১৪৫টি দেশে প্রাণের কোনো না কোনো এগ্রিকালচারাল প্রডাক্ট যায়

বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক। আমাদের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। পুরো বিশ্বের জনসংখ্যা ৭০০ কোটি। তাদের খাদ্যসামগ্রী দরকার। সেখানে আমাদের অনেক পটেনশিয়ালিটি আছে। আমাদের মতো বা আমাদের থেকে ভালো দেশ আছে, যারা প্রতি বছর অনেক খাদ্যপণ্য রফতানি করে। যেমন ভিয়েতনাম ও নেদারল্যান্ডস। আসলে আমার মনে হয় এ দুটো দেশ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।

কৃষিপণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কেমন?

বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক। আমাদের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। পুরো বিশ্বের জনসংখ্যা ৭০০ কোটি। তাদের খাদ্যসামগ্রী দরকার। সেখানে আমাদের অনেক পটেনশিয়ালিটি আছে। আমাদের মতো বা আমাদের থেকে ভালো দেশ আছে, যারা প্রতি বছর অনেক খাদ্যপণ্য রফতানি করে। যেমন ভিয়েতনাম ও নেদারল্যান্ডস। আসলে আমার মনে হয় এ দুটো দেশ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। সেটাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের এগ্রো রিলেটেড ফুডের বাস্কেটটা অনেক বড় করতে হবে।

কৃষিপণ্য রফতানিতে প্রাণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রাণ কী কী কৃষিপণ্য রফতানি করে?

প্রাণ কৃষিপণ্য রফতানি নিয়ে কাজ করে আসছে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে দেশের মোট রফতানির প্রায় ৩৫ শতাংশ প্রাণ করে থাকে। যদি আমরা সামগ্রিক কৃষিপণ্যের রফতানির কথা বলি তাহলে গত বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার রফতানি হয়েছে। আমরা নয়টি ভিন্ন ক্যাটাগরির প্রডাক্ট নিয়ে কাজ করি। এর মধ্যে আছে দুধ, ডিম, স্ন্যাকস, বিভিন্ন ধরনের কনফেকশনারি, বিস্কুট, বেকারি, ফ্রোজেন ফুড, নুডলস, ফ্রাইড স্ন্যাকস ইত্যাদি। আমরা যা উৎপাদন করি, তার সবই বাইরে রফতানি করি। শুধু যেগুলোর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ আছে, সেগুলো ছাড়া। ওসব বাদে বাকি সব প্রডাক্টই আমরা রফতানি করি। রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের প্রায় ১৪৫টা দেশে কোনো না কোনো প্রডাক্ট যায়। সবই এগ্রিকালচারাল। যেমন জুস, ডেইরি, স্ন্যাকস সবই কৃষিভিত্তিক। মার্কেট সাইজ আর এক্সপোর্ট সাইজ অনেক বড় একটা ব্যাপার। আমাদের কন্ট্রিবিউশন কান্ট্রি খুবই কম। বিশ্বে বাংলাদেশের প্রডাক্টের চাহিদা আছে। আমরা যখন প্রডাক্টগুলো তৈরি করি, তখন মোটামুটি একটা সলিউশন ওয়াল্ড মার্কেট দিতে পারি। এছাড়া কিছু প্রডাক্টের কোয়ালিটি বাংলাদেশের মাটি বা অন্যান্য কারণে অনেক বাড়ে। তাই বিশ্ব মার্কেটে বাংলাদেশের প্রডাক্টের অনেক গুরুত্ব আছে।

কৃষিপণ্য উৎপাদনে প্রাণের যাত্রা কীভাবে?

আমরা আসলে এজেন্ট প্রসেসরে এসেছি ১৯৯২ সালে। বাংলাদেশে ফরমালি আমরাই প্রথম মাইক্রো প্রসেসিং শুরু করি। তার আগে আমরা শুধু এগ্রিকালচারাল প্রডাক্ট প্রডিউস করতাম। আমাদের লক্ষ্য ছিল যে এগ্রিকালচারাল প্রডাক্ট লোকাল মার্কেটে বিক্রি করা। ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি আমরা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতাম। পরে দেখলাম এতে আমাদের লাভ হচ্ছে না। আমাদের এগ্রিকালচারাল প্রডাক্ট মূল্য অথবা বিক্রয়ের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের লস হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যেত উৎপাদন খরচ উঠে আসত না। সেখান থেকে আমরা চিন্তা করলাম এটাকে কীভাবে প্রসেস করে ভ্যালু বাড়ানো যায়। সেটা করলে আমরা সিজন্যাল প্রডাক্টগুলো সারা বছর দেশে ও বিদেশে ব্যবহার করতে পারব। সে ধারণা থেকেই আসলে আমাদের প্রসেসিংয়ে আসা এবং বিভিন্ন ধরনের প্রডাক্ট তৈরি করা। এভাবে অর্থনৈতিকভাবে আমরা সমৃদ্ধ হয়ে গেলাম। 

কৃষিপণ্য রফতানির চিন্তাভাবনা কীভাবে আসে?

আসলে আমরা ১৯৯২ সালে প্রথম শুরু করি খুব ছোট পরিসরে। এরপর আমাদের রেঞ্জটা আস্তে আস্তে বাড়াতে থাকি। আমরা পাইন আপেল ক্যান তৈরি করতাম, ফ্রুট ড্রিংক আনলাম আমরা কাচের বোতলে, এরপর টেট্রাপ্যাকে, এরপর প্লাস্টিকের বোতলে ফরমাল প্যাকেজিং আনলাম। এক্সপোর্ট আমাদের অলওয়েজ একটা টার্গেট ছিল। তো আমরা লোকাল মার্কেটের পাশাপাশি চেষ্টা করছিলাম বাইরের মার্কেটে নিয়ে যাওয়ার। সে হিসেবে ১৯৯৭ সালে আমাদের প্রথম চালান এক্সপোর্টের প্রডাক্ট দিই। স্লাইস পাইন আপেল ক্যান এক্সপোর্ট শুরু করি। ১৯৯২-৯৭ পর্যন্ত আসলে আমাদের তেমন কোনো ইম্প্রুভ হয়নি। সে সময় আসলে আমাদের প্রডাক্ট ডেভেলপ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। প্রডাক্ট বাইরে নিতে গেলে আসলে কিছু স্টাডি করা লাগে। বিশ্বাস পাওয়ারও ব্যাপার আছে। আসলে মানুষের কনফিডেন্সের জায়গা লাগে তো। এখন পর্যন্ত দেশের সংখ্যা আমাদের অনেক বাড়ছে। আমরা এখন ১৪৫টি দেশে রফতানি করি।

আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা লক্ষ্য কী?

আমাদের অনেক টার্গেট রয়েছে। প্রথম টার্গেট বাংলাদেশের যে এক্সপোর্ট বাস্কেট তা আরো বাড়াতে চাই। আমাদের টার্গেট হচ্ছে এক্সপোর্টে একটা সিগনিফিকেন্ট কন্ট্রিবিউশন করা। ২০২৫ সালের মধ্যে আমরা ১০০ কোটি ডলারের এক্সপোর্ট করতে চাই। সেটা হচ্ছে এক্সপোর্টের পরিমাণের দিক দিয়ে। আরেকটা হলো আমাদের প্রডাক্ট ও পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে কাজ করছি। এখন আমরা যে প্রডাক্টগুলো উৎপাদন করি, সেগুলো আমাদের লোকাল মার্কেটের জন্য উন্নত। এখন আমাদের বিদেশের মার্কেটে যে প্রডাক্টগুলো চলে, বিদেশের লোকজনের কথা চিন্তা করে আমরা আমাদের প্রডাক্টের রেঞ্জটাকে উন্নত করার জন্য কাজ করছি। যেমন বাইরের দেশের লোকজন প্যাকেজড ফুড খায়, সেটা রাইস, পিৎজা বা স্যান্ডউইচ হোক। বাইরের মানুষের জন্য আমাদের প্রডাক্ট উন্নত করার চেষ্টা করছি। রিঅ্যারেঞ্জ করার চেষ্টা করছি।

কৃষিপণ্য রফতানির অন্যতম পূর্বশর্ত নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন?

অবশ্যই সেফটি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এগুলো ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো একসময় খাবার পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন যখন পাওয়া যাচ্ছে, তখন সেটা নিরাপদ। নিরাপদ যেমন পুষ্টিকর কিনা। বিভিন্ন ধরনের বিষয়, এগুলো ধাপে ধাপে এগোচ্ছে কিনা। ফুড সেফটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে না, পুরো বিশ্বের। এটার জন্য আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ইনটারনালি যতটুকু পসিবল, সেগুলো আমরা নিচ্ছি। যেমন ধরেন কিছু ইন্টারনাল ফ্যাক্টর, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে, সেগুলো আমরা করেছি। আমরা বিভিন্ন গাউডলাইন মেইনটেইন করি। আমরা হালাল সার্টিফায়েড, যা অনেক গুরত্বপূর্ণ। আমরা আইএসও সার্টিফায়েড। কিছু এক্সটার্নাল ফ্যাক্টর আছে। একটা উদাহরণ দিই। আপনি একটা সবজি উৎপাদন করবেন যেমন বাঁধাকপি। এ বাঁধাকপির জন্য আপনি কী পানি দিচ্ছেন? আমরা সাধারণত পাশের ডোবা-নালা থেকে পানি দিই। ওই পানি যদি দূষিত থাকে, ল্যাট্রিন বা কলকারখানার বর্জ্য থাকে, তাহলে সেই দূষিত উপাদানের প্রভাব বাঁধাকপিতেও ছড়াতে পারে। এরপর ধরেন পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য কীটনাশক দেয়া হলো। ওই সবজিকে ল্যাবে টেস্ট করলে কীটনাশক পাওয়া যাবে। ফলে কতটুকু মাত্রায় কখন এবং কত দিন পরে পরে জমিতে কীটনাশক দেয়া যাবে তা জানা জরুরি। বাঁধাকপি নিয়ে রিপোর্ট হয়েছে। বাংলাদেশে এত বাঁধাকপি থাকতেও আমাদের আমদানি করতে হচ্ছে, এর কারণ কি টাকা বেশি হয়ে গেছে? কিন্তু আসল ইস্যুটা হচ্ছে নিরাপদ কিনা, তা নিশ্চিত করা।

কৃষিপণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধকতাগুলো কীভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব?

আমাদের এগ্রিকালচারে মনিটরিং বাড়ানো দরকার। খেত-খামারিতে যারা আছেন তাদের মধ্যে অনেস্টি গ্রোথ করতে হবে। ট্রান্সপোর্টেশন ও স্টোরেজ ব্যবস্থায়ও নজর দেয়া দরকার। দেখা যায় কৃষক ঠিকই উৎপাদন করছে, কিন্তু পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো যথাযথ না হওয়ায় ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশে ল্যান্ড হচ্ছে ছোট ছোট। আমাদের কৃষি ব্যবস্থা হচ্ছে জীবন ধারণভিত্তিক। সবাই পরিবারের চিন্তা করি। এ সবজি লাগাব, এটা পরিবার নিয়ে খাব। কিন্তু আমরা এ উদ্দেশ্যে উৎপাদন কম করি—এটা আমি চাষ করব, এটা দিয়ে আমার পুরো জেলার লোককে খাওয়াব। সমবায় খামারের মাধ্যমে যদি ছোট ছোট জমিকে একত্রিত করা যায়। তাহলে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন কৃষি ব্যবস্থা চালু করা যাবে। তখন চাহিদার আলোকে কতটুকু জায়গায় কী চাষ করবেন সেটাও আপনি কন্ট্রোল করতে পারবেন। এখন কিন্তু দেখবেন এক বছর পেঁয়াজ অনেক ভালো হলো, দাম কমে গেল। তখন পরের বছর পেঁয়াজ আর কেউ চাষ করছে না। আমরা চেষ্টা করছি বৃহৎ পরিসরে সমবায় পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার। আমাদের নিজস্ব জমি নেই। তবে আমরা কৃষকদের সঙ্গে কাজ করি। তাদের দিয়ে আমরা নির্দিষ্ট শস্য চাষ করাচ্ছি। বা তাদের হেল্প করছি গ্রো করার জন্য। আম, টমেটো, পাইন আপেল, বিভিন্ন রকম মসলা, হলুদ, মরিচ, এগুলো আমরা চুক্তি ভিত্তিতে কৃষকদের দিয়ে চাষ করছি। বাংলাদেশে ভালো ল্যাবরেটরিরও অভাব রয়েছে। অনেক জিনিস টেস্ট করা যায় না। অনেক টাকা খরচ করে আমরা দেশের বাইরে থেকে করি। এছাড়া প্যাকেজিংও একটা ম্যাটারস। আমাদের প্যাকেজিংয়ে দুর্বলতা রয়েছে। সার্বিকভাবে এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে কৃষিপণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক।

আরও