শিক্ষার মূল লক্ষ্য হতে হবে দক্ষ জনশক্তি তৈরি

প্রাথমিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মৌলিক শিক্ষা প্রদান। এর অন্তর্ভুক্ত তিনটি বিষয়—এক. সাক্ষরতা (লিটারেসি), দুই. গণনা দক্ষতা (নিউমারেসি) ও তিন. স্থানান্তরযোগ্য মৌলিক দক্ষতা (ট্রান্সফারেবল বেসিক স্কিলস)।

ড. শ্যামল চৌধুরী, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক শেষ করে জার্মানির কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে এমএ করেন। কৃষি অর্থনীতিতে পিএইচডি করেন জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে তার গবেষণার মূল বিষয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন। পাশাপাশি জোর দিচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রিক গবেষণায়। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষার নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবরিনা স্বর্ণা

শিক্ষার ভিত হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষাকে বিবেচনা করা হয়। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সমস্যা কী?

প্রাথমিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মৌলিক শিক্ষা প্রদান। এর অন্তর্ভুক্ত তিনটি বিষয়—এক. সাক্ষরতা (লিটারেসি), দুই. গণনা দক্ষতা (নিউমারেসি) ও তিন. স্থানান্তরযোগ্য মৌলিক দক্ষতা (ট্রান্সফারেবল বেসিক স্কিলস)। সাক্ষরতা হলো পড়তে ও লিখতে পারার দক্ষতা। এটি কেন জরুরি? যদি সরকারি দিক থেকেও বিবেচনা করি, এটি জরুরি কারণ সরকার কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর তার নাগরিকরা সেটি পড়তে না পারলে তথ্য প্রদান সরকারের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে যায়, সবার কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে যায়। তাই যোগাযোগ করার মতো, বুঝতে পারার মতো সাক্ষরজ্ঞান সব নাগরিকেরই থাকা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, গাণিতিক দক্ষতা হলো শিক্ষার্থী যেন মৌলিক গাণিতিক কাজ যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ এগুলো করতে পারে। গাণিতিক দক্ষতা মূলত জরুরি যুক্তিযুক্তভাবে চিন্তা করতে শেখার জন্য। আর তৃতীয়ত হলো সাক্ষরতা ও গাণিতিক দক্ষতাকে অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারা, যেটাকে বলছি স্থানান্তরযোগ্য দক্ষতা। এগুলো হলো প্রাথমিক শিক্ষার মূল ভিত্তি।

এর বাইরে আরো ‍দুই ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন: সামাজিক ও মানসিক দক্ষতা। এরই মধ্যে অনেক দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এ দুটি বিষয় যুক্ত করা হরেয়ছে। লিটারেসি ও নিউমারেসির মতো সামাজিক ও মানসিক দক্ষতাগুলো শেখাটাও খুব জরুরি। একটি তথ্য ও পরিষেবাভিত্তিক অর্থনীতির জন্য এ দক্ষতাগুলো প্রয়োজন। তাই প্রাথমিকে শিক্ষার্থীরা এসব দক্ষতা অর্জন করতে পারছে কি না তা মূল্যায়ন করতে হবে।

আমরা কীভাবে তা মূল্যায়ন করতে পারি?

বিভিন্ন দেশে জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়। তৃতীয় বা পঞ্চম শ্রেণীতে সাধারণত এটি করা হয়। বাংলাদেশেও এমন একটা স্বতন্ত্র ব্যবস্থার প্রচলন আছে যাকে বলা হয় ‘ন্যাশনাল স্কুল অ্যাসেসমেন্ট (এনএসএ)’। ২০১১ সাল থেকেই এটি চালু আছে, কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এনএসএর তথ্যগুলো দীর্ঘদিন ধরে এক প্রকার লুকিয়ে রেখেছে। তবে দেশ-বিদেশের গবেষকদের না দিলেও বিশ্বব্যাংক থেকে ২০১৭ সালে এনএসএ ডাটার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা কেমন দক্ষতা অর্জন করছে সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, খুব কম শিক্ষার্থীরাই কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন করছে। উদাহরণস্বরূপ পঞ্চম শ্রেণীতে কেবল ১৭ শতাংশ বাংলায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনের পরিমাণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৫তম, আর দক্ষিণ এশিয়ায় সপ্তম। প্রাথমিক শিক্ষায় যোগ্য শিক্ষকদের ধরে রাখতে বা আকৃষ্ট করতে এ বেতন কাঠামো কি বড় চ্যালেঞ্জ?

আমাদের এখানে যোগ্য শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেতন কাঠামো বা প্রাথমিক শিক্ষার বাজেট মূল সমস্যা নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে, প্রাথমিক শিক্ষায় পুরো স্বাস্থ্য খাতের চেয়ে বেশি বরাদ্দ ছিল। এমনকি বাংলাদেশের পুরো শিক্ষা খাতের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার অবকাঠামো সবচেয়ে বেশি রয়েছে, প্রায় সব ধরনের অবকাঠামোই আমাদের আছে। আমাদের একটা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আছে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর আছে যারা পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত, বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) আছে যারা তথ্য সংগ্রহ করছে, প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) আছে এবং এর ব্যবস্থাপনা উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং মোটামুটি সব শিক্ষকই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তার পরও কেন শিক্ষকের দক্ষতার ঘাটতি থাকছে, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। সম্পদের অপ্রতুলতা এক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা নয়।

অনেকেই ট্রানজিশন পিরিয়ডে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং অন্য চাকরি পেলে সেখানে চলে যান। এর পেছনে কাঠামোগত বিষয়ের বাইরে যে সামাজিক বা মনস্তাত্ত্বিক দিক রয়েছে সেটির সমাধান কী হতে পারে?

বাংলাদেশে অনেকে মনে করেন যে অন্য দেশের শিক্ষকরা অনেক বেশি বেতন পান এবং তারা প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘকাল থাকেন। এ ধারণাগুলো সঠিক নয়। আমি যেহেতু অস্ট্রেলিয়ায় বাস করি, এখানকার উদাহরণ দিয়ে বলি। এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ধরে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেখা যায় অনেক শিক্ষকই কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে চলে যান। এটা কেবল টাকার কারণে ঘটে না। এখানে একটা বড় কারণ হলো তারা এ পেশায় প্রবেশের আগে জানতেন না যে তারা শিক্ষক হতে চান কিনা। শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হওয়ার পর অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে তিনবার পেশা পরিবর্তন করেছি। অর্থাৎ এক্ষেত্রে নিজেকে আবিষ্কারের একটি বিষয় রয়েছে এবং এ প্রক্রিয়ায় কিছু মানুষ চলে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকতা পেশায় থাকতে চান, আমরা তাদের আকৃষ্ট করতে পারছি কিনা, কিংবা যারা বর্তমানে এ পেশায় কর্মরত তাদের থেকে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে পারছি না, এগুলো মূলত বিবেচনার বিষয়। বেতন কাঠামোর বাইরে, কোন কোন কারণে আমরা শিক্ষকদের ধরে রাখতে পারছি না, তা নিরূপণ করতে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।

আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের ব্যবধান অনেক বেশি। তার ওপর ধারাবাহিকতাও থাকছে না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে বোঝাপড়ার বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে কি এটি প্রভাব ফেলছে?

হ্যাঁ, এটি শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক তৈরিতে এক ধরনের বাধা হিসেবে কাজ করে। তবে মূল্য সমস্যা অন্য ক্ষেত্রে রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো নিয়ে করা আমার গবেষণা থেকে দুটি বিষয় আমি লক্ষ করেছি। এক. এখানে শিক্ষকদের একটি নির্দিষ্ট সাবজেক্টে বিশেষায়িত করার চেষ্টা করা হয়। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজনকে কেবল বাংলা বা গণিতের শিক্ষক বানানো হয়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় সেটা করা হয় না। এ দেশে একজন শিক্ষকই পুরো বছর একটা সেকশনের সব সাবজেক্ট পড়ান। এতে তিনি জেনে যান যে কোন শিক্ষার্থী কোন সাবজেক্টে ভালো বা কার কোথায় সমস্যা, কীভাবে কাকে পড়াতে হবে। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে একধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের এখানে দেখা যায় একজন শিক্ষক প্রথম শ্রেণীতে পড়াচ্ছেন, আবার তিনি একই সঙ্গে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াচ্ছেন। অর্থাৎ একটি শ্রেণীর জন্য একজন নির্দিষ্ট শিক্ষককে আমরা রাখতে পারছি না। আমাদের এখানে খুব সহজে এটি পরিবর্তন করা যায় বলে আমি মনে করি। এছাড়া এটি ব্যয়বহুলও হবে না। বিদ্যমান শিক্ষকদের নিয়েই কাজটি করা যেতে পারে।

এর বাইরে আরেকটি কাজ করা যেতে পারে। আমাদের স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে কিন্তু অনেক জায়গায় এগুলো সেভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। এটিও বা টিইও অথবা চেয়ারম্যান-মেম্বার যারা আছেন, তারাই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেন। যাদের সন্তানরা স্কুলে পড়েন, তাদের সেখানে কথা বলার কোনো সুযোগ থাকে না। অভিভাবকদের এক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করাটা জরুরি। শিক্ষকরা কী, কখন বা কীভাবে পড়ান সেটি অভিভাবকরা জানলে, এর সুফল পাওয়া যেতে পারে। আবার কোন শিক্ষক আসছেন বা আসছেন না সেটিও তাদের জানা দরকার। কারণ এটি একটা চিন্তার জায়গা অভিভাবকদের জন্য।

তৃতীয়ত আরেকটি কাজ করা যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় শিক্ষকদের অন্য অনেক কাজ, যেমন কোনো মন্ত্রণালয়ের তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেয়া হয়। আমার ধারণা, প্রায় ২০-৩০ কর্মদিবস শিক্ষকরা এসব কাজে ব্যয় করেন। এটি বন্ধ করা উচিত, কারণ এতে পাঠদান ব্যাহত হয়।

উন্নত দেশে প্রাথমিকের আগে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া হয় বেশি। দেশের প্রাক-প্রাথমিকের অবস্থা কেমন মনে হয়ে আপনার?

শিশুর জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন এটা ছিল না। ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা স্তর চালু করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে চার থেকে ছয় বছরের বাচ্চারা প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তি হচ্ছে। এটি বেশ ভালো একটা দিক। তবে বিশ্বের অনেক দেশে আরো অল্প বয়সে বাচ্চারা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করে। সেখানে বাচ্চাদের শিক্ষা দেয়া হয় খেলাধুলার মাধ্যমে এবং এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপযুক্ত কিনা সেটিও যাচাই করা হয়। বাংলাদেশে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য তৈরি নয়। তারা জানে না কীভাবে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয়। অর্থাৎ সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার জ্ঞান তৈরি হয় না, যেটি প্রাক-প্রাথমিকে শেখার কথা ছিল কিংবা পরিবার থেকে শিখতে পারত। দুঃখজনকভাবে, সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের শিশুরা এটি আরো কম শেখে। বাংলাদেশের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের এ ধরনের দক্ষতা বাড়ানোর দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশে চলমান সময়ে পাঠ্যক্রম এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে এক প্রকার দ্বান্দ্বিক অবস্থা লক্ষণীয়, যার উত্তেজনা নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি আমরা। কীভাবে এর নিরসন হতে পারে?

বাংলাদেশে শিক্ষার সঙ্গে ধর্মের কোনো দ্বন্দ্ব আছে বলে আমার মনে হয় না। তবে শিক্ষায় ধর্মের ভূমিকা কী হবে সেটি নিয়ে কোনো সমাধানে আমরা পৌঁছাতে পারিনি, যেটা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার মান প্রসঙ্গে আমরা প্রায়ই ‍ফিনল্যান্ডের কথা বলি। কিন্তু সেখানে প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ ধর্মে বিশ্বাসী নন। অস্ট্রেলিয়ায়ও একই অবস্থা। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার সরকারি বিদ্যালয়ে ধর্ম শিক্ষা দেয়া হয় না, কারণ অনেকেই মনে করেন যে জনগণের করের টাকায় বিদ্যালয়ে ধর্ম শিক্ষার প্রয়োজন নেই। কারণ ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। কোনো কোনো বেসরকারি স্কুলে এটি শেখানো হয় বা যাজকরা বিনা বেতনে অনেক সময় ধর্মের বিষয়াদি পড়ান। তবে সেসব দেশে নৈতিক শিক্ষা প্রদানের প্রচলন আছে। বাংলাদেশে ধর্ম শিক্ষাকে অনেকে নৈতিক শিক্ষার একটা ভিত হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু সেসব দেশের বিদ্যালয়ে ধর্ম না শেখানোয় মানুষদের নৈতিকার অভাব হয়নি, বরং তারা অনেক ক্ষেত্রেই বেশ ভালো করছে এবং বাংলাদেশের অনেক বাবা-মাই সন্তানদের ওই সব দেশে পাঠাতে আগ্রহী।

নৈতিক শিক্ষা প্রদানে কোন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়?

উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থায় সামাজিক ও মানবিক দক্ষতা বাড়ানোয় বেশি মনোযোগ দেয়া হয়। আর এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয় আত্মনিয়ন্ত্রণকে। অর্থাৎ একটি শিশু কীভাবে নিজের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। কোনো কাজ করতে বা বিশেষ কোনো লক্ষ্য অর্জনে কীভাবে স্থির থাকতে হয়, সেসব বিষয়ে কীভাবে উদ্বুদ্ধ হওয়া যায়, তা শেখানো হয়। এছাড়া কীভাবে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে ও বাস্তবসম্মত হতে হয় এবং অন্যের প্রতি সহনশীল হতে হবে—সেগুলোও শেখানো হয়। আর এগুলোও নৈতিকতার অংশ। এসব বিষয় যদি শিশুদের শেখানো যায়, তাহলে একটি নৈতিকতাসম্পন্ন সমাজ তৈরি করা সম্ভব। এগুলোর জন্য সেসব দেশে পাঠ্যক্রম আছে। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা হয়েছে। নৈতিকতার অন্যতম একটি উৎস ধর্ম হলেও বিশেষ কোনো ধর্ম শিখছি নাকি ধর্মের শিক্ষা শিখছি—সেটি মনে রাখা দরকার।

যোগদানের পর শিক্ষকরা দীর্ঘ প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যান। প্রশিক্ষণ পর্যায়ে কি শিক্ষকদের নৈতিকতার বিষয়গুলো শেখানোর জন্য কোনো কার্যক্রম রয়েছে?

সামাজিক ও মানবিক দক্ষতা নিয়ে আমরা বাংলাদেশে ২০১৮-২০ সাল পর্যন্ত একটি গবেষণা করেছিলাম। সেখানে ৩০০ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। সেখানে এ বিষয়ে দুইদিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শেখাতে এ প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও শিক্ষকদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটতে দেখা গেছে। ফলে শিক্ষকদের এ বিষয়ের দক্ষতা বেড়েছে। এ ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সরকারিভাবে পুরো দেশে করা উচিত।

প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার একটি অন্যতম জায়গা দেশের মসজিদ বা মাদ্রাসাগুলো। প্রয়োজনীয় দক্ষতা বৃদ্ধিতে এসব প্রতিষ্ঠানেও আমাদের আরো গুরুত্ব দেয়া উচিত কিনা।

প্রাক-প্রাথমিকে যা শেখানো হয় সেগুলো মানুষের প্রান্তিক জীবনকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে। তাই আমরা কী শেখাচ্ছি এবং সেটি কীভাবে আরো কার্যকর করা যায় সেদিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি অভিভাবকরা যাতে এসব ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত হতে পারেন সেটিও দেখা উচিত। প্রাথমিক শিক্ষার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৮২০ সালে ইংল্যান্ডে এর শুরু হয়েছিল। কারখানায় কেউ কাজ করতে চাইলে সাক্ষরতা থাকা দরকার। এ কারণেই মূলত প্রাথমিক শিক্ষার শুরু হয়েছিল। এখন আর সেই যুগ নেই। এখন আমরা সেবা খাতে অগ্রসর হয়েছি। পোশাক শিল্প খাতে চাকরি করতে মৌলিক সাক্ষর ও গাণিতিক জ্ঞান থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শিল্পোত্তর যুগে প্রবেশ করতে হলে আমাদের আরো বেশি কিছু চিন্তা করতে হবে। সেখানে সামাজিক ও মানবিক দক্ষতাসহ দলবদ্ধ হয়ে কাজ করা ও সহযোগিতার কথা ভাবতে হবে। কীভাবে মানবিক মানুষ তৈরি করতে পারি সেই বিষয়গুলো ভাবতে হবে।

শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার শুরুটা কি তাহলে প্রাথমিক থেকে শুরু করা প্রয়োজন?

এটি প্রাথমিক নয়, প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু হওয়া প্রয়োজন। এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশের আগে থেকেই এটি শুরু করা যেতে পারে। যেটাকে আমরা বলি, ‘ফেটাল অরিজিন হাইপোথিসিস’। মাতৃগর্ভে শিশুর বয়স ছয় মাস পূর্ণ হলে তার ভাষা শিক্ষা শুরু হয়ে যায়। তখন থেকেই আসলে শেখানোর সময়। আমরা শিশুদের যত দ্রুত শেখানো শুরু করব, তার সুফল তত বেশি পাওয়া যাবে।

ফিনল্যান্ডে শিক্ষার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সংস্কৃতি সংরক্ষণ। আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্য কী হতে পারে?

একেক দেশের সংস্কৃতি একেক রকম হয়। আবার এটি ভালোভাবে সংজ্ঞায়িতও নয়। এটি একটি লক্ষ্য হতে পারে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য হতে হবে দক্ষ জনশক্তি তৈরি, যাতে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।

কিন্তু একটা ভালো সমাজ তৈরিতে এই লক্ষ্য কি যথেষ্ট?

না, কিন্তু প্রাথমিকে যখন সাক্ষরতা, গণনা ও স্থানান্তরযোগ্য তথা সামাজিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হবে তখন শিক্ষার্থীরা মানবিক হতে শিখবে, যা ভালো সমাজের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শিক্ষার উদ্দেশ্য দক্ষ জনশক্তি হওয়া উচিত, কারণ এর বিষয়গুলো সুসংজ্ঞায়িত।

সবশেষে জানতে চাই, প্রাথমিক শিক্ষা প্রসঙ্গে বর্তমান সরকারের জন্য কী সুপারিশ রয়েছে?

আমার মনে হয় সরকারের বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনার পথে হাঁটা উচিত নয়। প্রথমে সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রাথমিক শিক্ষায় যেকোনো পরিবর্তন আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে নীতিকৌশল নিতে হবে। ছোট ছোট পরিবর্তন আনা যেতে পারে। যেমন কীভাবে ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোয় অভিভাবকদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়, শিক্ষকদের উৎসাহ বাড়ানো যায়। সবচেয়ে জরুরি মূল্যায়ন ব্যবস্থা থাকা। এটি কীভাবে হবে তাও যাচাই করে নেয়া প্রয়োজন।

আরও