মানুষ কষ্টে থাকলেও ফুলেফেঁপে উঠছে সরকারি প্রতিষ্ঠান

বিপিসির সংরক্ষিত আয় দাঁড়াতে পারে ৩০ হাজার কোটি টাকায়

বছর পাঁচেক আগেও বড় অংকের পুঞ্জীভূত লোকসানে ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে ২০২০ সাল থেকেই সংস্থাটির মুনাফা পুঞ্জীভূত হতে থাকে। এ অবস্থায় ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে বিপিসির সংরক্ষিত আয় (রিটেইনড আর্নিংস) দাঁড়াতে পারে ৩০ হাজার কোটি টাকায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে জ্বালানি তেল আমদানির এলসি খোলার ক্ষেত্রেও সরকারের ব্যয় কমেছে ৩৬ শতাংশ। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানোর কোনো ঘোষণা এখনো সরকারের পক্ষ থেকে আসেনি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর বিষয়টি সহায়ক হতে পারত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিপিসির আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির ১৪ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা পুঞ্জীভূত লোকসান ছিল। পরের ২০১৯-২০ অর্থবছরে লোকসান কাটিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা সংরক্ষিত আয় রাখতে সক্ষম হয়। এর পর থেকে প্রতি বছরই বিপিসির সংরক্ষিত আয় আরো স্ফীত হয়েছে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ২৭ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিসির ৩ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা হতে পারে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। ফলে সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে প্রতিষ্ঠানটির সংরক্ষিত আয় ৩০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আর্থিক দিক দিয়ে বর্তমানে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বিপিসি। স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত তহবিল সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার জন্য একটি আইন করেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এ আইনের অধীনে ২০১৯-২০ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিপিসি সরকারের কোষাগারে ১১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারকে কোনো অর্থ জমা দেয়নি সংস্থাটি।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিসি ৫৫ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার জ্বালানি তেল আমদানি করে। এর মধ্যে পরিশোধিত জ্বালানি তেল ছিল ৯ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকার। আর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলে ব্যয় হয় ৪৬ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে বিপিসি ৬৭ লাখ ২৭ হাজার ৬০১ টন জ্বালানি তেল বিক্রি করে, যা আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ কম।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ আগের অর্থবছরের তুলনায় বিপিসির ব্যয় কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, এ দুই মাসে জ্বালানি তেল আমদানির এলসি খোলায় ব্যয় হয়েছে ১২৫ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৬ দশমিক ২০ শতাংশ কম। এলসি খোলার পাশাপাশি এ সময়ে এলসি নিষ্পত্তিতেও ব্যয় কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল ১৩৩ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ দশমিক ১৪ শতাংশ কম। মূলত জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ার কারণেই এলসি খোলায় ব্যয় কমেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বছরের সবসময় এলসি এক রকম হয় না। এটি শুরুতেই একটু কম হয়। তাছাড়া জ্বালানি তেল আমদানিতে সরবরাহকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। দু-একটি কার্গো আমদানি হয়তো সপ্তাহখানেকের মতো পিছিয়েছে। জ্বালানি তেলের মজুদের কোনো ঘাটতি নেই। যে পলিসিতে বিপিসি জ্বালানি তেলের মজুদ সংরক্ষণ করে, তা অব্যাহত রয়েছে।’

জুলাইয়ে ইন্টারনেট সংযোগ বিঘ্নিত হওয়ায় এলসিতে প্রভাব পড়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের মধ্যে এলসি ডেফার্ড হয়নি। নিয়মিতভাবে এলসি করা হচ্ছে। তবে সম্প্রতি বিপিসি বেসরকারি ব্যাংকে জ্বালানি তেলের এলসি করছে, যা আগের স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি হচ্ছে। সরবরাহকারীদের আশ্বস্ত রাখতে বেসরকারি ব্যাংকে এলসি খোলা হচ্ছে। গত দুই মাসে জ্বালানি তেলের দাম সহনীয় পর্যায়ে চলে আসছিল, মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার কারণে বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। ফলে নিম্নমুখী প্রাক্কলনে বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। আমরা বিপিসির পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক বাজারের জ্বালানি তেলের মূল্য সরকারকে অবহিত করছি। এরপর সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটি চূড়ান্ত হবে।’

দুই বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন আয়ের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের জীবনযাপনও দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশে মূলত চার খাতেই ৯৭ শতাংশ জ্বালানি তেল ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে পরিবহন খাতে ৫৮ দশমিক ২১, কৃষি খাতে ১৫ দশমিক ৫০, বিদ্যুতে ১৭ দশমিক ৭৪ ও শিল্পে ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ জ্বালানি তেল ব্যবহার করা হয়। পণ্যের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ চার খাত গুরুত্বপূর্ণ। এ অবস্থায় লাভের চিন্তা না করে বিপিসি জ্বালানি তেলের দাম কমালে সেটি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘বিভিন্ন খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে জ্বালানি খাতের সংস্কারের দাবি তোলা হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের বিষয়টি বলা হয়েছে। সরকার যেসব পণ্য বা সেবার দাম নির্ধারণ করছে, সেটি যৌক্তিক ও ন্যায্য কিনা তা যাচাই-বাছাই করার অধিকার ভোক্তার রয়েছে। এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বিপিসির জ্বালানি তেলের যে দাম এবং যে প্রক্রিয়ায় তেলের মূল্য নির্ধারণ জ্বালানি বিভাগ করছে, সেটি যৌক্তিক কিনা তা যাছাই করতে হবে। এজন্য প্রতি মাসে ফর্মুলা (স্বয়ংক্রিয় মূল্য) নির্ধারণ প্রক্রিয়াটি গণশুনানির ভিত্তিতে হওয়া দরকার। তাহলে সঠিক দাম নির্ধারণ করা যাবে। ভোক্তাও পণ্যটি ন্যায্যমূল্যে পাবে।’

বিপিসির জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় মোট ১০ ধরনের খরচ ধরা হয়। রিফাইনারি থেকে ভোক্তা পর্যায়ে এ তেল পৌঁছতে বিপিসির উন্নয়ন তহবিল, বিপণন প্রতিষ্ঠানকারীর মার্জিন, পরিবহন তহবিল, ডিলার এজেন্ট কমিশনসহ নানা খরচ রয়েছে। এর সঙ্গে বড় আকারের মুনাফা মার্জিনও যোগ করে বিপিসি। সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স ও আনুষঙ্গিক ব্যয় জ্বালানি তেলের ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেয়ার পরও এ মুনাফার মার্জিন কতটা যুক্তিসংগত ও নৈতিক সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা।

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে চলতি বছরের মার্চ-জুন পর্যন্ত জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করেছে বিগত সরকার। স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ ফর্মুলায় দাম নির্ধারণে লিটারপ্রতি ডিজেল-কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের কিছু মাত্রায় ওঠানামা করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ বাতিল করে দিয়েছে। সে সঙ্গে বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ আপাতত বন্ধ থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জ্বালানি তেল কেনার পরিকল্পনা রয়েছে ৭৩ লাখ ১২ হাজার টন। এর মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে ৪৪ লাখ ৮০ হাজার টন এবং উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ২৮ লাখ ৩২ হাজার টন। চলতি বছরের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করে। ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি তেলের দাম কমতে থাকায় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ব্যারেলপ্রতি ৬৬ ডলারে নেমে আসে। ইরান-ইসরায়েল ও লেবানন সংঘাত নতুন মাত্রা নিলে পুনরায় জ্বালানি তেলের দাম ৭৮ ডলারের ওপরে উঠে যায়। জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বমুখী এ ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

আরও