সদ্য বিদায়ী বছরে বৈশ্বিক পুঁজিবাজার, বিশেষত ওয়াল স্ট্রিটের তুলনায় কম সক্ষমতা দিয়েছে ইউরোপের পুঁজিবাজার। মূলত প্রযুক্তি খাতের স্থবিরতা, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, চীনের মন্থর প্রবৃদ্ধি ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে আশানুরূপ পারফর্ম করতে পারেনি এ অঞ্চলের বাজারগুলো। নতুন বছরেও এসব চ্যালেঞ্জ অব্যাহত থাকতে পারে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের, যা ইউরোপের বাজারকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। খবর ইউরোনিউজ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপের পুঁজিবাজারের এমন পরিস্থিতির পেছনে দুটি প্রধান বৈশ্বিক ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে—হোয়াইট হাউজে ডোনান্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে প্রবেশ ও চীনের প্রবৃদ্ধি। এর বাইরে জার্মানি ও ফ্রান্সের রাজনৈতিক সংকট বাজার মনোভাবকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
ইউরোপের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। অঞ্চলটির অনেক কোম্পানি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আসা আয়ের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এ অবস্থায় বিদেশী পণ্যের ওপর ট্রাম্পের শুল্কহার বাড়ানোর ঘোষণা উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বিশেষত ইউরোপের প্রধান অর্থনীতি জার্মানির জন্য শুল্ক বাড়ার প্রভাব মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, জার্মান গাড়ি নির্মাতারা উৎপাদন কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তর না করলে তাদের ওপর শুল্ক আরোপ হবে। ওই সময় তিনি শুল্ককে তার অভিধানের"সবচেয়ে সুন্দর শব্দগুলোর একটি বলে উল্লেখ করেছিলেন।
গত নভেম্বরে কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানীকৃত পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ এবং চীনের ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা ঘোষণা দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এখনো ইউরোজোনকে লক্ষ্য করে শুল্ক ঘোষণা হয়নি। তবে এ ঘোষণার দিন ইউরোপীয় গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলোর শেয়ারদরে বড় পতন দেখা গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অবস্থা ইঙ্গিত দেয় যে শুল্ক বাড়ানো হলে বৈশ্বিক বাজারে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে কোম্পানিগুলো।
ইউরোপীয় পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ অঞ্চলটির গাড়ি শিল্পকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। নানা কারণে চাপে থাকা খাতটি আরো গভীর মন্দার মুখোমুখি হবে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পাশাপাশি চীনে ভোক্তা চাহিদা হ্রাস বাজারে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষত বিলাসবহুল পণ্য খাতে চাহিদা কমায় ইউরোপীয় উৎপাদকরা চাপের মুখে পড়েছে।
ইউরো স্টক্সক্স অটোমোবাইলস অ্যান্ড পার্টস সূচক ২০২৪ সালে ১৩ শতাংশ কমে গেছে। এর ফলে এটি ইউরোপীয় বাজারে সবচেয়ে দুর্বল পারফর্ম করা খাতগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। এর বিপরীতে ইউরো স্টক্সক্স ৬০০ সূচক ৭ শতাংশ বেড়েছে। জার্মান গাড়ি নির্মাতাদের মধ্যে মার্সিডিজ-বেঞ্জ, পোরশে, ফক্সওয়াগন ও বিএমডব্লিউর শেয়ারদর বিদায়ী বছরে ১৩-২৫ শতাংশ কমে গেছে।
এদিকে চীনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার গতি ধীর হওয়ায় ইউরোপের পুঁজিবাজার সূচক খুব বেশি বাড়ছে না। তবে চীনা সরকার"আরো সক্রিয় আর্থিক নীতি এবং আরো নমনীয় মুদ্রানীতি"গ্রহণের অঙ্গীকার করেছে। অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন, চীন ২০২৫ সালে সুদহার আরো কমাবে এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর ওপর জোর দেবে। এ নীতিগুলো কার্যকর হলে ইউরোপীয় ভোক্তা খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
লন্ডনের ব্রোকার হাউজ পেপারস্টোনের জ্যেষ্ঠ গবেষণা কৌশলবিদ মাইকেল ব্রাউন বলেন, ‘চীনা কর্তৃপক্ষ যতক্ষণ না অভ্যন্তরীণ চাহিদা উদ্দীপিত করার দিকে মনোযোগ দেয়, ততক্ষণ দেশটির দেয়া প্রণোদনা ইউরোপীয় পুঁজিবাজারকে টেকসই সমর্থন দিতে পারবে না। কারণ এ পদক্ষেপগুলোর ইতিবাচক প্রভাব সীমিত।’
অর্থনীতিবিদরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন, ২০২৫ সালে চীন সুদহার আরো কমাতে এবং বাজেট ঘাটতির মাত্রা বাড়াতে পারে। চীনা কর্মকর্তারা আগামী বছরে দেশীয় ভোক্তা চাহিদা উন্নত করার প্রতি বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়ার কথাও বলছেন। এ নীতিগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হলে ইউরোপীয় ভোক্তা খাত উল্লেখযোগ্য পুনরুদ্ধার দেখতে পারে।
তবে ঝুঁকি এখনো রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ পুনরায় শুরু হলে চীনা মুদ্রা ইউয়ানের বিনিময় হার মান আরো কমে যেতে পারে। যার প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা ও ইউরোপীয় পণ্যের চাহিদায়। আর প্রভাব নেতিবাচকই হবে।
ফ্রান্স ও জার্মানির চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ইউরোপের পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারে। ফ্রান্সে সরকারি ঋণের চাপ এবং ২০২৫ সালের বাজেট নিয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে ব্যাংক খাতের ওপর চাপ আরো বাড়ছে। দেশটিতে সরকারি ঋণ জিডিপির তুলনায় ১১২ শতাংশে পৌঁছেছে।
২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পারফর্ম করা বড় পুঁজিবাজারের একটি ফ্রান্স। যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার কিছু অংশ সবল শেয়ারবাজারের বিপরীতে সেখানকার বেঞ্চমার্ক সিএসি ৪০ গত বছরে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। অবশ্য বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে মিল রেখে জার্মানিতে ডিএএক্স নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। বিশেষ করে প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা খাতে উন্নতির কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। তবে জার্মানিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ঘটে যাওয়া আগাম নির্বাচন এবং পরবর্তী দলীয় জোট গঠনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া বাজারের স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এসব ঘটনা ইউরোপীয় সম্পদের ওপর উচ্চতর ঝুঁকি তৈরি করেছে। ফলে ২০২৫ সালে বিনিয়োগের জন্য ঋণগ্রহণ কমে যেতে পারে এবং তারল্য সংকুচিত হয়ে আসতে পারে।