পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির সাম্প্রতিক চিত্র ও চ্যালেঞ্জ

বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে ২০১০ সালে তোষা পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে দ্বিতীয় ধাপে দেশী পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কৃত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি এক সোনালি অধ্যায়। কিন্তু তারও অনেক আগে থেকে পাট বাংলাদেশের সোনালি আঁশ নামে পরিচিত। পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির মাধ্যমে বাংলাদেশ অতীতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে।

বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে ২০১০ সালে তোষা পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে দ্বিতীয় ধাপে দেশী পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কৃত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি এক সোনালি অধ্যায়। কিন্তু তারও অনেক আগে থেকে পাট বাংলাদেশের সোনালি আঁশ নামে পরিচিত। পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির মাধ্যমে বাংলাদেশ অতীতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। জাতীয় অর্থনীতিতে পাটের এ অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে পাটকে সোনালি আঁশের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। মাঝে অনেক বছর ক্রান্তিকাল পেরিয়ে বিগত দশক থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে পাট খাত। সেই ধারাবাহিকতায় রফতানি বাণিজ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে খাতটি। আকিজ গ্রুপের স্বাধীন সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ১২ লাখ টন কাঁচা পাট উৎপাদন হয়। এর মধ্যে আট থেকে সাড়ে আট লাখ টন রফতানি হয়।

বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া পাট চাষের উপযোগী। তাই বিশ্বের সেরা মানের পাট এ দেশেই উৎপন্ন হয়। পাট অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাট ও পাট শিল্পের সঙ্গে জড়িত। বিশ্ববাজারের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ কাঁচা পাট এবং প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ পাটজাত পণ্য বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাট রফতানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছে। পাট খাতের বৈশ্বিক রফতানি আয়ের ৭২ শতাংশ বর্তমানে বাংলাদেশের দখলে। একক কৃষিপণ্য হিসেবে বর্তমানে জাতীয় রফতানি আয়ে পাট খাতের অবস্থান দ্বিতীয়। পাট অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জিডিপিতে এ খাতের অবদান ২ দশমিক ৮ শতাংশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ লাখ ২১ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। পাট অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বছরে দেশে ৮৫-৯০ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার আয় করেছে। এর মধ্যে কাঁচা পাট রফতানি থেকে আয় হয়েছে ২১ কোটি ৬১ লাখ ৮০ হাজার ডলার। পাটের পাশাপাশি বাংলাদেশে তৈরি বিভিন্ন পাটজাত পণ্য সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। নানাবিধ শিল্পে পাটের বহুল ব্যবহার প্রচলিত আছে। এমনকি পাটের বর্জ্যও ফেলনা নয়! ড. মো. আব্দুল আউয়াল ও কৃষিবিদ ড. মো. আল-মামুনের রচনা অনুসারে, পাট ও পাটজাত বর্জ্যের সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব বিশেষ সোনালি ব্যাগ তৈরি হয়। পাটের তৈরি জিন্সও (ডেনিম) সারা বিশ্বের ফ্যাশনসচেতন মানুষের নজর কেড়েছে। পাট ও তুলার মিশ্রণে তৈরি হচ্ছে সুতা (ভেসিকল)। পাট কাটিংস ও নিম্নমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারকেলের ছোবড়া মিশিয়ে জুট জিওটেক্সটাইল উৎপন্ন হয়। তাছাড়া পাটখড়ি থেকে উৎপাদিত ছাপাখানার বিশেষ কালি (চারকোল) এবং পাট পাতা থেকে উৎপাদিত ভেষজ পানীয় রফতানি পণ্য হিসেবে বিশ্ববাসীর জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। পাট দিয়ে তৈরি হচ্ছে শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বাহারি ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালমেট, আল্পনা, দৃশ্যাবলি, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা, স্যান্ডেল, শিকা, দড়ি, সুতলি, দরজা-জানালার পর্দার কাপড়, গয়না ও গয়নার বাক্সসহ নানাবিধ পণ্য। এ ধরনের ২৩৫ রকমের আকর্ষণীয় ও মূল্যবান পণ্য জাহাজে চড়ে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এমনকি বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাল্প, ইনসুলেশন শিল্প, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিকস, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে।

পাট খাতের অগ্রগতি ধরে রেখে আরো সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে সরকারিভাবেও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৬ সালে ৬ মার্চকে জাতীয় পাট দিবস ঘোষণা করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ৬ মার্চ ‘পাট শিল্পের অবদান, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ’ প্রতিপাদ্যে জাতীয় পাট দিবস উদযাপিত হয়েছে। পাটজাত পণ্যকে চলতি বছরের বর্ষপণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও প্রসার, গবেষণা ও পাট চাষে উদ্বুদ্ধ করতে পাট আইন ২০১৫, পাট নীতি ২০১৫, বস্ত্র শিল্প প্রতিষ্ঠান আইন ২০১৫ ও বস্ত্র নীতি ২০১৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। পাটচাষীদের সহায়তা করার জন্য একটি তহবিল গঠন করেছে সরকার। রফতানিমুখী পাটজাত পণ্যের বহুমুখীকরণে এ খাতে নগদ সহায়তা বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে।

তবে এতসব উদ্যোগের পরও ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুসারে, বিগত অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানিতে ১৯ শতাংশের বেশি ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাট খাত থেকে বাংলাদেশ ৯১ দশমিক ২২ কোটি ডলার আয় করেছে। এর কারণ হিসেবে পাট খাতে অন্যতম বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান আকিজ বশির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ বশির উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পাটপণ্যের সর্ববৃহৎ বাজার ছিল তুরস্ক। এ বাজারে দুই লাখ টনের চাহিদা এখন এক লাখ টনের নিচে নেমে এসেছে। দ্বিতীয় বৃহৎ বাজার ছিল চীন। এখন ভারত সবচেয়ে বড় বাজার। কিন্তু বাজারটি টেকসই না। দেশটির পক্ষ থেকে অ্যন্টি-ডাম্পিং ডিউটি আরোপিত থাকার ফলে কয়েকজনের মধ্যে ব্যবসাটা নিয়ন্ত্রিত হয়। কারণ অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটির হার বাংলাদেশের সব মিলারদের ক্ষেত্রে সমান নয়। এতে করে কিছু কিছু বাংলাদেশী মিলার ডিউটির ক্ষেত্রে লেভারেজ পায়, কিছু মিলার তা পায় না। কিন্তু ডিউটির হারে ভিন্নতা থাকা উচিত নয়। এটা জেনারালাইজ করলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে এবং পাট শিল্প টিকে থাকতে পারবে। এ অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি প্রত্যাহার করাতে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়া উচিত।’ উৎসে করও পাট শিল্পের বিকাশে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন এ ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘বর্তমান ট্যাক্স রুল অনুযায়ী পাট সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে একটা উৎস আয়কর কাটার নিয়ম আছে। এ উৎস আয়করের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এটা কৃষকের ঘাড়ে গিয়ে পড়বে। পাট শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে।’

পাট ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন, সংগ্রহ ও রফতানিতে এসব চ্যালেঞ্জ যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে হবে। সেগুলো মোকাবেলায় গ্রহণ করতে হবে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে থাকা বাধাগুলো দূর করতে হবে। এসব কার্যকর করার মাধ্যমেই পাট ও পাটজাত পণ্যের অগ্রযাত্রা জারি রাখা সম্ভব।

লেখক: সাংবাদিক

আরও