সবার মধ্যে সংযোগ ও সচেতনতা তৈরি এই পলিসি কনক্লেভের একটি বড় উদ্দেশ্য। সার্বিকভাবে খাদ্যপণ্যের যৌক্তিক দাম কী হতে পারে তা নিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন প্যানেলিস্ট তাদের জায়গা থেকে বিভিন্ন মতামত ও পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। বিভিন্ন জন থেকে বিভিন্ন পরামর্শ ও প্রস্তাব এসেছে। তা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সে ব্যাপারে আমরা কাজ করব। আজকের মূল প্রবন্ধ আলোচনায় আলোচক বলার চেষ্টা করেছেন, কেন আমাদের স্বল্পমেয়াদি সমাধান খোঁজার চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকে নজর দেয়া উচিত। সে উদ্দেশ্য সামনে রেখেই আসলে এই পলিসি কনক্লেভটি আয়োজিত হয়েছে, যাতে সব ধরনের অংশীজনের কথা আমলে নেয়া যায়।
- আজকের মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে, কীভাবে গত ১৫ বছর ৬ শতাংশ স্থিতিশীল মূল্যস্ফীতির চিত্র দেখেছি। শুধু যে মূল্যস্ফীতি তা-ই নয়, জিডিপির আকার, ব্যাংকের সুদহার, কর-জিডিপি অনুপাত, ঋণ-জিডিপি অনুপাত এমনকি বিনিময় হারও অনেক দিন ধরে কৃত্রিমভাবে স্থিতিশীল রেখেছি। এ সবগুলোর সমন্বিত প্রভাব পড়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। এ বিষয়টি মোকাবেলা করা অতটা সহজ নয়। অর্থনীতিতে যে সংকট চলে আসছে তা অনুধাবন এবং সমাধানে দায় অনুভব করার জন্য এ আয়োজন। চালের ক্ষেত্রে আমরা একটা কৌশল নেয়ার কথা ভাবছি। খোলা বাজার থেকে এখনই ক্রয় করতে সরকার চাচ্ছে না যাতে বাজারে সরবরাহ বাড়ে। সরকার প্রয়োজনে বিদেশ থেকে আমদানি করবে। মূল প্রবন্ধ আলোচক বলেছেন চালের বাজারে ১২টি ধাপে মূল্য নির্ধারিত হয়। এটা ঠেকাতে কী করা যায় সে ব্যাপারে আমরা শিগগিরই বসব।
- খাদ্যপণ্যের মূল্যে যে তারতম্য ঘটে এটা আসলে উপসর্গ, সমস্যা অন্য জায়গায়। সমস্যাটা প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেয়া থেকে শুরু। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর বায়তুল মোকাররমের খতিবও যখন পালিয়ে যান, তখন বোঝা যায় এমন কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না যাকে ধ্বংস করা হয়নি।
- আমলাতন্ত্র থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, বিচার ব্যবস্থা, একাডেমিয়া, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় সব কিছুর মধ্যেই আমরা অপরাধী চক্রের যোগসাজশ দেখেছি। এর ফলে যে সমন্বিত দায় তৈরি হয়েছে এবং এটা থেকে বের হওয়ার যে রাস্তা সেটা খুব সহজে অর্জন করা সম্ভব নয়। কারণ দেখা গেছে যে প্রায় পাঁচ মাস ধরে এ (অন্তর্বর্তী) সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছে, এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ সময়ই গেছে বিভিন্ন মদদে তৈরি অস্থিরতা নিবারণ করতে। সেটা শ্রমিক অসন্তোষ, আনসারের অসন্তোষ বা বিভিন্ন বিচার বিভাগীয় সমস্যা হোক—একটা বেশ টালমাটাল সময় গেছে। তবে আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনেছি ধর্মের কল বাতাসে নড়ে এবং সেজন্যই আজকে আমরা সবাই এখানে সমাগত হয়েছি। আমরা জানতে এসেছি আমাদের দায়টা কী? সার্বিকভাবে এটা উপলব্ধির মাধ্যমেই আমাদের কর্মসমষ্টি নির্দিষ্ট করা হবে।
- যেমন কারওয়ান বাজার সমিতি থেকে রসিদ সিস্টেমকে বাস্তবায়ন করার সুপারিশ এসেছে। যদি সম্ভব হয় আমরা অবশ্যই সেটি বাস্তবায়ন করতে পারি। এছাড়া আমরা সুপার মার্কেট ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের থেকে সুপারিশ পেয়েছি করজালের আওতা বাড়ানোর ব্যাপারে। তবে আমার মতে, কর বৃদ্ধির টার্গেট আমাদের খুব একটা হওয়া উচিত নয়। কারণ আমাদের যে সক্ষমতা আছে, সে তুলনায় ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাতে আমরা একটা লজ্জাজনক অবস্থানে রয়েছি। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা কোনো কার্যকর প্রভাব তৈরি করতে পারিনি, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারিনি। আমরা উদ্যোগনির্ভর কর আদায়ের পরিবেশ এখনো সৃষ্টি করতে পারিনি। এর একটা উদাহরণ হলো চিনির ওপর সবচেয়ে মাত্রাতিরিক্ত করারোপ করা আছে, কারণ আমাদের দেশের অধিকাংশ চিনিই আমদানীকৃত। দেশীয়ভাবে উৎপাদিত ৪০-৫০ টন চিনির চেয়ে চাহিদার পরিমাণ প্রায় ৫০ গুণ বেশি। দেশে চাহিদা অনুযায়ী চিনি উৎপাদন করা সম্ভব কিনা সেটা আমাদের অনুসন্ধান করে দেখতে হবে, কিন্তু যে বিষয়ে এখানে আলোকপাতের চেষ্টা করছি সেটা হলো বন্দর দিয়ে আমদানীকৃত চিনির ওপর সহজে শুল্ক বসানো সম্ভব। এ রকম আরেকটি সহজ শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্র হলো টেলিকম বা ইন্টারনেট সার্ভিস। এ রকম যে ক্ষেত্রগুলো থেকে সহজেই ট্যাক্স আদায় সম্ভব সেসবে আমরা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ট্যাক্স চাপিয়ে দেয়ায় ভোক্তাদের ব্যয় বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে সরকার কেন এ পথ অনুসরণ করে?
- সরকার এ পথ অনুসরণ করে কারণ সরকারের যে পরিচালন ব্যয় সেটা মেটানোর জন্য সরকারকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করতে হয় যেগুলোয় উচ্চমূল্যের সুদহার দেয়া হয়। এ সুদহার জোগানের জন্য এ রকম ট্যাক্স চাপিয়ে দেয়া হয়। এখন আমাদের সময় এসেছে এটা নিয়ে ভাবার; কর ও শুল্ক আরোপের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার।
- ১৯৯১ সালে যখন সর্বপ্রথম তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ভ্যাট আইন প্রবর্তন করেন সেটা আমাদের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। পরে বিভিন্ন সময় এটায় সংযোজন-বিয়োজন করে অনেকটা অকেজো করে ফেলা হয়। এরপর ২০১২ সালে যখন নতুন ভ্যাট আইনে সুন্দর সুন্দর সব প্রস্তাব আনা হলো, দুঃখজনক হলেও সত্য যে ব্যবসায়ীরা এটা বাস্তবায়ন করতে দেননি। কারণ এটি বাস্তবায়ন হলে অনেক বেশি স্বচ্ছতা নিশ্চিত হতো। এ স্বচ্ছতা ব্যবসায়ীরা চাননি। সুতরাং মূল্যের এ তারতম্য হলো একটি উপসর্গ। এটি সমস্যা নয়।
- আমার বিবেচনায় আমাদের মৌলিক সমস্যা সম্পদের অসমতা। আমাদের সম্পদবৈষম্যের জন্য যেসব অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করা হয় সেটা ধনিক শ্রেণীকে সাহায্য করার জন্যই হয়। ভোক্তা-জনসাধারণকে প্রকৃত অর্থে সাহায্য করার জন্য সরকারের দায়বদ্ধতা থেকে নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে অনেক বাধা রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেয়া। সেজন্য নির্দিষ্ট কতগুলো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে আরো কত বেশি ধনসম্পদশালী করা যায়, সেই লক্ষ্য সামনে রেখে অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল। এটাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সুতরাং এখন প্রশ্ন উঠছে, আমরা কীভাবে এটাকে মোকাবেলা করব?
- আমরা গত ১৫ বছরে দেখেছি, দেশে তেমন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ব্যতীত বাংলাদেশে কেউ তেমন বিনিয়োগই করেনি। যদি বিনিয়োগ না হয় তাহলে আমাদের কীভাবে রাজস্ব আদায় বাড়বে, কীভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে। কীভাবে সম্পদের সুষম বণ্টন হবে!
- এখন এসব বিষয়ে মৌলিক চিন্তা করার সময় এসেছে। সেজন্য আমার কাছে মনে হয় যে করজালের আওতা বাড়ানোর চেয়ে কর ন্যায্যতা সৃষ্টি করা, কর আদায়ের ক্ষেত্রে একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা এবং বিচ্ছিন্ন তৎপরতার পরিবর্তে ব্যবসায়ীদের জন্য নির্দিষ্ট খাতভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমরা এ সংগতি তৈরি করতে পারলে, আমি নিশ্চিত যে বর্তমান সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ভ্যাট আদায় করা সম্ভব হবে। আর ভ্যাট অর্জন করতে পারলে কর বাড়বে। কারণ ব্যবসায়ীরা যখন ভ্যাট ফাঁকি দেয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সে চাইলেও কর দিতে পারে না। কারণ তার তো ব্যবসায় কোনো লাভ নেই। তার পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি সীমাবদ্ধ করতে হচ্ছে, তাহলে সে কর কোথা থেকে দেবে? সেজন্য আমার মতে, ভ্যাটের জন্য আরো মৌলিকত্বের দাবিদার সংবেদনশীল চিন্তা করতে হবে।
- এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত রাইস মিল মালিকদের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে আমরা শুনেছি অনেকে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছেন। তারা একটা নির্দিষ্ট টার্ম ‘ওরা ১১ জন’ নামক একটি শক্তিশালী চাল মিলের সিন্ডিকেটের কথাও উল্লেখ করেছেন। এটা সত্যি যে এ খাতের ব্যবসায়ীরা ক্রমে প্রান্তিকতার শিকার হচ্ছেন। আবার এটাও সত্য যে তারা অনেক অপ্রয়োজনীয় ও অলাভজনক খাতেও বিনিয়োগ করে নিজেদের বিপত্তি নিজেরাই ডেকে আনেন। এছাড়া ব্যবসায়ীরা নানা রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় যুক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যেও অনেক সমস্যার সৃষ্টি করছেন। এটা নিয়েও আমাদের ভাবা উচিত।
- আবার ডিমের ব্যবসায়ীরা খোলা বাজারের সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলছেন। একই সঙ্গে আমাদের ব্যাংক ব্যবস্থায় গত ১৫ বছরে ক্রিমিনালাইজেশন ঘটেছে। আমরা দেখেছি, ইসলামী ব্যাংকের মতো এত বড় একটা ব্যাংককে কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। একজন সাবেক ব্যবসায়ী ও এ ব্যাংকের একজন গ্রাহক হিসেবে সরাসরি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাদের পতনের সাক্ষী হওয়ার যে কী পরিমাণ দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে ব্যাংকটিতে, এ ব্যাংক আইনে কী পরিমাণ দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। ব্যাংকের মালিকরা নিজেদেরকেই ব্যাংকের সব কর্মকাণ্ডের হর্তাকর্তা হিসেবে মনে করেন, একই পরিবারের একাধিক সদস্য বসে পড়েন পরিচালকদের পদে। সবিশেষে ব্যাংক পরিণত হয় মালিকানাধীন কোম্পানিতে। বর্তমানে আমরা এনপিএলের (নন-পারফর্মিং লোন) কথা শুনছি যে ৭০-৮০ শতাংশ, আবার কিছু কিছু ব্যাংকে ৮৫-৯০ শতাংশ নন-পারফর্মিং লোন সৃষ্টি করা হয়েছে, অবিশ্বাস্য লাগে। কীভাবে এমনটা সম্ভব হয়? এসবের বিরুদ্ধে আমাদের সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, যেটা এখনো হয়নি দেখে আমার আফসোস হয়। এটা করা অতীব জরুরি। কারণ এতে আমাদের অর্থনীতিতে এ বার্তা দেয়া সম্ভব যে একদিন না একদিন দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন হবেই।
- এখানে আসার আরেকটি প্রধানতম উদ্দেশ্য হলো, টিসিবির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আপনাদের অবহিত করা। টিসিবি প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার পণ্য ক্রয় করে। অর্থাৎ তারা বেশ বড় একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু কীভাবে এত বড় একটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে মাত্র ১৪২ জনের লোকবল এ ১২ হাজার কোটি টাকার লেনদেনকে পরিচালিত করে। সেটা খুবই দুঃখজনক একটা বিষয়। খুবই অল্প কিছু লোক টিসিবিতে ব্যবসা করেন এবং শুধু তারাই এর ডিপিএমে অংশগ্রহণ করেন বা ওটিএমে অংশগ্রহণ করেন। সুতরাং এখানে একচেটিয়া বাণিজ্যের সৃষ্টি করা হয়েছে। আজকে (অনুষ্ঠানে) যারা ব্যবসায়ীরা আছেন, আমি আপনাদের অনুরোধ করব, দয়া করে এখানে অংশগ্রহণ করুন।
- এর মাধ্যমে আপনাদের সওয়াব হবে, কারণ টিসিবি ভর্তুকি মূল্যে বাজারে পণ্য বিক্রি করে। যে কারণে এর মাধ্যমে আপনাদের প্রান্তিক জনগণকে সাহায্য করার সুযোগ ঘটবে। দ্বিতীয়ত, আপনাদের অংশগ্রহণ করার স্বার্থে টিসিবির পণ্যের টেন্ডারের যে পরিমাপ সেটাকে আমি ছোট করে দেব যাতে অধিক সংখ্যক ব্যবসায়ী এটায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। উপরন্তু আপনাদের পেমেন্টের ব্যাপারে এরই মধ্যে টিসিবির চেয়ারম্যান বলেছেন যে এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিত করা হবে। সুতরাং নিশ্চিত থাকুন যে আপনারা আপনাদের প্রাপ্য টাকা পাবেন। প্রান্তিক পর্যায়ের প্রায় এক কোটি জনগোষ্ঠীকে টিসিবি খাদ্য সরবরাহ করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে। আপাতদৃষ্টিতে শুনতে ভালোই লাগে। কিন্তু প্রতি বছর এখানে নতুন নতুন জনগোষ্ঠী সংযুক্ত হচ্ছে প্রচলিত সম্পদবণ্টনের বৈষম্যের শিকার হয়ে। সেই জায়গা থেকে রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে যে সে কি প্রতি বছর টিসিবির সরবরাহই শুধু বাড়াতে উদ্যোগ নেবে, নাকি নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে এ জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বাড়িয়ে তাদের প্রান্তিকতা থেকে বের করবে। কোনটা বেশি জরুরি?
- আবার দুঃখজনকভাবে টিসিবিতেও যেভাবে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে, সেখানে ডিলার থেকে শুরু করে প্রকিউরমেন্ট (অনুদানের বিভাজন) সবখানেই। সবচেয়ে খারাপ হলো খাতা-কলমে৷ এক কোটি উপকারভোগীর ওপর আমরা যখন সাধারণ কিছু উপাত্ত সংগ্রহ করে দেখেছি তখন বোঝা গেল যে এটা আদতে ৫৭ লাখে নেমে এসেছে। এটা একদম প্রাথমিক ডাটা। এ উপাত্তকে যদি আরো পরিশুদ্ধ করা হয় তাহলে আমার ধারণা, সংখ্যাটি আরো ২০-২৫ লাখ হ্রাস পাবে। এই যে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে তার একটি নমুনা হলো—উপকারভোগীদের ঘরে ঘরে আমি গিয়েছি, নিজে যখন জিজ্ঞাসা করেছি, আপনার কার্ড যদি কেটে দেয়া হয় আপনার কী সমস্যা হবে? আমাকে তারা জানিয়েছে যে আল্লাহর রহমতে হবে না! তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, কেন এ লোকগুলোকে কার্ড দেয়া হয়েছে। একই বাড়িতে দু-তিনটা করে কার্ড দেয়া হয়েছে। আবার দালানবাড়িতে বসবাসকারী পরিবারকে টিসিবির কার্ড দেয়া হচ্ছে। এগুলোর সংশোধনে আমরা এখনো হাত দিইনি, কিন্তু সামনে করব। আমি নিজে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে আরো উপাত্ত সরজমিনে দেখে এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব এবং যেহেতু আমাদের ম্যান্ডেট আছে এক কোটিতে এটাকে নিয়ে যাওয়া, সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা প্রকৃত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করব। সেজন্য ব্যবসায়ীদের আবারো অনুরোধ করব আপনারা দয়া করে টিসিবির ব্যবসায়ে অংশগ্রহণ করুন।
- বাংলাদেশের ভোগ্যপণ্যের আমদানিতে দীর্ঘদিন ধরে বড় ভূমিকা পালন করে আসছিলেন এস আলম গ্রুপ। তবে সম্প্রতি এস আলমের অনুপস্থিতি ও দেশত্যাগের পর বাজারে নানা গুঞ্জন ছড়িয়েছে। আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছি, যাতে কোনো বড় সংকট সৃষ্টি না হয়। আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো বিপদ দেখা দেয়নি এবং আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, রমজান মাসেও ইনশাআল্লাহ কোনো সমস্যা হবে না।
- আমাদের আমদানীকৃত ভোগ্যপণ্যের মধ্যে চিনি, তেল, ছোলা, খেজুরসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্য রয়েছে। এছাড়া কিছু কৃষিপণ্য, যেমন পেঁয়াজ ও আলু আমদানি করা হয়, যা নির্ভর করে বাজারের চাহিদার ওপর। তবে স্পষ্ট করে বলতে চাই, আল্লাহর রহমতে বর্তমানে বাজারে কোনো সংকট নেই।
- সম্প্রতি তেলের বাজার নিয়ে কিছু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আমাদের দেশে কয়েকজন বড় উৎপাদক ও রিফাইনারি রয়েছেন, যারা ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) ও সাপ্লাই অর্ডার (এসও) নিয়ন্ত্রণ করেন। কিছু ব্যবসায়ী ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী মিডিয়ার মাধ্যমে সংকট রয়েছে বলে প্রচার চালিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করতে চান, যার ফলে মজুদদাররা সুযোগ নিতে পারে।
- আমি বিশেষভাবে মিডিয়াকে অনুরোধ করব—সংবাদ প্রকাশের আগে ভাবুন, এটি কাদের স্বার্থ রক্ষা করছে? কারা লাভবান হচ্ছে? আপনার সংবাদ কি মজুদদারদের পক্ষ নিচ্ছে, নাকি সাধারণ ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করছে?
- সরকার বেকায়দায় পড়তে পারে, কিন্তু বাজারে যে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা ও দুর্বৃত্তায়ন তৈরি হয়েছে তা স্বীকার করতে হবে এবং তার সমাধান খুঁজতে হবে।
- আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ করে আমরা দেখছি, পণ্যের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই, বরং দাম কমার কথা। আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চাই না, বরং প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে চাই। এজন্য প্রতিযোগিতা কমিশন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, টিসিবি, ট্যারিফ কমিশন ও এনবিআর একসঙ্গে কাজ করছে, যাতে বাজার ভোক্তাদের জন্য সহনীয় হয়।
- আমি প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরো কার্যকর করতে উদ্যোগ নিয়েছি। কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে বলেছি—নির্দ্বিধায় প্রয়োজনীয় সংস্কার করুন। কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে, যাতে প্রতিযোগিতাবিরোধী কার্যক্রম রোধ করা যায়।
- আমরা বাজার বিশ্লেষণ করছি এবং দেখছি, কিছু ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে সংকট তৈরি করতে চাইছে। তবে সরকার এ বিষয়ে সম্পূর্ণ সতর্ক। বাজার পরিস্থিতি বুঝতে আমরা সরকারি সংস্থা, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিকদের সমন্বয়ে একটি নির্দিষ্ট TOR (Terms of Reference) তৈরি করছি, যার মাধ্যমে উৎপাদক থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত পুরো মূল্য চেইন বিশ্লেষণ করা হবে।
- আমরা কোনো কিছু অনুমানের ভিত্তিতে বলতে চাই না। চাঁদাবাজি হচ্ছে কিনা, হলে কোথায় হচ্ছে, কত টাকা হচ্ছে—এসব নির্দিষ্টভাবে জানতে হবে, যাতে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।
- আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ তেলবীজ উৎপাদন ও তেলশিল্পের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। বাংলাদেশে বছরে পাঁচ-ছয় লাখ টন উন্নতমানের রাইস ব্র্যান অয়েল উৎপাদিত হয়, যা আগে ভারতে রফতানি করা হতো। আমরা এ রফতানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছি, যাতে এ তেল দেশের বাজারে সরবরাহ করা যায়। ফলে আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমবে এবং বাজার স্থিতিশীল হবে।
- আমদানীকৃত ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত তেলের ডিউটি পার্থক্য এতটাই কমানো হয়েছে যে এখন চাইলে রিফাইনারিরা ফিনিশড তেলও আমদানি করতে পারেন। এতে বাজার আরো প্রতিযোগিতামূলক হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করে কমোডিটি রিফাইন্যান্সিং স্কিম চালুর চেষ্টা চলছে, যাতে সুদ ব্যয়ের কারণে মূল্যের ওপর যে চাপ পড়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
- বাংলাদেশে তেলবীজ ভাঙানোর যে ফ্যাক্টরিগুলো রয়েছে, সেগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে ট্যারিফ কমিশন ও এনবিআর কাজ করছে। আশা করছি, স্থানীয় উৎপাদন বাড়লে বাজার আরো স্থিতিশীল হবে।
- বিগত সরকার তেলের মধ্যে ভিটামিন ফর্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক করার একটি আইন পাস করেছিল। আমরা এটি নিয়ে গবেষণা করছি—ফর্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক থাকবে, নাকি ঐচ্ছিক করা হবে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গবেষণা ও পরামর্শের ভিত্তিতে নেয়া হবে।
- এখন সারা দেশে খোলা তেল বিক্রির অনুমতি দেয়া হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এক মাস ধরে খোলা তেল ব্যবহার করছি এবং আমার পরিবারও একই অভ্যাস অনুসরণ করছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, খোলা তেল ও প্যাকেটজাত তেলের মধ্যে কার্যত পার্থক্য নেই, পার্থক্য শুধু দামে। অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয়ভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে।
- আমার বাবা বোতল ভরে খোলা তেল নিয়ে আসতেন, যা পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী ছিল। আমরা চাই, বাজারে পছন্দের সুযোগ বজায় থাকুক—যারা প্যাকেট তেল খেতে চান, তারা খেতে পারেন, আর যারা খোলা তেল ব্যবহার করতে চান, তাদের জন্যও সুযোগ থাকবে।
- বাজারে কোনো একক পদক্ষেপে স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব নয়। সরকার, ব্যবসায়ী, গণমাধ্যম ও ভোক্তা—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আশা করি, রমজানসহ আগামী দিনগুলোয় আমাদের বাজার প্রতিযোগিতামূলক থাকবে এবং খাদ্যপণ্যের যুক্তিসংগত মূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
শেখ বশির উদ্দিন: বাণিজ্য উপদেষ্টা
[বণিক বার্তা আয়োজিত ‘খাদ্যপণ্যের যৌক্তিক দাম: বাজার তত্ত্বাবধানের কৌশল অনুসন্ধান’ শীর্ষক পলিসি কনক্লেভে প্রধান অতিথির বক্তব্যে]