পর্যালোচনা

কেন হারিয়ে গেল চকরিয়া সুন্দরবন?

চকরিয়া সুন্দরবনের নাম হয়তো অনেকে ভুলতেই বসেছে। যে বন কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে তার কথা কেই-বা মনে রাখতে যায়। নয়নাভিরাম কক্সবাজার উপকূলীয় অঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। মাতামুহুরী নদীর চারটি বাঁক থেকে যে চতুষ্টয় সৃষ্টি হলো সেখানে প্রকৃতির অঢেল মমতায় জন্ম নিল চকরিয়া সুন্দরবন। সুন্দরী গাছের আধিক্যের কারণে সুন্দরবন নাম

চকরিয়া সুন্দরবনের নাম হয়তো অনেকে ভুলতেই বসেছে। যে বন কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে তার কথা কেই-বা মনে রাখতে যায়। নয়নাভিরাম কক্সবাজার উপকূলীয় অঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। মাতামুহুরী নদীর চারটি বাঁক থেকে যে চতুষ্টয় সৃষ্টি হলো সেখানে প্রকৃতির অঢেল মমতায় জন্ম নিল চকরিয়া সুন্দরবন। সুন্দরী গাছের আধিক্যের কারণে সুন্দরবন নাম হলেও এর প্রাকৃতিক নান্দনিকতাও ছিল অপরূপ। প্রাণপ্রকৃতিতে ভরপুর ছিল এ বন। চকরিয়া সুন্দরবনকে নিছক সম্পদ মনে করে এর যথেচ্ছ ব্যবহারে বলতে গেলে বনটি লোপাট হয়ে গেছে। একটি আস্ত বন হারিয়ে গেছে স্থানীয় এবং বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মুনাফাখোরদের দৌরাত্ম্যের কারণে। কেন এ বনের ওপর সবাই হামলে পড়ল? 

তথ্য-উপাত্ত ও ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯০৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর সরকারিভাবে চকরিয়া সুন্দরবন রেঞ্জ গঠন করা হয়। যার মধ্যে ৮ হাজার ৫১০ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বনকে রিজার্ভ এবং বাকি ৭ হাজার ৪৯০ হেক্টর সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে চকরিয়া বনভূমির ওপর মানুষের লোলুপ দৃষ্টির সূত্রপাত হয় ১৯২৬ সালে, যখন ১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমি কিছু পরিবারকে বসতি স্থাপনের জন্য ইজারা দেয়া হয়। লোকজন ঘরবাড়ি তৈরি করে ঘর-সংসার শুরু করে দেয় এবং তাদের প্রয়োজনে বনকে নানাভাবে ব্যবহার শুরু করে। মানুষগুলো বেঁচে থাকার জন্য যেমন বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল হয়, তেমনি জ্বালানি কাঠ ও বাসস্থানের উপকরণের জন্য ম্যানগ্রোভ বনকে ব্যবহার করা শুরু করে। এর বাইরে স্থানীয় লোকজন ঐতিহ্যবাহী ওষুধের জন্য ভেষজ উদ্ভিদ, মধু এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র পণ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে এ বন থেকে। মানুষের অবাধ বিচরণ এবং সম্পদ আহরণ বনটিকে দিন দিন ভঙ্গুর দশায় উপনীত করে।

সবচেয়ে বড় খড়গটি নেমে আসে যখন চিংড়ি সাদা সোনা হিসেবে সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। ব্যক্তি, সম্প্রদায়, রাষ্ট্র সবাই যেন হামলে পড়ে চিংড়ি চাষের ওপর। খুব স্বল্প সময়ে সম্পদশালী হয়ে ওঠার লোভে প্রকৃতির ফুসফুসকে বিনা সংকোচে ধ্বংস করা শুরু হলো। যেহেতু ম্যানগ্রোভ বন এলাকা চিংড়ি চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী তাই চকরিয়া সুন্দরবন হয়ে উঠল চিংড়ি চাষের অভয়ারণ্য। আমাদের লোভাতুর দৃষ্টি ১৯৭৭ সালে চকরিয়া সুন্দরবনের ২ হাজার ২৫১ হেক্টর এলাকাকে চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে পরিণত করে এবং ধারাবাহিকভাবে ১৯৮২ সালে আরো ৬৯৪ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বন চিংড়ি চাষের জন্য পরিষ্কার করা হয়—এমন তথ্য বিভিন্ন সময় গবেষকরা দিয়েছেন। এরপর আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ৩ হাজার ৫৭৭ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বন এলাকা চিংড়ি চাষের জন্য লিজ দেয়া হয়েছিল। অবশেষে, ম্যানগ্রোভ বনের অবশিষ্ট অংশ ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ সালে চিংড়ি চাষের জন্য লিজ দেয়া হয়। তথ্যমতে, বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) চকরিয়া সুন্দরবন এলাকায় চিংড়ি চাষের জন্য ২৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থসহায়তা দেয়। চিংড়ি চাষের সঙ্গে যুক্ত হয় লবণ চাষ। এটা অনেক লাভজনক হওয়ায় চিংড়ি চাষের সঙ্গে যুক্ত কিংবা এর বাইরে যারা ছিল তারা বনটিকে সাবাড় করে লবণ চাষ শুরু করে দিল। এ দখলদারির কারণে নানা প্রজাতির গাছ হারিয়ে যেতে শুরু করল। এ বনের প্রধান গাছ সুন্দরী, গেওয়া, কেওড়া, হেন্তাল, পশুর, ধুন্দুল, গোলপাতা আমাদের আগ্রাসী থাবায় পর্যায়ক্রমে বিদায় নিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। ১৯৯৪ সালের তথ্য থেকেও জানা যায় তখন বনে সুন্দরী, গেওয়া, কেওড়া, হেন্তাল ছিল। এর পরে বেশকিছু বছর বিভিন্ন গাছের শিকড় ছিল। লবণ চাষে সেসবও হারিয়ে গেছে। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের তথ্যমতে বনটিতে ভূমিরূপ এবং লবণাক্ততার ভিন্নতার ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের গাছ অঞ্চলভেদে দেখা যেত। অ্যাভিসিনিয়া ধরনের (গণ) বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কতকটা নিম্নাঞ্চলে ছড়িয়ে থাকতে দেখা যেত, এছাড়া ব্রুগুয়েরার নানা প্রজাতি অনেকটা চর এবং মাতামুহুরীর মোহনা অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল। এর বাইরে সাগরের তীরাঞ্চল জুড়ে সোনেরেসিয়া, রাইজোফোরা এবং অ্যাভিসেনিয়ার প্রজাতিগুলো ছড়িয়ে ছিল। অন্যদিকে হেরিটিয়েরা, এক্সকোইকারিয়া ও অ্যাভিসেনিয়ার নানা প্রজাতি সম্মিলিতভাবে বেড়ে উঠেছিল বিভিন্ন অঞ্চলে। চিংড়ি চাষ, লবণ চাষ এ অঞ্চলে যেমন গাছ নিধনের উৎসব আয়োজন করেছে; তেমনি লবণাক্ততা বাড়িয়েছে, যা ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের জন্য কাজ করেছে, সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলের মাটিকে অন্যান্য চাষাবাদের জন্য অনুপযোগী করে তুলেছে।

চিংড়ি চাষীরা চাষের পুকুর তৈরির জন্য বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ খাল নির্মাণ করেছেন, যা পানিপ্রবাহে যেমন বাধার সৃষ্টি করেছে তেমনি পানির এবং ভূমির লবণাক্ততা বাড়িয়েছে বহুগুণ। চকরিয়া সুন্দরবনের তিনদিকেই অনেক মানুষের বসতি, যার কারণে বন থেকে সম্পদ আহরণে মনুষ্য চাপ অনেক বেশি। সম্পদের যথেচ্ছ আহরণ এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে মানুষ পুরো বনটিকে গলা টিপে মারার মতো করে বনের বিভিন্ন স্থানে খাঁড়ির মুখে বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করেছে। ফলে জোয়ার-ভাটা প্লাবিত যে পরিবেশে ম্যানগ্রোভ বেঁচে থাকে তাকে বাঁধের মাধ্যমে স্থবির পানিতে বন্দি করে দিয়ে যেন শ্বাসরোধ করে মারা হলো। পানির প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় চারাগুলো পর্যন্ত মরে গেল, নতুন করে গাছ জন্মানোর পথও আর থাকল না। 

ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল স্বভাবতই পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং প্রাকৃতিক খাদ্যে ভরপুর। যার কারণে মাছ যেমন ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলকে প্রজননক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়, তেমনি মাছের পোনাগুলোও তাদের বেড়ে ওঠার জন্য ম্যানগ্রোভ এলাকায় থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ ব্যাহত করলে যেমন পুষ্টি পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়, সঙ্গে সঙ্গে অনুর্বরতাও বাড়তে থাকে। চকরিয়া সুন্দরবনের গাছগুলো হারিয়ে যাওয়ার কারণে এলাকাটি মাছের জন্য আর প্রজননক্ষেত্র থাকল না। বন মানেই বিচিত্র প্রজাতির প্রাণীর বসবাস। বন হারিয়ে গেছে, বনের প্রাণীরাও হারিয়ে গেছে। যাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে অন্যত্র চলে গেছে, বাকিরা বিলুপ্ত। এসব প্রাণীর অনেকের সঙ্গে আমাদের বসবাসোপযোগিতার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ একটি নিবিড় সম্পর্ক ছিল এবং আছে। বাস্তুতন্ত্র থেকে এসব প্রাণীকে বিদায় করে দিয়ে আমরা যে খুব আরামে থাকতে পারব সেটা অসম্ভব। খাদ্যশৃঙ্খলের অথবা খাদ্যজালের শিকল কেটে দিলে এর পরিণাম যে ভয়াবহ হতে পারে তা মানব প্রজাতি বহুবার প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু সাময়িক লাভের নেশায় এ সুরক্ষা জাল বারবার কাটছে এবং নিজেকে করছে অরক্ষিত। চকরিয়া সুন্দরবন বিভিন্ন ধরনের পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ, উভচর এবং মাছের জন্য খুব ভালো আবাসস্থল ছিল। বন ধ্বংসের কারণে এ প্রাণীগুলো তাদের আবাস হারাতে শুরু করে। 

ম্যানগ্রোভ বনের ধ্বংস কি উপকূলীয় বাসস্থান, জলজ সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতিই ঘটায়? আদতে শুধু তা নয়। ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের কারণে বাড়ছে নির্দিষ্ট উপকূলীয় অঞ্চলের ভূমির ক্ষয়, পরিবর্তিত হচ্ছে উপকূলের সীমানা রেখা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে। ম্যানগ্রোভ বন উপকূলীয় অঞ্চলে অনেকটা ব্যূহ তৈরির মাধ্যমে মানুষসহ স্থলভাগের অন্যান্য প্রাণী ও সম্পদের সুরক্ষা দেয়। ঘূর্ণিঝড়ের সময় প্রকৃতি সংরক্ষণ এবং জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় ম্যানগ্রোভ বনের পরোক্ষ উপকারকে আমরা টাকার অংকে মূল্যায়ন করতে পারি না, যেমন সম্ভব নয় জীবনের দাম নির্ধারণ। মানুষ তার সুরক্ষাকারীকে অবিবেচকের মতো হত্যা করছে প্রতিনিয়ত। ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের কারণে জীবের চারণক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে, ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন সামুদ্রিক, মোহনা এবং মিঠা পানির মৎস্য সম্পদের পরিমাণ প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। সর্বোপরি প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত নির্দেশনার অভাবের কারণে ভূমি ব্যবহার নিয়ে নিত্য দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে এসব এলাকায়। আশঙ্কার কথা হচ্ছে বনভূমি ধ্বংস করে লবণ চাষ এবং চিংড়ি চাষের জমি নিয়ে বিবাদ লেগেই থাকে, যার ফল হিসেবে প্রাণহানিও ঘটে। আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি যে চিংড়ি সম্পদের জন্য আমরা বন কেটে সাবাড় করেছি সে কারণে এ অঞ্চল দিন দিন মৎস্যশূন্য হয়ে পড়েছে? সোনার ডিম দেয়া হাঁসটিকে জবাই করে একবারে সব কেড়ে নেয়ার মতো আমরা চকরিয়া সুন্দরবনটিকে ধ্বংস করে দীর্ঘমেয়াদে পাওয়া যাবে এমন সব সম্ভাবনাকে কবর দিয়েছি এবং নিজেদের দাঁড় করিয়েছি বিপৎসংকুল এক অবস্থানে। গাছের গায়ে কুড়াল মারতে গিয়ে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। সমূহ ক্ষতি অনুধাবন করেও কি আমরা পারি না বনটিকে আবার ফিরিয়ে আনতে?

ড. এএসএম সাইফুল্লাহ: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান

এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও