রংপুরের আলু যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে

কয়েক বছর ধরে রংপুর থেকে নিয়মিত আলু রফতানি হওয়ায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে আলু উৎপাদনে। পাশাপাশি আলুর মৌসুমে আলু রফতানিকে ঘিরে কাজের সুযোগ হয়েছে ১০ হাজারের বেশি, যা প্রতি বছরে বাড়ছে। এদিকে আলুর চাহিদা বাড়ায় ছয় বছরে আলুর জমি বেড়েছে দুই হাজার হেক্টরের বেশি। তবে রফতানিযোগ্য আলুর উৎপাদন কম হওয়াসহ কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে বিদেশে রংপুরের আলুর

কয়েক বছর ধরে রংপুর থেকে নিয়মিত আলু রফতানি হওয়ায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে আলু উৎপাদনে। পাশাপাশি আলুর মৌসুমে আলু রফতানিকে ঘিরে কাজের সুযোগ হয়েছে ১০ হাজারের বেশি, যা প্রতি বছরে বাড়ছে। এদিকে আলুর চাহিদা বাড়ায় ছয় বছরে আলুর জমি বেড়েছে দুই হাজার হেক্টরের বেশি। তবে রফতানিযোগ্য আলুর উৎপাদন কম হওয়াসহ কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে বিদেশে রংপুরের আলুর ব্যাপক চাহিদা থাকলেও রফতানি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। 

রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও রফতানিকারকদের সূত্রে জানা গেছে, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় উৎপাদিত প্রায় ১১ হাজার ৮০০ টন আলু শ্রীলংকা, নেপাল, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরো কয়েকটি দেশে রফতানি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে আলু রফতানি হয়েছিল ১৯ হাজার টন। চলতি মৌসুমে আলুর উৎপাদন কম হওয়াসহ অভ্যন্তরীণ বাজারে আলুর মূল্য ঊর্ধ্বমুখী থাকায় রফতানি কম হয়েছে। কৃষি বিভাগের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আলু কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত একাধিক প্রতিষ্ঠান। তাদের দাবি আলু রফতানি আরো বেশি হয়েছে। কারণ অনেকে জেলায় বাইরে থেকে আলু সংগ্রহ করে রফতানি করেছেন, যা হিসাবে নেই বলে তারা জানান।

রংপুর জেলার নব্দীগঞ্জ, মীরবাগ, কাউনিয়া, পাওটানা, হুলাসু, দেওতি, বড়দরগা, রঘু, মীরগঞ্জ, মাহিগঞ্জ, সাহেবগঞ্জ, দমদমা, ঠাকুরবাড়ী, মিঠাপুকুর ও বৈরিগঞ্জে অবস্থিত শতাধিক ব্যবসায়ী প্রতি বছর কৃষকদের কাছ থেকে আলু কিনে কমিশনে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মালিকানাধীন রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আল সামস এন্টারপ্রাইজ, গ্রিনটেক, এগ্রোফ্রেস এগ্রোনেস, কৃষাণ বোটানিক লিমিটেড, পিকে ইন্টারন্যাশনাল এবং এগ্রো কনসার্ন অন্যতম। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত রংপুরের উল্লিখিত পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন ২০-২৫ ট্রাক বোঝাই আলু শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই ও সিঙ্গাপুরে রফতানির উদ্দেশ্যে শিপমেন্টের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠাতে ব্যস্ত সময় কাটান ব্যবসায়ীরা।

২০১৮ সাল থেকে আলু রফতানি করে আসছে আল সামস এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এখন পর্যন্ত এক হাজার টনের বেশি আলু রফতানি করেছেন। রফতানিতে বিদ্যমান নানা প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. সামসুদ্দিন চৌকদার বলেন, ‘‌আলু রফতানিতে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত ও পাকিস্তান। যদিও অভ্যন্তরীণ বাজারে আলুর দাম বেড়েছে। এর পরও বিভিন্ন কারণে আমাদের আলুর চাহিদা আছে। কিন্তু সাদা আলু জেলায় পাওয়া যাচ্ছে না। আলু রফতানিতে সরকারও বেশ আন্তরিক। শর্তানুযায়ী, ২৮০ ডলারের আলু রফতানির জন্য শতকরা ২০ টাকা হারে ইনসেনটিভ দিচ্ছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বর্তমানে ওই পরিমাণ আলু পাঠাতে টাকা লাগছে ৪০০ ডলার। অথচ বেশি টাকা লগ্নি করেও আগের দরে ইনসেনটিভ নিতে হচ্ছে।’ তিনি বিষয়টি আমলে নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, ‘‌রংপুরে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি কনটেইনারে আলু ভর্তি করতে পারছেন না, তাই ট্রাকে করে আলু নিয়ে যাওয়ায় সময় অর্থের অপচয় হচ্ছে।’ পাশাপাশি জেলায় প্রয়োজনীয় আলুর স্বল্পতাও রফতানিকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে তিনি দাবি করেন।

রংপুর নগরীর বকুলতলার বাসিন্দা খাজা নিজামউদ্দিন। ৩২ বছরের বেশি সময় ধরে আড়তদার ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। নগরীর তামপাট এলাকায় রঘু বাজারে তার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান অবস্থিত। তিনি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আলু, বাঁধাকপি ও মিষ্টিকুমড়াসহ বিভিন্ন কাঁচামাল কমিশনে সরবরাহ করেন। চলতি বছরে তিনি মাত্র ২৬ টন আলু সরবরাহ করতে পেরেছেন। শুরুতে আলু কেজিপ্রতি ১৪-১৫ টাকায় কিনেছেন, সঙ্গে ব্যাগের জন্য ১ টাকা এবং পরিবহন ভাড়া আড়াই টাকা যোগ হয়েছে। পরে ওই আলু প্রতি কেজি ২৯-৩০ টাকায় কিনেছেন। ঈদের আগে তিনি শেষ আলু সরবরাহ করেছেন। অভ্যন্তরীণ বাজারে আলুর দাম বাড়লেও এখনো বিদেশে আলুর ব্যাপক চাহিদা আছে। কিন্তু তিনি রফতানিযোগ্য সাদা আলু জোগাড় করতে পারছেন না। ৮০ থেকে ৩০০ গ্রাম পর্যন্ত সাইজের ডায়মন্ড, গ্রানুলা ও সেভেন জাতের আলু সরবরাহ করেছেন। তবে শাহান শাহ জাতের আলুর ব্যাপক চাহিদা থাকলেও জেলায় আবাদ তেমন নেই বললেই চলে। তাই তিনি কৃষকের লাভের বিষয়টি বিবেচনা করে কৃষি বিভাগকে রফতানিযোগ্য আলুর আবাদ বৃদ্ধিতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার আহ্বান জানান।

রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, ‘‌ বেশ কয়েক বছর ধরে জেলায় উৎপাদিত আলু বিদেশে রফতানি হচ্ছে। ফলে কৃষকরা উৎপাদিত আলুর ভালো মূল্য পাচ্ছে।’ সাদা আলুর আবাদ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‌ যেকোনো ফসলের আবাদ নির্ভর করে বীজের সহজপ্রাপ্যতার ওপর। এ জেলার আলুচাষীরা দীর্ঘদিন ধরে যে বীজ পেয়েছেন সে আলু উৎপাদন করেছেন। তাই সাদা আলু রাতারাতি চাইলে উৎপাদন বাড়বে, এমনটা ভাবা ঠিক নয়। বর্তমানে সাদা আলুর চাহিদা বাড়ায় কৃষকরাও এ আলুর আবাদ বাড়াচ্ছেন।’

উল্লেখ্য, ২০১৭-১৮ মৌসুমে রংপুর জেলায় ৫১ হাজার ২৭৫ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছিল ১২ লাখ ১৭ হাজার ৮৭০ টন, ২০২২-২৩ মৌসুমে আলুর জমি বেড়ে হয়েছে ৫৩ হাজার ৩০৫ হেক্টর। আলুর উৎপাদন বেড়েছে ১৬ লাখ ৪ হাজার ৫৫৬ টন।


লেখক: সাংবাদিক

আরও