পর্যালোচনা

করোনা অতিমারী: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিশ্ব

আজকের করোনা অতিমারী প্রকৃত অর্থেই একটি বৈশ্বিক সংকট—তার ব্যাপ্তিতে, গভীরতায় ও অভিঘাতে। ব্যাপ্তির দিক থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের ২১২টি দেশ ও ভূখণ্ড এর শিকার হয়েছে। অভিঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের মোট ১৬ কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এবং ৩৪ লাখ মানুষ এ অতিমারীতে প্রাণ দিয়েছে। সন্দেহ নেই, তেজ ও তাণ্ডবের দিক থেকে করোনা সারা বিশ্বকে দিশেহারা করে ফেলেছে এবং মাত্র দেড় বছরের মধ্যে এটা জীবন ও জগতের চিত্র বদলে দিয়েছে।

আজকের করোনা অতিমারী প্রকৃত অর্থেই একটি বৈশ্বিক সংকটতার ব্যাপ্তিতে, গভীরতায় অভিঘাতে। ব্যাপ্তির দিক থেকে পর্যন্ত বিশ্বের ২১২টি দেশ ভূখণ্ড এর শিকার হয়েছে। অভিঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের মোট ১৬ কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এবং ৩৪ লাখ মানুষ অতিমারীতে প্রাণ দিয়েছে। সন্দেহ নেই, তেজ তাণ্ডবের দিক থেকে করোনা সারা বিশ্বকে দিশেহারা করে ফেলেছে এবং মাত্র দেড় বছরের মধ্যে এটা জীবন জগতের চিত্র বদলে দিয়েছে।

করোনা সংকট এক নতুন বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। বাস্তবতার নানান প্রভাব আছে বিভিন্ন পর্যায়েদেশজ রাষ্ট্রীয় স্তরে। বাস্তবতার নানান মাত্রিকতা আছেঅর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, সামাজিক বলয়ে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে। বাস্তবতার অভিঘাত পড়বে ব্যক্তিমানুষের জীবনে, পারিবারিক আঙিনায়, সমাজের উঠোনে।

সেই চালচিত্র মনে রেখে লেখায় তিনটি বিষয়ের ওপরে মনোযোগ ন্যস্ত রাখা হয়েছে। প্রথমত, করোনার কারণে বৈশ্বিক বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, দ্বিতীয়ত, করোনার কারণে আগামী পৃথিবীর আর্থসামাজিক বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের আগামী বাজেটে করণীয় নীতিমালা।

বিশ্ব অর্থনীতি ২০২০ সালে . শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। ১৯৩০ সালের অতিমন্দার পর এই প্রথম বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার এত হ্রাস পেল। গত বছর চীনের প্রবৃদ্ধির হারও ছিল মাত্র শতাংশের বেশি অথচ দুই দশক ধরে চীনের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল শতাংশের ওপরে। করোনা অতিমারী পৃথিবীর সব দেশে কর্মনিয়োজনকেও সংকুচিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী অর্থনীতিতেও বেকারত্বের হার ২০১৯-এর শতাংশ থেকে তিন গুণ বেড়ে ২০২০- শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছিল। বিশ্ব অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেবামূলক খাত, যেখানে কর্মনিয়োজন সবচেয়ে বেশি। বৈশ্বিক বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। যুক্তরাষ্ট্রে ৬৬ লাখ লোক কর্মহীন হয়ে পড়েছে, স্পেনে ৩৫ লাখ। ফলে তাদের কর্মসংস্থান, আয় জীবনযাত্রার মানের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। যুক্তরাজ্যে প্রাক্কলন করা হচ্ছে যে প্রায় লাখ ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা হারাবেন।

করোনা সংকটে অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হবে দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষ নাজুক জনগোষ্ঠী। এর মধ্যে থাকবে বিত্তহীন বঞ্চিত মানুষ, প্রান্তিক গৃহস্থালি, বৃদ্ধ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী, নারীরা। সারা বিশ্বে গত তিন দশকে চরম দারিদ্র্য হ্রাস করার ব্যাপারে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে, তা ব্যাহত হবে। গত ৩০ বছরে বিশ্বের চরম দরিদ্রের সংখ্যা ১৯০ কোটি থেকে ৮৯ কোটিতে নেমে এসেছিল। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন বিশ্বে দুই লাখের বেশি মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে আসছিল। এখন প্রাক্কলনে বলা হচ্ছে, করোনার কারণে সারা বিশ্বে নতুন করে ৫০ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে।

সংকটের একটি অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হয়তো হবে প্রকট খাদ্য সংকট বিশ্বব্যাপী। এর মধ্যেই বলা হচ্ছে যে বিশ্বে ২৫ কোটি লোক দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত হতে পারে। সাধারণ সময়ে খাদ্যলভ্যতার ক্ষেত্রে উৎপাদন নয়, বণ্টনই মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অসম বণ্টনের কারনেই মোট উৎপাদন পর্যাপ্ত হলেও সবার কাছে খাদ্য লভ্য হয় না। দরিদ্র মানুষেরা বুভুক্ষুই থেকে যায়। করোনা-পরবর্তী পর্যায়ে সংকট আরো ঘনীভূত হবে। পৃথিবীতে খাদ্যের অভাবে কখনো দুর্ভিক্ষ হয়নি, হয়েছে সুষম বণ্টনের অভাবে। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের সময়ে মানুষ যখন বুভুক্ষায় মারা যাচ্ছে তখনো সরকারি খাদ্যগুদামে খাদ্য মজুদ ছিল।

করোনা সংকটকে পুঁজি করে দেশজ আন্তর্জাতিক কায়েমি স্বার্থবাদীরা খাদ্যসামগ্রী মজুদ করে মুনাফা সর্বোচ্চকরণে প্রয়াসী হবে। ফলে কৃত্রিম খাদ্য সংকট তৈরি হবে এবং আবির্ভূত হবে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ। সুতরাং প্রকৃতিসৃষ্ট খাদ্য ঘাটতির সঙ্গে যুক্ত হবে মানুষের সৃষ্টি সংকট। বলার অপেক্ষা রাখে না জাতীয় দুর্ভিক্ষে প্রধান বলি হবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। বৈশ্বিক পর্যায়ে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশজ আলোচনা এখনই শুরু হওয়া উচিত কী করে আন্তর্জাতিক বণ্টন ব্যবস্থাকে সংহত করা যায়। সেই সঙ্গে দেশজ পর্যায়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থাও প্রণীত হওয়া দরকার।

খাদ্য গ্রহণে আমাদের সবার কৃচ্ছ সাধন আমাদের অস্তিত্ব রেখার জন্য একান্ত প্রয়োজন। খাদ্য অপচয় নয়, লোকদেখানো ভোগ নয়এগুলোই আমাদের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে দরিদ্র জনগণের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য খাদ্য ত্রাণ বজায় রাখতে হবে। বিশ্বের সব দেশেই এটা অগ্রাধিকারভিত্তিক করতে হবে। এজন্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকে জোরদার করা প্রয়োজন। ব্যাপ্তিতে গভীরতায় বর্তমান করোনা সংকট অভূতপূর্ব। আমরা সবাই একই নৌকার যাত্রী। অবস্থায় আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের উত্তরণের পথ হতে পারে না। যূথবদ্ধতাই আমাদের পরিত্রাণের একমাত্র উপায় সহজ সত্য আমরা যেন ভুলে না যাই। খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটাও মোক্ষম কথা। মনে রাখা প্রয়োজন, নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না

কোনো দুর্যোগেই বিশ্বের সব জনগোষ্ঠী সমভাবে পরাস্ত হয় না। তবে বেশির ভাগ দুর্যোগেইতা সে যুদ্ধবিগ্রহই হোক কিংবা ঘূর্ণিঝড়-প্লাবন হোক অথবা দুর্ভিক্ষ-মহামারীই হোকঅসমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র প্রান্তিক গোষ্ঠী। গোষ্ঠীর মধ্যে একদিকে যেমন নানান প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন মানুষ আছে, তেমনি আছে জাতিসত্তাভিত্তিক সংখ্যালঘুরা। একদিকে যেমন আছে পরিবেশ শরণার্থীরা, তেমনি আছে নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র গোষ্ঠী। এবারের করোনা দুর্যোগও তার ব্যত্যয় নয়। সব দেশেই প্রবণতা বর্তমান।

প্রথমেই যে কথাটা বলা দরকার, তা হচ্ছে করোনার আপাতন আর মৃত্যুর মাঝেই তো এক ধরনের বৈষম্য আছে। করোনায় যাদের প্রাণহানি ঘটছে তার মধ্যে ৭০ শতাংশ পুরুষ ৩০ শতাংশ নারী। এর আপাতন আর মৃত্যুর মধ্যে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর অনুপাত বেশি। তেমনি যেসব ব্যক্তি নানান রোগে যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হূদরোগ, প্রমেহ, হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টজনিত অসুবিধায় ভুগছে, তারাও করোনা সংক্রমণ মৃত্যুর অন্যতম শিকার। যেসব রোগের কথা বলা হয়েছে, তাতে যারা ভুগছে, সেসব জনগোষ্ঠীর যেকোনো জীবাণু প্রতিরোধক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে তারাই করোনা সংক্রমণ মৃত্যুর মূল শিকার হয়েছে। দ্বিতীয় প্রবণতা সম্পর্কে কিছুটা বলা প্রয়োজন। নারীর তুলনায় পুরুষেরা করোনা মৃত্যুর মূল শিকার। চীনের ,৫০০ করোনা মৃত্যুর মধ্যে ৬৪ শতাংশ পুরুষ আর ৩৬ শতাংশ নারী। ব্রিটেনে পর্যন্ত করোনা মৃত্যুর ৭০ শতাংশ পুরুষ ৩০ শতাংশ নারী। অর্থাৎ পুরুষের মৃত্যুর হার নারীর দ্বিগুণ। এর কারণ বিবিধ। নারীর একটি জৈবিক শারীরিক সুঅবস্থা আছে, যার কারণে নারীর প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেশি। সেই সঙ্গে ধূমপান অতিরিক্ত মদ্যপানের প্রকোপ পুরুষের মাঝে বেশি, সুস্বাস্থ্য অভ্যাস পুরুষের চেয়ে নারীর ভালো এবং হূদরোগ বা প্রমেহের মতো রোগের আপাতন পুরুষের চেয়ে নারীর মধ্যে কম। যেকোনো জীবাণু প্রতিরোধের ক্ষমতা বয়োবৃদ্ধদের কম তরুণদের চেয়ে। করোনাও তার ব্যত্যয় নয়। ফলে করোনা মৃত্যুহার বয়োবৃদ্ধদের মধ্যে বেশি।

দ্বিতীয়ত, পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, তাতে দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশে নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুরা অনানুপাতিকভাবে করোনার শিকার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার মধ্যে যদিও মাত্র ১৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ, কিন্তু করোনা সংক্রমণে তাদের অনুপাত ২৫ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে প্রতি তিনজন করোনা আক্রান্ত মানুষের মধ্যে একজন নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু। বলা হচ্ছে যে কৃষ্ণাঙ্গ কিছু কিছু দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশ মানুষ করোনা আক্রান্ত হতে পারে। যুক্তরাজ্যে জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ৫৮ শতাংশ চিকিৎসক সেবিকাই দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত। পর্যন্ত ব্রিটেনে কৃষ্ণাঙ্গ, এশীয় সংখ্যালঘু উদ্ভূত ১৩০ জন চিকিৎসক, সেবিকা অন্যান্য সেবাকর্মী মৃত্যুবরণ করেছে। নিবিড় পরিচর্যা স্থাপনায় প্রতি তিনটি মৃত্যুর একটি কৃষ্ণাঙ্গ, এশীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর।

নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের অনানুপাতিকভাবে করোনার শিকার হওয়ার পেছনে নানান কারণ রয়েছে, যার কেন্দ্রবিন্দুতেই রয়েছে দারিদ্র্য, বঞ্চনা অসমতা। দারিদ্র্যের কারণেই জনগোষ্ঠী একই বাড়িতে গাদাগাদি করে বসবাস করে। যৌথ নিরাপত্তাও সে ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করে। ফলে সঙ্গ নিরোধ সেখালে বাতুলতামাত্র। সেই সঙ্গে জাতীয় মানুষ কর্মসংস্থানের যে স্তরে কাজ করে, সেখানে কাজ আয়ের জন্য তাদের বাইরে আসতেই হয়। ফলে সামাজিক জনদূরত্ব সেখানে কাজ করে না। নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুরা যেখানে বসবাস করে, সেখানে সামাজিক সেবার বিস্তৃতি মান উভয়েই বড় সীমিত। সব মিলিয়ে করোনাকালে এসব জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা বড়ই কম।

যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেছে যে প্রতি চারজন করোনা সংক্রমিত মানুষের একজন কৃষ্ণাঙ্গ। ব্রিটেনেও জাতীয় প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। হয়তো আগামী সময়ে যখন অন্যান্য দেশের উপাত্ত লভ্য হবে, তখন হয়তো দেখা যাবে যে সংখ্যালঘুরাই সংক্রমিত হয়েছিল বেশি এবং মৃত্যুর আপাতনও তাদের মাঝেই বেশি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে উচ্চতর সংক্রমণের কারণের কিছু কিছু কাঠামোগত এবং কিছু কিছু প্রায়োগিক। কাঠামোগত দিক থেকে বিচার করলে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী ঐতিহাসিক দিক থেকেই দরিদ্র, বঞ্চিত অসমতার শিকার। তারা স্বল্প শিক্ষিত, তাদের পুষ্টির অভাব রয়েছে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান নিম্ন। ন্যূনতম সামাজিক সুবিধাও তাদের কাছে লভ্য নয়। সুতরাং কাঠামোগত দিক থেকে তারা যেকোনো সংকট-ভঙ্গুর।

সেই সঙ্গে প্রায়োগিক অনেক কারণও এর সঙ্গে যুক্ত। কৃষ্ণাঙ্গরা বেশির ভাগই কর্ম-মইয়ের নিচের দিকে অবস্থান করে। ফলে একদিকে যেমন তাদের সঞ্চয় কম, অন্যদিকে কাজের জন্যে তাদের ঘরের বাইরে আসতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের জীবনযাত্রার প্রণালির কারণেও ঘরের মধ্যে সামাজিক জনদূরত্ব বজায় রাখা তাদের জন্যে কষ্টকর। তারা যেসব অঞ্চলে বসবাস করে, সেখানে স্বাস্থ্য সুবিধা সেবাও সীমিত। এসব প্রায়োগিক কারণেও তাদের করোনা-ভঙ্গুরতা বেশি। সুতরাং কাঠামোগত প্রায়োগিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে করোনার আপাতন মৃত্যুর হার বেশি।

করোনা সংকটের বৈশ্বিক প্রভাবকে তিনটি সময়সীমার পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করা যেতে পারেস্বল্পকালীন, মধ্যমেয়াদি দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্প মেয়াদে তিনটি বিরূপ অর্থনৈতিক প্রভাব পড়তে পারে বর্তমান করোনা সংকটের। প্রথমত কর্মহীনতা। যুক্তরাষ্ট্রে ৬৬ লাখ লোক কর্মহীন হয়ে পড়েছে, স্পেনে ৩৫ লাখ। ফলে তাদের কর্মসংস্থান, আয় জীবনযাত্রার মানের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। বিরূপ প্রভাবের মূল শিকার হচ্ছেন তারাই, যারা অদক্ষ শ্রমিক, সেবা খাতে কর্মরত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। দ্বিতীয়ত, খাদ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জোগান কমে যাওয়ায় খাদ্যসামগ্রীর লভ্যতা একটা বিরাট সমস্যায় পরিণত হয়েছে। শিশুরা এর এক বিরাট শিকার। খাদ্যসামগ্রীর আকালে দরিদ্র মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিঃসন্দেহে। তৃতীয়ত, এরই মধ্যে বিশ্ব অর্থবাজারে বেশ টালমাটাল অবস্থা দেখা দিয়েছে। নানান বিনিময় পত্রের দাম পড়ে গেছে, আর্থিক বাজারের গতিবিধি নিম্নমুখী, যাকে সামাল দেয়া যাচ্ছে না। দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য স্থবির হয়ে আছে।

মধ্যমেয়াদে আবারো তিনটি প্রবণতার দিকে দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। প্রথমত, বৈশ্বিক একটি মন্দা দেখা দেবে। তার ব্যাপ্তি গভীরতা হয়তো অভাবনীয় হবে। মন্দার ফলে দরিদ্র দেশগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেবে। দ্বিতীয়ত, দেশের মধ্যে উৎপাদন কাঠামো আরো বিপর্যস্ত হবে। ফলে উৎপাদন কর্মসংস্থান আরো সংকুচিত হবে। শ্রমজীবী মানুষ সেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জালে নিষ্পেষিত হবে। তৃতীয়ত, বহু ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে যাবেন।

দীর্ঘমেয়াদে বছরে কৃষিকাজে কর্মযজ্ঞ না হওয়ায় আগামী বছরে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আকাল বা দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেই সঙ্গে করোনা-মৃত্যুর আপাতন যদি বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর ওপরে পড়ে, তাহলে জনমিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশের নির্ভরতার হার কমে যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এমনও হতে পারে যে কর্তৃত্ববাদী অর্থনীতিগুলোই হয়তো সমস্যার সমাধান দ্রুত অল্প আয়াসে করতে পারবে। সেটা যদি হয়, তাহলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন হতে পারে।

সামাজিক দিক থেকে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নানান দিক থেকে বিঘ্নিত হচ্ছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হওয়ায় মানসিক চাপ পড়ছে সবার ওপর। ফলে মানুষের ধৈর্য সহনশীলতা যেমন লুপ্ত হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে সহিংসতা ঘরে-বাইরে। শিশু তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটি উদ্বেগজনক। বিদ্যালয়ে না যেতে পেরে, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা না করতে পেরে, একদিকে যেমন তারা বিষণ্ন হচ্ছে, খিটখিটে হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে সামাজিক পটুতা হারাচ্ছে। তরুণেরা তাদের অদম্য প্রাণশক্তিকে অবরুদ্ধ অবস্থায় কেমন করে ব্যবহার করবে তা জানে না। সত্যিকার অর্থে তাদের মনোজগতে একটা বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন মনোবৈকল্যের সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা।

আগে আমরা বাইরে বেরুলে দেখে নিতাম চাবি, চশমা, মুঠোফোন সঙ্গে আছে কিনা। এখন দেখি পরিষ্কারক, মুখাবরণী দস্তানা আছে কিনা সঙ্গে। আগে মুঠোফোন বাড়িতে ফেলে গেলে যে রকম অসহায় বোধ করতাম, এখন পরিষ্কারক, মুখাবরণী আর দস্তানা ফেলে গেলে তেমনই বোধ করি। হাত হয়ে উঠেছে আমাদের সবচেয়ে সুযত্ন সংরক্ষিত অঙ্গ এবং হাত মুখের বিচ্ছেদের জন্যে আমাদের সচেষ্ট থাকার প্রয়াস এখন রূপান্তরিত হয়েছে স্বাভাবিক অভ্যাসে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে করোনার অভিঘাত কী পড়বে? বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে করোনার অভিঘাত কী হবে? বলা বাহুল্য যে বৈশিক অভিঘাতের বিষয়গুলো বাংলাদেশের ওপরও প্রভাব ফেলবে।

করোনার কারণে বাংলাদেশের পর্যন্ত অর্জিত অর্থনৈতিক মানব উন্নয়ন বিঘ্নিত হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে কোটি ৪০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। করোনার কারণে আরো অতিরিক্ত তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শতাংশ বিচারে বাংলাদেশেও গত ত্রিশ দশকে চরম দারিদ্র্যের আপাতন ৪৪ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে নেমে এসেছিল। গত বছরে ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে পেরেছে। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন যে করেনার ফলে এটা বেড়ে আবার ৪০ শতাংশ হয়ে যেতে পারে।

করোনার কারণে বাংলাদেশ ১৬ লাখ কর্মসংস্থান হারাতে পারে। গত বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পোশাক শিল্পে ৭০ হাজার কর্মসংস্থান হারিয়ে গেছে এবং গত বছরের শেষ পর্যন্ত ১০ লাখ কর্মসংস্থান হারিয়ে যাবে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে। করোনা অতিমারী বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুরতাকে দৃশ্যমান করেছে এবং ভবিষ্যতে নাজুকতা বৃদ্ধি পেতে পারে। শিক্ষার ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাদান কাঠামো শিক্ষায় বর্তমান অসমতার ব্যাপ্তি গভীরতা আরো বাড়াতে পারে। কারণ প্রযুক্তির লভ্যতা গ্রামীণ অঞ্চল দরিদ্র পরিবারের শিশুদের কাছে অনেক কম হবে। সেই সঙ্গে এটাও সত্যি যে আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে এবং গৃহাভ্যন্তরে নারীর ওপর করোনার অসম প্রভাব পড়বে। আনুষ্ঠানিক খাতে নারীরা সবার আগে কর্মচ্যুত হয়েছে এবং যখন অর্থনীতি সচল হবে, তখন সবার শেষে নারীরা কর্মসুযোগ পাবে।

করোনা সংকটের কারণে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে তিনটি প্রভাব পড়বে। প্রথমত, আমাদের উচ্চপ্রবৃদ্ধির দুটো মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে পোশাক রফতানি বহির্বিশ্বে কর্মরত বাঙালি শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে করোনা সংকটের কারণে দুটো চালিকাশক্তির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। ফলে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার কমে আসবে এবং অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে। মন্দার কারণে কর্মসংস্থান কমে যাবে এবং বেকারত্ব বাড়বে। পোশাক শিল্পের হাজার হাজার কর্মী বেকার হয়ে পড়বেন এবং বিদেশে কর্মরত অদক্ষ শ্রমিকেরা কর্মহীন অবস্থায় দেশে ফিরবেন। এসব জনগোষ্ঠী তাদের পরিবারের ওপর বিরাট অর্থনৈতিক চাপ পড়বে। সেই সঙ্গে বর্তমানে তেলের দাম যে বাড়ছে, তার ফলে বাংলাদেশকে তেল আমদানির জন্যে একদিকে যেমন আমাদের অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হবে, তেমনি মূল্যস্ফীতিতে এটা একটা বিরাট ভূমিকা রাখবে। বছর যদি কৃষি খাতে কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়, তাহলে আগামী বছর কৃষি উৎপাদন কমে যেতে পারে, কমে যেতে পারে খাদ্যসামগ্রীর লভ্যতা। খাদ্য সংকটের সেসব প্রতিক্রিয়ার কিছু কিছু তে এখনই দেখা যাচ্ছে। গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ হওয়ার কারণে বহু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখন বন্ধ। দোকান খোলা নেই, কারখানায় কাজ হচ্ছে না, লোকজন বাইরে বেরুচ্ছে না। ফলে যারা দিন এনে দিন খায়, তাদের আয়ের পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ। এর মধ্যে রয়েছে দিনমজুর, রিকশাচালক, বাজারের ক্ষুদ্র বিক্রেতারা, যারা রাস্তার পাশে বেসাতি সাজিয়ে বসত এবং এমন অজস্র মানুষ। বহু বাড়িতে সাহায্যকারী গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের আয়ও বন্ধ হয়ে গেছে। উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। অবরুদ্ধ জীবনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলাফল এটি। ছোট ছোট ব্যবসায়ী উৎপাদনকারীরা দেউলিয়া হয়ে যাবেন। দিনের পর দিন সেসব প্রতিষ্ঠান নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে সেগুলো সচল থাকতে পারবে না। তাদের এমন কেন সঞ্চয় নেই যে তারা ক্রমাগত ক্ষতি দিয়েও টিকে থাকতে পারবে।

বাংলাদেশে সংকটের আর্থসামাজিক প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে নানা কথা উঠে এসেছেকর্মসংস্থানের ঘাটতি, আয়ের অপ্রতুলতা, সামাজিক সেবার অনুপস্থিতি ইত্যাদি। তবে যে সমস্যা সবচেয়ে প্রকট বলে আবির্ভূত হয়েছে তা হচ্ছে খাদ্য অনিরাপত্তা, বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য। তাদের কাজ নেই, আয় নেই, সঞ্চয় নেইতারা দিন এনে দিন খায়। ফলে কাজ, আয় সঞ্চয়ের অভাবে তাদের খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এরই মধ্যে বলা হচ্ছে যে দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ বা কোটি মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। আগামীতে প্রায় কোটি পরিবার খাদ্য সংকটের শিকার হবে।

করোনার কারণে বাংলাদেশে অসমতা বৃদ্ধি পেতে পারে বিত্তবান বিত্তহীনদের মধ্যে, বঞ্চিত সুবিধাভোগীদের মধ্যে এবং গ্রামাঞ্চল নগরের মধ্যে। বৈষম্য শুধু বাড়বে ফলাফলে নয় (যেমন আয়ের ক্ষেত্রে), অসমতা বাড়বে সুযোগের ক্ষেত্রেও (যেমন শিক্ষা সেবার ক্ষেত্রে) কতগুলো নাজুক জনগোষ্ঠী (যেমন বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী) অসমতা বৈষম্যের সবচেয়ে বড় শিকার হবে।

করোনার কারণে বিত্তবান বিত্তহীনতদের মধ্যে অসমতা বৃদ্ধির একটি চালিকাশক্তি হবে কর্মসংস্থান আয়ের প্রক্রিয়া। করোনাকালে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দিন এনে যারা দিন খায় তারা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ শ্রমিকেরা, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যারা কাজ করে তারা। করোনা যখন সবাইকে অবরুদ্ধ করে দিয়েছে, সাধারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন বিঘ্নিত হয়েছে, তখন জাতীয় মানুষদের কর্মসংস্থান নষ্ট হয়েছে, তাদের আয়ের পথ রুদ্ধ হয়েছে। বিত্তবানদের মতো তাদের কোনো সঞ্চয়ও নেই, যা তারা ব্যবহার করতে পারে জীবনধারণের জন্য। করোনা থেকে উত্তরণের কালেও বিত্তবানেরা যত দ্রুত সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে, দরিদ্র প্রান্তিক মানুষ তা পারবে না। যেমন এরই মধ্যে বলা হচ্ছে যে করোনার কারণে ভারতের অনানুষ্ঠানিক খাতে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বহির্বিশ্বে চাহিদা সংকোচনের কারণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ২০ লাখ কর্মী, যার বেশির ভাগই নারী, কাজ হারাতে পারেন। ফলে আয় ভোগের অসমতা বৃদ্ধি পাবে। 

[চলবে]

 

সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

আরও