শিক্ষা নিয়ে কথা বলার এ সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত ও আনন্দিত। আমাদের আলোচ্য বিষয় শিক্ষার গুণগত মান, গবেষণা, উদ্ভাবন ও র্যাংকিং। এই সবগুলো বিষয় কিন্তু একই সূত্রে গাথা। প্রথমে আমি শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে কথা বলব। শিক্ষায় গুণগত মান বজায় রাখার মানে বলতে আমি বোঝাই, শিক্ষা যাতে সঠিকমতো হয়। সঠিক শিক্ষা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি পূর্বশর্ত অনুসরণ করতে হয়। শিক্ষায় একটি সিলেবাস থাকতে হয়, কারিকুলাম থাকতে হয়। শিক্ষার ওই সিলেবাস ভালোভাবে প্রণয়ন করতে হবে। এ সিলেবাস শেষ করার আবার একটা সময়সীমা থাকে। সেখানে কোন কোন কোর্স কতদিনের মধ্যে শেষ হবে তার একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকে। ভালো শিক্ষা, গুণগত মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের ভালো মানের সিলেবাস প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
- আমরা অনেক অভিযোগ শুনি, অনেক শিক্ষক পর্যাপ্ত ক্লাস না নিয়েই কোর্স শেষ করে দেন। এটা কোনোভাবেই উচিত নয়। কোর্স ভালোভাবে শেষ করা ওই কোর্স শিক্ষকের দায়িত্ব। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো কোন কোর্স কতদিনের জন্য হবে তা হিসাব করা। একটা কোর্সের মেয়াদ বা সময় কেমন হবে? কতগুলো ক্লাস হবে বা ল্যাব ক্লাস কতগুলো হবে তা নির্ধারণ। এগুলো যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এরপর আরো অনেক বিষয় আছে, যেমন পরীক্ষা। পরীক্ষা কখন কীভাবে হবে, প্রশ্নপত্র কী হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র খুবই সহজ ও সাধারণ হবে। তবে এমন প্রশ্ন করতে হবে যা পৃথিবীর আর কেউ আগে দেখেনি। তবে এ কাজ এত সহজ নয়। শুধু পরীক্ষার আগে প্রশ্ন করলেই হবে না। সারা বছরই প্রশ্ন করতে হবে। পরীক্ষার খাতা যথাসময়ে ও নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। সঠিক পাঠদান নিশ্চিত করতে অনেক কষ্ট করতে হবে।
- শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখতে হলে যেকোনো গ্র্যাজুয়েটকে প্রফেশনাল ট্রেনিং ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের যেকোনো গ্র্যাজুয়েটকে অন্তত চার সপ্তাহ বা এক মাসের প্রফেশনাল ট্রেনিংয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। যেমন ইংরেজিতে গ্র্যাজুয়েট করা কোনো শিক্ষার্থীকে বাংলাদেশের যেকোনো কোম্পানি বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। স্কুল-কলেজ বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নি করতে পারে। এটা অন্যান্য বিভাগের জন্য সত্য। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি করতে পেরেছি। শতভাগ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন কোম্পানিতে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। এখন তারা এর সুফল পাচ্ছে।
- গবেষণা একটি বিশাল ব্যাপার। এখানে গুণগত মান বজায় রাখা দরকার। বর্তমানে লাখ লাখ জার্নাল আছে, কোথাও একটা গবেষণা প্রকাশ হলেই হবে না। সেটা কিউ ওয়ান, কিউ টু মানের হতে হবে। এর পরের যে জার্নালগুলো আছে সেগুলো তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ। সেরা জার্নালগুলো ২৫ শতাংশের মধ্যে পড়ে। সেখানেই রিসার্চ আর্টিকেল প্রকাশের চেষ্টা করতে হবে। লাখ লাখ জার্নাল আছে, তবে প্রথম সারির জার্নালে গবেষণা প্রকাশের চেষ্টা করতে হবে। ইংরেজিতে গবেষণা করা খুবই সহজ। এ ভাষায় গবেষণার ম্যাটেরিয়ালস পাওয়া খুব সহজ। কিন্তু বাংলায় গবেষণা করা খুবই কঠিন কাজ। অনেক ধরনের সমস্যা আছে। তবে গবেষণার টপিক নির্ধারণের প্রচুর অপশন আছে। যেকোনো একটি সমস্যাকে যথাযথ মান বজায় রেখে সমস্যার সমাধান করা গেলে একটি ভালো গবেষণা হতে পারে।
- আধুনিক শিক্ষায় বিশ্বব্যাপী উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে হাজির হয়েছে। নতুন নতুন অনেক উদ্ভাবন আমাদের জীবনযাত্রা পরিবর্তন করে দিচ্ছে। অনেক ডাইমেনশন প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনমূলক কাজে যুক্ত করতে হবে। এখানে নতুন আইডিয়া আসবে এবং তা বাস্তবায়নের পদ্ধতিও বলা হবে। শিক্ষার্থীদের স্টার্টআপ বা নতুন ব্যবসা চালুতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তারা যাতে কোনো পণ্য বা পরিষেবা তৈরি করে বিক্রি করতে পারে এবং এর মাধ্যমে আয় করতে পারে। বিশ্বপরিসরে কাজ করে কোনো ছাত্র যাতে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারে সে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এরই মধ্যে অনেক ছাত্র সেটা করছেও।
- এ পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং নিয়ে কিছু বলি। এ নিয়ে বলতে গেলে মাথায় রাখতে হবে র্যাংকিং খুবই বড় এরিয়া। কিন্তু এটি বাধ্যতামূলক নয়। বিশ্বজুড়ে এখন অনেক র্যাংকিং প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। খুব পরিচিত একটা প্রতিষ্ঠান হলো টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাংকিং। আছে কিউএস র্যাংকিং। বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে আমাদের ইউনিভার্সিটির অবস্থা সন্তোষজনক নয়। টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাংকিংয়ের প্রথম ১০টি ইউনিভার্সিটিই ইউরোপের। অন্যদিকে প্রথম এক হাজার ইউনিভার্সিটির তালিকায় আমাদের আছে মাত্র পাঁচটি।
- আমি মনে করি বাংলাদেশ সঠিকপথে ফিরে এসেছে। এখন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে এগোতে হবে। কাজটা মোটেও সহজ নয়। বেশকিছু ক্রাইটেরিয়ায় ভালো করতে হয়। তবু আমাদের ধীরে ধীরে র্যাংকিংয়ে উন্নতি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নে এবং র্যাংকিংয়ে ভালো করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) বড় ভূমিকা রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের একটি নিম্নসীমা বেঁধে দিতে হবে ইউজিসির, যাতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওই মানের নিচে না যায়। ওই নিম্নসীমার নিচে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বাতিল করতে হবে। তখন দেখা যাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মানোন্নয়নে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেবে।
- বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলকে সক্রিয় হতে হবে। তারা অনেক পরিশ্রম করছেন এজন্য সাধুবাদ জানাই। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিশ্বমঞ্চে সম্মান ও মর্যাদা পেতে চায় তাহলে তাদের অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলে অ্যাক্রেডিটেড হতে হবে। এ অ্যাক্রেডিটেশন পাওয়ার কাজটা সহজ হবে না। বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল কর্তৃক নির্ধারিত ১০টি স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করেই তা পেতে হবে। তারা যে ৬৩টি ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করে দিয়েছে তা অনুসরণ করতে পারলে কোনো প্রোগ্রামকে অ্যাক্রেডিটেশন দেয়া হবে। যা বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা পাবে। তাহলে শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়তে কিংবা গবেষণা করতে গেলে সমস্যায় পড়বে না।
- বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) ও বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল (বিএসি) যদি একসঙ্গে কাজ করে তাহলে শিক্ষার মান নিশ্চিত করা সহজ হবে। অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অ্যাক্রেডিটেশন নিতে পারে।
- শিক্ষার মান নিশ্চিত করা আসলে জটিল ব্যাপার, এর সঙ্গে অনেক বিষয় সম্পৃক্ত। এটা অর্জন করা কঠিন কিন্তু দেশের স্বার্থেই আমাদের এ কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
ড. এম লুৎফর রহমান: উপাচার্য, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
[‘উচ্চ শিক্ষায় বৈশ্বিক মান: বাংলাদেশের করণীয়’ শীর্ষক বণিক বার্তা আয়োজিত প্রথম বাংলাদেশ উচ্চ শিক্ষা সম্মেলন ২০২৪ অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচকের বক্তব্য]