেণী আছে, যারা বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উপায়ে বাজেটে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিকে প্রভাবিত করার সামর্থ্য রাখেন। কিন্তু চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে স্থায়ী, কার্যকর ও টেকসই অবদান রাখা সরল কৃষকের কোনো সংগঠন নেই। ফলে বাজেটে এ অসংগঠিত কৃষকের স্বার্থ যদি রক্ষা করতে হয় তাহলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সরকারকেই তা করতে হবে। আর এ লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হচ্ছে: ফসলের আবাদ মৌসুমে কোনো অবস্থাতেই যাতে সার, বীজ ও কীটনাশকের ঘাটতি না হয় সেজন্য বাজেটের সংশ্লিষ্ট খাতগুলোয় পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে হবে। আর জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়লেও (বাড়ানোর পক্ষে বলছি না) সেচকাজে ব্যবহৃত ডিজেলকে যেন সে মূল্যবৃদ্ধি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অন্যদিকে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আরোপের ক্ষেত্রে কৃষি উপকরণ ও কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ ও প্রয়োগ করতে হবে।
  • দুই. জনপ্রশাসন খাতসংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যয়কে যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে জনপ্রশাসকরা নিজেরাই যেখানে বাজেটের প্রণেতা, সেখানে দীর্ঘদিনের কায়েমি স্বার্থ ত্যাগ করে এটি তারা কতটা কমাতে রাজি হবেন, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সেক্ষেত্রে অর্থ উপদেষ্টা মহোদয়কেই এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট শীর্ষ আমলাদের বুঝতে হবে যে দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে হলেও এ ব্যাপারে তারা যদি নমনীয় না হন তাহলে তাদের প্রতি মানুষের ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টিই শুধু বাড়বে না, দেশের অর্থনীতিও বড় ধরনের ঝুঁকি ও সংকটের মধ্যে পড়বে, যে অর্থনীতি রক্ষার নির্বাহী দায়িত্ব বহুলাংশে তাদের (আমলাদের) ওপরও বর্তায়। এছাড়া উন্নয়ন বাজেটের আওতায় বরাদ্দ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সম্পদ সংগ্রহের কৌশল হিসেবেও রাজস্ব বাজেটের আওতাধীন জনপ্রশাসন খাতের ব্যয় সাশ্রয় করে তা উন্নয়ন খাতে স্থানান্তর করা জরুরি।
  • তিন. উন্নয়ন বাজেটের আওতায় বৈদেশিক ঋণসহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারকে আরো সতর্ক ও সাবধানী হতে হবে। কোনো বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পই পর্যাপ্ত ও যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই ব্যতীত গ্রহণ করা সমীচীন হবে না। এক্ষেত্রে শুধু দাতাদের করা একতরফা সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ওপর নির্ভর না করে বিষয়টিকে নিজেদের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকেও যাচাই করে দেখতে হবে। আর এমনটি না দেখার কারণেই ১৯৮০ দশকে একাধিক পর্যায়ে স্বাক্ষরিত কাফকো (কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি) চুক্তির খেসারত বাংলাদেশকে এখনো দিয়ে যেতে হচ্ছে। আর এমন কোনো প্রকল্পে সম্মতি দেয়া ঠিক হবে না, যে প্রকল্প তার ঋণের দেনা প্রকল্প বাস্তবায়ন-পরবর্তী সময়ে নিজস্ব আয় থেকে পরিশোধ করতে পারবে না, যেমনটি পারছে না কর্ণফুলী টানেলসহ অন্য অনেক মেগা প্রকল্প। এছাড়া সরবরাহকারী ঋণে (সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট) কোনো প্রকল্প আপাতত না নেয়াটাই শ্রেয়। কারণ অতি কঠিন শর্তযুক্ত ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রহীতার স্বার্থের পরিপন্থী এসব ঋণ শেষ পর্যন্ত সাধারণ জনগণের তেমন কোনো উপকারেই আসে না। ২০২২ সালে শ্রীলংকার ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার পেছনে এ ধরনের সরবরাহকারী ঋণের ভূমিকাও ছিল অনেকখানি। এ সূত্রে মনে রাখা দরকার যে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই ব্যতিরেকে গৃহীত কিংবা সরবরাহকারী ঋণে স্থাপিত প্রকল্পের ঋণের দায়ভার শেষ পর্যন্ত রাজস্ব বাজেটের ওপর গিয়েও অনেকখানিই পড়ে, যার চাপ আসন্ন বাজেটেও মোকাবেলা করতে হবে বৈকি! দেশের সাধারণ জনগণের বৃহত্তর অংশ কি জানে বা তাদেরকে কি কখনো জানানো হয়েছে যে বাংলাদেশের বাজেটের একটি বড় অংশই চলে যায় নানা অপ্রয়োজনীয় ও দেশের স্বার্থপরিপন্থী প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের পেছনে।
  • চার. নিম্ন আয়ের মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে আসন্ন বাজেটে ব্যক্তি পর্যায়ে আয়করদানের নিম্নসীমা বৃদ্ধি না করাটাই হবে উত্তম। এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ওপর বাড়তি মূসক না বসানোটাও সমীচীন হবে বলে মনে করি। সেক্ষেত্রে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির কৌশল হিসেবে বিত্তবানদের ওপর বর্ধিত প্রত্যক্ষ কর আরোপের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে, যা এ লেখক কর্তৃক তার পূর্ববর্তী একাধিক লেখায় প্রস্তাব করা হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে ক্ষমতাসীনদের নানামুখী স্বার্থের কারণে এটি করা সম্ভব হয় না। কিন্তু বর্তমান সরকার যেহেতু কোনো রাজনৈতিক সরকার নয়, সেহেতু তাদের পক্ষে এটি করা খুবই সম্ভব। তবে এ সরকার নির্বাচিত নয় বলে তারা যেন এটি করতে গিয়ে কোনোরূপ দুর্বলতায় না ভোগেন। কারণ সততার সঙ্গে ভালো কাজ করার চেষ্টা সব সময়েই অভিনন্দনযোগ্য। ফলে ধনীদের ওপর প্রত্যক্ষ আয়কর বাড়ালে তাতে জনঅসন্তুষ্টির মুখে পড়ার কোনো কারণ নেই। বরং সাধারণ মানুষ তাতে খুশিই হবে এই ভেবে যে বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংস্কৃতিতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত যেখানে রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে নেয়া অনেক কঠিন বা প্রায় অসম্ভব, সেখানে অরাজনৈতিক সরকার হিসেবে জনআকাঙ্ক্ষিত সে ভালো কাজটি তারা করে দিল।
  • পাঁচ. অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান ধারার আলাপ-আলোচনা অব্যাহত থাকলে এবং এ সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি অন্যকোনো দিকে মোড় না নিলে ধারণা করা যায় যে আসন্ন বাজেটকালের মধ্যে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে আবার স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিও আছে কোনো কোনো পক্ষের। এ দাবির প্রতি সরকার কিছুটা হলেও নমনীয় বলে যতটুকু শোনা যায়, তাতে আসন্ন বাজেটের মেয়াদকালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনাও যথেষ্টই রয়েছে। আর এ দুই নির্বাচনই যদি এ সময়ে হয়, তাহলে এর জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে তার সংস্থান কীভাবে হবে, সেটিও আগামী বাজেটের একটি প্রধান বিবেচনা। এ অবস্থায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে অবিলম্বে নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিততভাব জানতে চাওয়া যে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে নির্বাচন কমিশনের আওতায় মোট কতটি নির্বাচন হবে এবং এর জন্য তাদের ন্যূনতম বাজেট চাহিদা কত? সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কাছে সাধারণ নাগরিক প্রত্যাশা এই যে নির্বাচন কমিশন যেন দল বিশেষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গিয়ে এমন কিছু না করে, যা নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসে বাতিল করে দিতে পারে। আর তেমনটি হলে এ গরিব দেশের জন্য সেটি হবে অর্থের এক ধরনের গর্হিত অপচয়। আশা করি, বিষয়টিতে নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবে।
  • ছয়. বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরিচালকরা দল, গোষ্ঠী, পেশা ইত্যাদি নির্বিশেষে সবাই অনেকটা ধরে নিয়েছেন যে বাংলাদেশ মানেই ঢাকা শহর। ঢাকার বাইরেও যে বাংলাদেশ আছে, এটি প্রায়ই তাদের চিন্তা ও সিদ্ধান্তে কাজ করে না। বাজেটও এর ব্যতিক্রম নয়। আসন্ন বাজেটে যুক্ত নীতিনির্ধারকদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, বাজেট বরাদ্দের সুফলের আনুপাতিক হিস্যার পুরোটা না হোক, অন্তত আগের চেয়ে কিছুটা হলেও বেশি বরাদ্দ যেন গ্রামের সাধারণ মানুষের ভাগ্যে জোটে। সেক্ষেত্রে গ্রামীণ মানুষের পাশাপাশি শিল্প শ্রমিক ও অন্যান্য অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট, চাহিদা ও প্রয়োজনের বিষয়গুলোও যেন কিছুটা হলেও আগের চেয়ে বেশি মনোযোগ পায়। আর স্মরণে রাখলে খুবই ভালো হয় যে দেশের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ এখনো সরাসরি দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে এবং আরো প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য ঝুঁকিতে রয়েছে। বাজেটে তাদের কথা না ভাবলে এ রাষ্ট্র তাদের কাছে প্রতারক বলেই বিবেচিত হবে।
  • সাত. দেশে বর্তমানে যেহেতু জাতীয় সংসদ বহাল নেই, সেহেতু অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে বাজেটের খসড়াটি যতটা সম্ভব আগে আগে ঘোষণা করা এবং তারও আগে অংশীজনদের কাছ থেকে মতামত গ্রহণের কাজটি যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করে ফেলা। আর বাজেট প্রণয়নকে উপলক্ষ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশেষ সম্মানী প্রদানের যে রেওয়াজ চালু আছে, সেটি অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করি। কারণ বাজেট প্রণয়ন তাদের নিয়মিত দাপ্তরিক কাজেরই অংশ। ফলে এজন্য আলাদাভাবে সম্মানী গ্রহণ করাটা নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য, যেমন অগ্রহণযোগ্য বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চাকরি ও ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে আবেদনকারীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ থেকে সম্মানী নেয়া। বাজেট-পূর্ব কয়েক মাস ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে যেভাবে প্রায় নিয়মিতভাবে ভূরিভোজ চলে, যানবাহনের যথেচ্ছ ব্যবহার হয় কিংবা আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ স্ফীত হয়ে ওঠে, সেগুলোও অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করি। এক্ষেত্রে অর্থের অপচয়ের চেয়েও আপত্তি উত্থাপনের মূল কারণটি হচ্ছে নৈতিক। দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ দশক ধরে এ দেশের সাধারণ জনগণ চরম কষ্টমিশ্রিত উপলব্ধি নিয়ে অবলোকন করছে যে রাষ্ট্রের তথাকথিত জনসেবকরা জনগণের কষ্টার্জিত করের পয়সায় দিনের পর দিন এসব অনৈতিক কাজ সম্পূর্ণ নির্লজ্জ ভঙ্গিতেই চালিয়ে যাচ্ছে।
  • সব মিলিয়ে আসন্ন বাজেট সামনে রেখে এটাই মূল কথা যে, দেশ বর্তমানে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে বলেই যেন বাজেটে কোনোরূপ অদক্ষতার ছাপ না পড়ে, এর বরাদ্দের ক্ষেত্রে দুঃখী মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদের যেন কোনো অপচয় না ঘটে এবং বরাদ্দ বণ্টনের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ না হোক, অন্তত ন্যূনতম ন্যায্যতাটুকু যেন রক্ষিত হয়। সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র জনগণের সঙ্গে যে সামাজিক চুক্তিতে আবদ্ধ, আসন্ন বাজেট যেন সে চুক্তির বিপরীত দিকে না হাঁটে, যেমনটি অতীতে বারবার লক্ষ করা গেছে। এক বাজেটেই সে গতিপথ হঠাৎ বদলে যাবে— এমন নয়। তবে আসন্ন বাজেটে বদলের সে আকাঙ্ক্ষা যেন এক রত্তি হলেও টের পাওয়া যায়—সেটাই সাধারণের প্রত্যাশা।

আবু তাহের খান: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), শিল্প মন্ত্রণালয়

আরও