বিপরীতমুখী সংকটে ভারতের শ্রমবাজার

সরকারি খাতে নেই পর্যাপ্ত চাকরি বেসরকারিতে নেই দক্ষ কর্মী

ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের স্থানীয় কলেজ থেকে স্নাতক করেছেন আজেশ কুমার। সম্প্রতি সরকারি সংস্থার ক্লিনার পদে আবেদন করেছেন তিনি, যেখানে পাঁচ হাজার পদের জন্য লড়ছে চার লাখেরও বেশি চাকরিপ্রার্থী।

ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের স্থানীয় কলেজ থেকে স্নাতক করেছেন আজেশ কুমার। সম্প্রতি সরকারি সংস্থার ক্লিনার পদে আবেদন করেছেন তিনি, যেখানে পাঁচ হাজার পদের জন্য লড়ছে চার লাখেরও বেশি চাকরিপ্রার্থী। অর্থাৎ প্রতি ৮০ জনে একজন কাজ পাবেন। আজেশ কুমারের ঘটনাটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশে আনুষ্ঠানিক চাকরির দীর্ঘস্থায়ী ঘাটতির একটি উদাহরণ। উল্টোদিকে অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠান বলছে, বছরে লাখ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক সম্পন্ন করলেও যোগ্য কর্মীর অভাবে ভুগছে তারা। সম্প্রতি ভারতের চাকরি বাজারের ভারসাম্যহীন অবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এফটি।

আজেশ কুমার জানান, নিশ্চিত কর্মঘণ্টা, মজুরি অন্যান্য সুবিধার কারণে ভারতে সরকারি চাকরির ব্যাপক চাহিদা। ক্লিনার পদে নিজ পরিবারের আরো দুই সদস্যের সঙ্গে আবেদন করলেও তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে আজেশ মনে করেন, চাকরি পাওয়ারকোনো আশা নেই, কোনো সুযোগ নেই

আগামীকাল অনুষ্ঠিত হচ্ছে হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচন। এখানে বিরোধীরা বিদ্যমান বেকারত্ব আনুষ্ঠানিক কাজের অভাবকে প্রধান এজেন্ডা হিসেবে সামনে এনেছেন, যা ২০১৪ সালের পর প্রথমবারের মতো বিজেপিকে সংসদীয় সংখ্যালঘুতে ঠেলে দেয়ার অন্যতম কারণ হয়ে উঠতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় অর্থনীতি তরুণ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি এবং প্রশিক্ষণ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। অসামঞ্জস্য ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে এবং ক্ষমতায় দ্বিতীয় দশকে নরেন্দ্র মোদির জন্য এটি অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।

ভারতের শীর্ষ নিয়োগ কোম্পানি টিমলিজের সহপ্রতিষ্ঠাতা ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী বলেন, ‘প্রতি মাসে প্রায় ১০ লাখ চাকরিপ্রার্থী শ্রম বাজারে যুক্ত হচ্ছে। তাদের ১০ জনে নয়জনই অনানুষ্ঠানিক খাতে যোগ দেন। যেখানে কর্মসংস্থান চুক্তি নেই, সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা বা কোনো ধরনের সুরক্ষা সুবিধা মজুরির নিশ্চয়তা নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় জর্জ মেসন ইউনিভার্সিটির মারকাটাস সেন্টারের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে যুক্ত আছেন শ্রুতি রাজাগোপালান। তার মতে, সবচেয়ে দরিদ্র ভারতীয়রা নির্মাণ শিল্পের মতো খাতে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করে। তাদের সামনে খুব বেশি বিকল্প নেই। কিন্তু আর্থিক অবস্থানে মাঝামাঝি থাকা লোকেরা সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা করে।

নরেন্দ্র মোদির সরকার বেকারত্ব মোকাবেলায় বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচন-পরবর্তী প্রথম বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ একটি শিক্ষানবিশ প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন, যার মাধ্যমে পাঁচ বছরে এক কোটি তরুণ-তরুণী উপকৃত হবে। এতে কোম্পানিগুলোর জন্য প্রশিক্ষণ ভর্তুকি, শিক্ষানবিশদের জন্য উপবৃত্তি বৃত্তিমূলক স্কুলে পাঠ্যক্রম সংশোধনের প্রতিশ্রুতি ছিল। এর আগের মেয়াদে কমানো হয় করপোরেট কর। একই সঙ্গে কর্মসংস্থান বাড়াতে শ্রম আইন সংশোধনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল।

করপোরেট কোম্পানিগুলো বলছে, ভারতে শীর্ষ পদে যোগ্য প্রার্থীর অভাব রয়েছে। মুম্বাইভিত্তিক বহুজাতিক গোষ্ঠী লারসেন অ্যান্ড টুব্রো গত জুনে জানিয়েছিল, তাদের নির্মাণ থেকে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবসায় ৪৫ হাজার দক্ষ শ্রমিক প্রকৌশলীর অভাব রয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষ কর্মীর চাহিদা সরবরাহের ব্যবধান নরেন্দ্র মোদিরমেক ইন ইন্ডিয়া উদ্যোগকে কার্যকর হওয়া থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। এমনকি ভারতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। দেশটির বৃহত্তম আইটি কোম্পানি টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসের প্রধান নির্বাহী কে কৃত্তিবাসনের মতে, প্রতি বছরে অনেকেই স্নাতক সম্পন্ন করে। কিন্তু তাদের কর্মসংস্থানের উপযোগী করতে আরো অনেক কিছু করতে হবে।

প্রাইভেট ইকুইটি ফার্ম আরিন ক্যাপিটালের চেয়ারম্যান আইটি জায়ান্ট ইনফোসিসের সাবেক প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা মোহনদাস পাই জানান, ভারতের অর্থনীতি বার্ষিক প্রায় শতাংশ হারে সম্প্রসারণ হওয়ায় বেশির ভাগ শিল্প দক্ষ কর্মী খুঁজে পেতে লড়াই করছে। এখানে নিয়োগযোগ্য কর্মীর চেয়ে চাকরির পরিমাণ বেশি। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি প্রশিক্ষণের জন্য খরচ করতে ইচ্ছুক নয়।

দেশটির গড় বেতনের সঙ্গে জীবনযাত্রা ব্যয়ও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এক জরিপ অনুসারে, ভারতে প্রায় ৮০ শতাংশ চাকরিতে মাসিক বেতন ২৩৮ ডলার বা ২০ হাজার রুপির কম, যা ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে যথেষ্ট নয়। শ্রুতি রাজাগোপালান জানান, অনেক সময় জটিল শ্রম আইনের সুযোগ নিয়ে অনেক কোম্পানি চুক্তি ছাড়াই অনানুষ্ঠানিকভাবে কর্মী নিয়োগ করে।

নরেন্দ্র মোদি সরকার ২০২০ সালে ভারতের শ্রম আইনে বড় ধরনের সংস্কার আনে। যেখানে একটি শিফটে সর্বোচ্চ কত কর্মী থাকবে বা কারখানায় কয়টি ঘড়ি রাখা হবে, এমন খুঁটিনাটি বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিন্তু সংস্কারগুলো কার্যকর হয়নি।

ভারতের বেকারত্বের পরিমাপ নিয়েও মতভেদ রয়েছে। গবেষণা সংস্থা দ্য সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির (সিএমআইই) প্রতিবেদন অনুসারে, আগস্টে দেশটিতে বেকারত্বের হার ছিল দশমিক ৫১ শতাংশ। সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহেশ ব্যাস বলেন, ‘বার্ষিক - শতাংশ হারে বেকারত্ব বৃদ্ধি একটি দেশের জন্য অনেক বেশি। গ্রামীণ শহর উভয় অঞ্চলেই এখন দীর্ঘ সময়ের জন্য বেকারত্বের হার খুব বেশি দেখতে পাচ্ছি।

অন্যদিকে সরকারের প্রান্তিকভিত্তিক পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (পিএলএফএস) অনুসারে, দেশটিতে বেকারত্বের হার শতাংশের নিচে এবং ক্রমে পতনশীল। বিশ্লেষকরা জানান, কৃষিসহ খণ্ডকালীন কাজকে বিবেচনায় আনায় পরিসংখ্যান অসংতিপূর্ণ। মহেশ ব্যাসের দাবি, পিএলএফএস প্রতিবেদনে চাকরির সংজ্ঞাখুব শিথিল

আরও