বাংলাদেশে গত ১৫-১৬ বছরে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোয়। গুম করে আয়নাঘরে নিপীড়নের ঘটনার পর ক্যাম্পাসে নির্যাতনের ঘটনাগুলো সবচেয়ে নির্মম। দ্বিতীয় পর্যায়ের বর্বর ঘটনা যেখানে নির্যাতন-নিপীড়নকেই ইনস্টিটিউশনালাইজড (প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ) করে ফেলা হয়েছিল। সুশীল সমাজ ও মিডিয়াকে ব্যবহার করে একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে বিমানবিকীকরণ করে তাদের হত্যাকে বৈধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পক্ষে গণসম্মতি উৎপাদন করা হয়েছিল এবং এর মাধ্যমে পদ্ধতিগতভাবে ভিন্নমতের যে কাউকে শিবির ট্যাগ দিয়ে মেরে ফেলা বা পঙ্গু করে ফেলা বৈধতা পেয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা আদালত কারো কাছে জবাবদিহিতা বা বিচারের বালাই ছিল না।
ক্যাম্পাসগুলোয় এ ধরনের নির্মম নির্যাতনের সংস্কৃতি গড়ে তোলার কারণ হচ্ছে স্বৈরাচারী সরকারের সবচেয়ে বড় ভয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোকে। অতীতেও স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছিল ছাত্র-জনতার হাতে, আর জুলাইয়ে বড় স্বৈরাচারের পতনও হয়েছে ছাত্র-জনতার হাতে। তাই নিরবচ্ছিন্ন ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে আতংকের সংস্কৃতি চালু রেখেছিল, যাতে কোনো ধরনের সরকারবিরোধী শক্ত আন্দোলন গড়ে উঠতে না পারে।
সামান্যতম ভিন্নমত টের পেলেই ছাত্রদের ওপর নেমে আসত নির্যাতন। আবাসিক হলগুলোয় ছাত্রলীগ গণরুম, গেস্টরুম, টর্চার সেল করে শত শত ছাত্রকে নির্মম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হাড় ভেঙে দেয়া, গোপনাঙ্গে সিগারেটের ছেঁকা দেয়া, সারা রাত ধরে থেমে থেমে পেটানো, র্যাগিংয়ের নামে নগ্ন করে ভিডিও করাসহ এমন কোনো উপায় নেই যে তারা প্রয়োগ করেনি। অনেকেই জীবনের মতো পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, শহীদ হয়েছেন, জেলজীবনের গ্লানি টেনেছেন, শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়েছে, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, এমনকি হয়েছে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। মানসিক ট্রমা তো বয়ে বেড়াচ্ছেই। নারী শিক্ষার্থীরাও নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘সোচ্চার—টর্চার ওয়াচডগ বাংলাদেশ’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় অধ্যাপক আসিফ নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোকে তুলনা করেছিলেন নাৎসি বাহিনীর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সঙ্গে। প্রকৃত অর্থেই আবাসিক হলগুলো একেকটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ছিল, যেখানে ছাত্ররা এমনকি দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরাও ছিলেন নিরূপায়। যেকোনো সময় যে কারো ডাক আসার আতংকে দিন কাটিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। কারো যখন টর্চার সেলে ডাক পড়ত, সবাই বুঝত—আজকে এ ছাত্রকে সারা রাত নির্যাতন করা হবে, কিন্তু কারোরই কিছু করার মতো সাহস ছিল না।
জবাবদিহিতা বা বিচার তো দূরের কথা, ছাত্রনেতা নামধারী এসব নির্যাতকের রাজনৈতিক পদ-পদবি দিয়ে উৎসাহিত করার পাশাপাশি দলীয় পদ-পদবি এবং সরকারি চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
তাদের পদায়ন করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এনএসআই কর্মকর্তা, পুলিশ, প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে। রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে ঢাবি, জবি, রাবির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনির্যাতকরা। নির্যাতকদের পুরস্কৃত করার এ প্রক্রিয়া তৈরি করেছিল নতুন নতুন নিপীড়ক, একেকজন আরেকজনের তুলনায় ভয়ংকর দানব হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় ছিল যেন। আবরার ফাহাদের ঘটনার পর যেটা বিস্তারিত আমাদের সামনে এসেছে এবং দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
গুমসংক্রান্ত কমিশনের রিপোর্টগুলো পড়ে বা আয়নাঘরের নির্যাতনের গল্পগুলো শুনে যেমন গা শিউরে ওঠে, ক্যাম্পাস নির্যাতনের গল্পগুলো শুনলেও নিজেকে স্থির রাখতে পারবে না কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠনগুলো এখানে কখনো মনোযোগ দেয়নি দুই-একটি আলোচিত ঘটনা ছাড়া। ‘সোচ্চার’ এক বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছে ক্যাম্পাস নির্যাতনের ঘটনাগুলো ডকুমেন্ট করার, ক্যাম্পাসের ভয়েসলেস ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়ানোর ও শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাম্পাসগুলোকে নিরাপদ করার লক্ষ্যে।
ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্ররা প্রথম স্বৈরাচারমুক্ত করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। এর মধ্য দিয়েই পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচার পালাতে বাধ্য হয়।
নতুন সরকার গঠনের পর অক্টোবরে শহীদ আবরার ফাহাদ দিবসে সোচ্চার ৫০ জন ভিক্টিমের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে ক্যাম্পাস টর্চারের ওপর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সোচ্চারের গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কীভাবে ছাত্রদের নিপীড়ন করা হয়, এর পেছনের নানা কারণ, নির্যাতনের ধরন এবং নির্যাতিত শিক্ষার্থীর শারীরিক, মানসিক ও একাডেমিক নানা যন্ত্রণার কথা। পাশাপাশি সোচ্চারের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয় একটি সরকারি তদন্ত কমিশন করে ক্যাম্পাস টর্চারের ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করা ও বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার জন্য। আমরা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও করেছি যে সোচ্চার সরকারকে এ কাজে সর্বোচ্চ সহায়তা করবে। এমনকি কোনো ধরনের সরকারি বেতন-ভাতা বা সুযোগ-সুবিধা ছাড়া অবৈতনিকভাবেই সোচ্চারের স্বেচ্ছাসেবকরা সহায়তা করবেন।
সোচ্চারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সরকার একজন সাবেক বিচারপতিকে প্রধান করে বুয়েটের ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য এক সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করে। আমরা যোগাযোগের চেষ্টা করলাম যে এত বড় কাজ এক সদস্য আঞ্জাম দিতে পারবে না, সরকার যেন বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে। আমাদের এ ফিল্ডের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তার পাশাপাশি আমরা স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে সহায়তা করব। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা অবৈতনিকভাবেই এ গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টেশনে সহায়তা করতে চান।
কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, সোচ্চার থেকে কাউকে সরকার তদন্ত কমিটিতে যুক্ত করতে আগ্রহী নয়। তার পরও আমরা তদন্ত কর্মকর্তাকে রিচআউটের চেষ্টা করেছি যে অফিশিয়ালি না হলেও আমরা যেকোনো ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত আছি। কমিটিপ্রধান জানালেন, তিনি এ কমিটির দায়িত্ব নেবেন না এবং ক্যাম্পাস টর্চার নিয়ে এ তদন্তে তার কোনো আগ্রহ নেই। এভাবেই সেই তদন্ত কমিটিটি মরে যায় এবং সরকার পরবর্তী সময়ে আর কাউকে দায়িত্ব দিয়েছে বলেও শুনিনি। গুম, খুন ও জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে নিপীড়নের বিচারের মতো ক্যাম্পাসগুলোয় গত ১৫-১৬ বছরের সব মানবতাবিরোধী অপরাধ ও নির্যাতনের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা ন্যায়বিচারের দাবি ছিল।
খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, ছাত্র-জনতার রক্তের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া সরকারের নেতৃস্থানীয় ছাত্রনেতারাও বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে অ্যাক্টিভিজম করতে গিয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, সেই সরকারে স্বয়ং নির্যাতিত ছাত্ররাও ক্যাবিনেটে ছিলেন এবং আছেন, তারা ক্যাম্পাস নির্যাতন নিয়ে কোনো উদ্যোগ নিলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নামকাওয়াস্তে কিছু কমিশন করেছে, যেগুলো আমরা যতদূর খবর নিয়েছি তেমন কোনো কাজ করেনি বা ইফেক্টিভ কিছু করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাইয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী ১২৮ জনকে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু সে তদন্ত এরই মধ্যে সমালোচিত হয়েছে দায়সারা তদন্ত হয়েছে অভিযোগে।
ড. শিব্বির আহমদ: প্রেসিডেন্ট, সোচ্চার—টর্চার ওয়াচডগ বাংলাদেশ ও পোস্টডক্টরাল ফেলো, ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।