বর্তমান
সময়ের সংকট,
ব্যাপ্তি, সময়রেখা
দেখে আমার
মনে হচ্ছে,
বিশ্বে এক
‘নতুন
স্বাভাবিকতা’ আবির্ভূত
হচ্ছে অন্তত
মধ্যমেয়াদে। তবে
তার মেয়াদ
দীর্ঘও হতে
পারে। এ
নতুন স্বাভাবিকতা
প্রভাব ফেলবে
ব্যক্তিজীবনে, সমাজ
জীবনে এবং
রাষ্ট্রীয় জীবনেও।
ফলে মানুষের
মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি,
ব্যবহার যেমন
বদলাবে, তেমনি
বদলাবে মানুষের
চারপাশ, পারিপার্শ্বিকতা।
মানুষের সঙ্গে
মানুষের সম্পর্কও
কি নতুন
রূপ নেবে
না?
এখন রাস্তায়
বেরোলে তিনটে
বিষয় বড়
চোখে পড়ে।
এক. সামাজিক
জনদূরত্ব বজায়ের
জন্য শারীরিক
দূরত্ব নিশ্চিত
করা; দুই.
হাতে দস্তানা
ও মুখে
মুখাবরণী পরিধান
এবং তিন.
ন্যূনতম সময়ে
অপরিহার্য কাজগুলো
শেষ করা।
এ সবগুলো
মিলিয়ে আগামীতে
হয়তো নিম্নোক্ত
বিষয়গুলোই মানুষের
কাছে নতুনভাবে
স্বাভাবিক হয়ে
যাবে।
মানুষ হয়তো
স্বতঃস্ফূর্তভাবেই একে
অন্যকে এড়িয়ে
চলবে। নৈকট্য
নয়, দূরত্বই
মানুষের কাছে
স্বাভাবিক মনে
হবে। মানুষের
সঙ্গ হয়তো
তখন বিরল
ঘটনা হয়ে
যাবে। মানুষ
মানুষকে সম্ভাষণের
জন্য করমর্দন,
চুম্বন, স্পর্শ
এড়িয়ে যাবে।
তার বদলে
জায়গা করে
নেবে মৌখিক
প্রীতি সম্ভাষণ,
হস্ত উত্তোলন,
হস্তদ্বয় একত্র
করে শ্রদ্ধা
জানানো। মানুষকে
দেখে দূর
থেকেই তৃপ্ত
থাকব, কাছে
যাব না।
কে জানে,
হয়তো প্রিয়জনদের
ক্ষেত্রেও এমন
সতর্কতা বজায়
রাখব। নৈকট্য
নয়, দূরত্বই
হয়তো সেখানে
রীতি হয়ে
যাবে।
সতর্কতাই হবে
আমাদের জীবন
প্রক্রিয়ার মূল
চালিকাশক্তি। স্পর্শ
এড়িয়ে চলব
প্রতি পদক্ষেপে।
সদা সতর্ক
থাকব, যাতে
কিছুতে হাত
না লাগে,
কিছু না
ছুঁই, কোনো
কিছু না
শুঁকি। ফুলের
গন্ধ নেব
না, কচি
কিশলয় ছুঁয়ে
দেখব না
তার নরমত্ব,
কাঠের মসৃণতা
উপভোগ করা?
নৈব নৈব
চঃ। যদি
হাত লেগেই
যায় কিছুতে,
ধৌত করা
হবে সে
হাত বারবার।
বাইরে থেকে
জিনিস এলে
আগের মতো
নির্দ্বিধায় ছোঁব
না। রেখে
দেব সেগুলোকে
পূর্বনির্ধারিত স্থানে
কিছুক্ষণ, সাবান
জলে ধোয়া
হবে তাদের
তারপর তারা
আমাদের হস্তস্পর্শ
পাবে।
মন খারাপ
করে, তবু
আমার কেন
জানি মনে
হয় মানুষে
মানুষে সন্দেহ,
নির্বিকারত্ব, নির্লিপ্ততা
বেড়ে যাবে।
পথে-ঘাটে
চেনা-পরিচিতদের
দেখলে আমরা
আগের মতো
এগিয়ে যাব
না, নিরাপদ
দূরত্ব বজায়
রেখে সামাজিকতা
বজায় রাখব।
রাস্তার দুই
পাশ থেকেই
কথা বিনিময়
হবে, আগের
মতো রাস্তা
পেরিয়ে তার
কাছে যাব
না। যেকোনো
জায়গায় দাঁড়ালেই
চোখ রাখব
কেউ কাছে
চলে এল
কিনা। সরে
সরে যাব
ক্রমাগত এক্কা-দোক্কা
খেলার মতো।
কেউ ১০
ফুট দূরে
স্বাভাবিক হাঁচি
বা কাশি
দিলেও সচকিত
হয়ে যাব।
সন্দেহের চোখে
তাকাব তার
দিকে। তিনিও
হয়তো জানাবেন
যে তিনি
কভিডমুক্ত। তবু
আমাদের হাত
নিজের অজান্তেই
চলে যাবে
পকেটে বা
ব্যাগে পরিষ্কারক
বার করার
জন্য।
স্বাভাবিক সাধারণ
জ্বর-কাশি
হলেও প্রথমেই
মনে হবে
কভিড নয়
তো? উপসর্গ
মেলাতে বসে
যাব। চিকিৎসক
ফোন পাবেন
অচিরেই। ঘরের
মধ্যেও আলাদা
করে নেব
নিজেকে। বাড়ির
লোকেরাও সঙ্গ
এড়িয়ে চলবেন
আমার।
অনতিবিলম্বে আনিয়ে
নেব কভিড
পরীক্ষাসামগ্রী। পরীক্ষা
করে এবং
তার নেতিবাচক
ফল পেয়ে
তবে শান্তি।
এখন আমরা
বাইরে বেরোলে
দেখে নিই
চাবি, চশমা,
মুঠোফোন সঙ্গে
আছে কিনা।
ভবিষ্যতে দেখে
নেব পরিস্কারক,
মুখাবরণী ও
দস্তানা আছে
কিনা সঙ্গে।
আজকাল মুঠোফোন
বাড়িতে ফেলে
গেলে যে
রকম অসহায়
বোধ করি,
আগামীতে পরিষ্কারক,
মুখাবরণী আর
দস্তানা ফেলে
গেলে তেমনই
বোধ হবে।
হাত হয়ে
উঠবে আমাদের
সবচেয়ে সযত্ন
সংরক্ষিত অঙ্গ
এবং হাত
ও মুখের
বিচ্ছেদের জন্য
আমাদের বর্তমান
সচেষ্ট থাকার
প্রয়াস তখন
রূপান্তর হবে
স্বাভাবিক অভ্যাসে।
মানুষের চারপাশ
আর পারিপার্শ্বিকতায়
বহু পরিবর্তন
নতুন স্বাভাবিকতার
অঙ্গ হয়ে
দাঁড়াবে। মানুষে
মানুষে বন্ধনে
ভিত করে
নেবে তথ্যপ্রযুক্তি
আরো জোরেশোরে।
মুঠোফোনের বর্ধিত
এবং সম্প্রসারিত
ব্যবহার আমাদের
দৈনন্দিন জীবনে
আরো গেড়ে
বসবে। পারস্পরিক
সংবাদ আদান-প্রদান
ও কুশল
বিনিময় সবটাই
হয়তো হবে
ওই মুঠোফোনে।
চারপাশের তথ্য
ও খবরাখবর
পাওয়া, ছবি
বিনিময় ইত্যাদির
জন্য আমরা
বিরাটভাবে নির্ভর
করব সামাজিক
মাধ্যমের ওপর।
জ্ঞান আহরণ,
যৌথ কর্মকাণ্ডের
জন্যও এগুলোই
হবে আমাদের
প্রধান বাহন।
কিন্তু এর
ফলে সমাজে
এক নতুন
ধরনের বৈষম্যও
তো জন্ম
নেবে। আমরা
জানি, তথ্যপ্রযুক্তিতে
সমাজের সব
গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ
সমান নয়।
সেখানে বৈষম্য
আছে। তথ্যপ্রযুক্তি
ধনিক জনগোষ্ঠীর
কাছে যতখানি
লভ্য, দরিদ্র
জনগোষ্ঠীর কাছে
ততখানি নয়।
এখন শিক্ষা
পাঠদানের ক্ষেত্রে
তথ্যপ্রযুক্তিই যদি
মূল বাহন
হয়, তবে
তা থেকে
সমাজের বিত্তবান
শ্রেণী যতখানি
সুবিধা পাবে,
বিত্তহীন শ্রেণী
ততখানি পাবে
না। ফলে
শিক্ষা আরো
বিলাস সামগ্রীতে
পরিণত হবে
এবং এর
সর্বজনীনতার দিকটি
আরো সংকুচিত
হবে।
বহু প্রাতিষ্ঠানিক
ও সামাজিক
আচার-অনুষ্ঠানের
জন্যও আমরা
মানুষের শারীরিক
উপস্থিতি এড়িয়ে
চলব, সেগুলো
হয়তো সম্পন্ন
করা হবে
সামাজিক মাধ্যমগুলো
ব্যবহার করে।
এই যেমন
জন্মদিন পালন,
বিবাহ, বিভিন্ন
দিন উদযাপন।
লোক উপস্থিতির
পরিবর্তে যন্ত্র
ব্যবহারের মাধ্যমে
এগুলো সম্পন্ন
করতে অনেক
বেশি স্বাচ্ছন্দ্য
ও স্বস্তি
বোধ করবে
লোকজন। প্রাতিষ্ঠানিক
কর্মকাণ্ডের ব্যাপারেও
সেই একই
কথা। সভা-সমিতিতে
শারীরিক উপস্থিতির
আর প্রয়োজন
হবে না।
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি
ব্যবহার করেই
সম্পন্ন করা
হবে সেসব
কর্মকাণ্ড। অফিস-আদালতের
দাপ্তরিক কাজও
সারা হবে
সেই পদ্ধতিতে।
বাজার-হাট
বলে বহু
স্থানগত প্রতিষ্ঠান
হয়তো বিলুপ্ত
হয়ে যাবে।
তার জায়গায়
আরো বেশি
করে স্থান
করে নেবে
সামাজিক মাধ্যমনির্ভর
ক্রয়-বিক্রয়।
ক্রেতা জানবে
না বিক্রেতা
কে, আর
বিক্রেতার কাছেও
ক্রেতা একজন
অচেনা মানুষ
হিসেবেই থেকে
যাবে। কেনার
আগে ক্রীত
সামগ্রী কেনার
প্রশ্নই উঠবে
না, দরদাম
ব্যাপারটিও স্তিমিত
হয়ে আসবে
এবং পুরো
ব্যাপারটি থাকবে
একটি অদৃশ্য
সুতোয় বাঁধা।
উপর্যুক্ত একটি
চালচিত্র কি
সত্যিই হতে
পারে, নাকি
তা আমার
উর্বর চিন্তার
ফসল? ষাটের
দশকে লেখা
ড. মুহম্মদ
শহীদুল্লাহর ‘ভবিষ্যতের
মানুষ’ রচনাটির
কথা মনে
পড়ে যায়।
তিনি লিখেছিলেন,
‘একটা
সময় আসবে
যখন মানুষের
শুধু একটা
আঙ্গুল লাগবে—বোতাম
টেপার জন্য।’
আমাদের সময়টা
কি অনেকটা
সে রকমের
সময় নয়?
তেমনিভাবে ৯/১১-এর
পর বিমানবন্দরের
সব রকমের
কঠোর নিরাপত্তা
তল্লাশি এখন
আমাদের জন্য
স্বাভাবিক হয়ে
গেছে। আমরা
স্বাভাবিকভাবে জুতো
জোড়া খুলে
ফেলি, মুঠোফোন
বের করে
নিই, প্রক্ষালন
ও রূপচর্চার
নির্দিষ্ট আকারের
জিনিসপত্র ছোট
থলেতে ভরে
নেই। ২০০১-এর
আগে এগুলো
কিছুই ছিল
না। কিন্তু
এখন এটাই
স্বাভাবিক এবং
আমরা তা
মেনে নিয়েছি।
মাঝে মাঝে
মনে হয়,
মানুষের সঙ্গে
মানুষের প্রীতির,
প্রেমের আদরের,
সোহাগের যেসব
প্রক্রিয়া আমরা
অহরহ ব্যবহার
করি, তা
কি আস্তে
আস্তে বিলীন
হয়ে যাবে?
আমরা কি
আর করমর্দন
করব না
সুহূদের সঙ্গে,
বুকে জড়িয়ে
ধরব না
প্রিয়জনকে? বয়োজ্যেষ্ঠ
কি আর
স্নেহের হাত
রাখবে না
বয়োকনিষ্ঠের মাথায়?
সৌহার্দ্যের, সম্প্রীতির
মায়াময় অনুভূতি
বিলীন হয়ে
গিয়ে সেখানে
কি স্থান
করে নেবে
সন্দেহ ও
অবিশ্বাস? আমরা
একে অন্যের
কাছ থেকে
দূরে সরে
থাকব, আমরা
পরস্পরের কাছে
আসব না।
আমাদের সব
সম্পর্কের মাধ্যম
হবে তথ্যপ্রযুক্তি।
আমাদের সবার
মাঝে এক
অদৃশ্য পর্দার
মতো ঝুলবে
কভিড। হয়তো
কভিড-পূর্ববর্তী
আমাদের জীবন
একদিন গল্পগাথায়
পরিণত হবে।
হয়তো এ
প্রজন্ম কোনো
একদিন গল্প
করবে ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের কাছে,
‘জানো,
আমরা না...’?
হয়তো!
সেলিম জাহান: নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয় ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের সাবেক পরিচালক