ইসরায়েলে ইরানি হামলার উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে বাজারে

বছরখানেক ধরে চলমান মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত চলতি সপ্তাহে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। লেবানন ঘিরে ইসরায়েলি তৎপরতার জবাবে তেল আবিবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান।

বছরখানেক ধরে চলমান মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত চলতি সপ্তাহে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। লেবানন ঘিরে ইসরায়েলি তৎপরতার জবাবে তেল আবিবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। এ ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের ওপর। পরিস্থিতি আরো খারাপ দিকে গড়াতে পারে এমন আশঙ্কায় মার্কিন শেয়ারবাজারে দরপতন দেখা যায়। একই সঙ্গে পরবর্তী পরিস্থিতিতে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাজার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। খবর রয়টার্স।

গত মঙ্গলবার তেল আবিবে ইরান ১৮০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে বলে জানায় ইসরায়েল। এ খবর প্রকাশের পর পরই মার্কিন শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ সম্পদের দিকে ছুটে যান। 

ইরান জানায়, লেবাননে হিজবুল্লাহ মিত্রদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অভিযানের প্রতিশোধ ছিল এ হামলা। অন্যদিকে ‘হামলাটি গুরুতর ও ইরানকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে’ ইসরায়েলের এমন ঘোষণায় উত্তেজনা আরো বাড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

এদিন লেনদেনের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের পতন ঘটে ১ দশমিক ৪ শতাংশ, দিন শেষে যা কমে দাঁড়ায় দশমিক ৯ শতাংশে। অন্যদিকে ট্রেডিংয়ের শুরুতে নাসডাক কম্পোজিট সূচক ২ দশমিক ৩ শতাংশ দর হারায়। পরে কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়ে সূচকে পতন দাঁড়ায় ১ দশমিক ৫ শতাংশ। এতে দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক দরপতন হলেও বিনিয়োগকারীরা পরবর্তী সময়ে কিছুটা ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। বাজার খানিকটা পুনরুদ্ধার সত্ত্বেও উভয় সূচকের সামগ্রিক নিম্নমুখী প্রবণতা বাজারে অন্তর্নিহিত উদ্বেগকে তুলে ধরে। একই সময় স্বর্ণ, ট্রেজারি বন্ড ও ডলারের মতো নিরাপদ গন্তব্যের দিকে ছুটে যান উদ্বিগ্ন বিনিয়োগকারীরা।

২০২২ সালে ইউক্রেনে রুশ হামলার পর রাতারাতি ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বেড়ে যায়। তখনো বাজারগুলো দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায়। ওই সময় বিনিয়োগকারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বিক্রির বিপরীতে স্বর্ণ ও ডলারের মতো নিরাপদ বিকল্পে অর্থ স্থানান্তর করেন। তবে বাজারের পরিবর্তনের হার খুব দ্রুত হলেও অস্থায়ী ছিল।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজারের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা নির্ভর করছে ইসরায়েলের ভূমিকার ওপর। এরই মধ্যে ইরান জানিয়ে দিয়েছে, ইসরায়েল কোনো পদক্ষেপ না নিলে তারা যুদ্ধ সামনে এগিয়ে নেবে না। কিন্তু দুই কঠোর প্রতিপক্ষের এ সংঘাতে আরো অংশীদার থাকায় বড় পরিসরে যুদ্ধের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকে।

বিনিয়োগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান টেলিমারের ইমার্জিং অ্যান্ড ফ্রন্টিয়ার মার্কেট বিভাগের হাসনাইন মালিকের মতে, পরিস্থিতি বর্তমানের চেয়ে আরো খারাপ হতে পারে, বিষয়টি আমলে নিয়ে বাজার অত্যন্ত সংবেদনশীল অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে ছোট কোনো পরিবর্তনেও বাজার দ্রুত সাড়া দিতে পারে।

গত এপ্রিলে প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের উদ্দেশে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের সহায়তায় বাধা দেয় তেল আবিব। ইসরায়েল হামলার প্রতিশোধ নিলেও পরিস্থিতি আর পরবর্তী উত্তেজনার দিকে গড়ায়নি। ওই সময় শুরুতে স্টক ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের দর পড়ে যায়। কিন্তু বৃহত্তর সংঘাত ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দ্রুত শিথিল হয়ে এলে কয়েক দিনের মধ্যেই বাজার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে টরন্টোভিত্তিক অ্যালান স্মল ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের সিনিয়র বিনিয়োগ উপদেষ্টা অ্যালান স্মল বলেন, ‘যদি যুদ্ধ বাড়তে থাকে, তা অবশ্যই বাজারের জন্য ভালো নয়।’ 

এদিকে জ্বালানি তেলের দাম কিছু বেড়েছে। বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন যে উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায় দাম দ্রুত বেড়ে যাবে। এর আগেও তীব্র চাপ বা সংঘাতের সময় এমনটা হয়েছিল।

এ বিষয়ে এলপিএল ফাইন্যান্সিয়ালের চিফ গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিস্ট কুইন্সি ক্রসবি বলেন, ‘সংঘাত যত গভীর হবে, ইরানের আশপাশে জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী অঞ্চলে সামরিক প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি তত বাড়বে। তাতে জ্বালানি তেলের দাম আরো বাড়তে পারে।’

অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনার ছাড়াও বেশকিছু সম্ভাব্য বাজার অনুঘটক রয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ ধরে রাখতে পারে। এর অন্যতম নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এছাড়া এ সপ্তাহে প্রকাশিতব্য মার্কিন কর্মসংস্থান প্রতিবেদন থেকে ফেডারেল রিজার্ভের পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যাবে, যা বাজারে উত্তেজনা বজায় রেখেছে। 

বাজারের এমন ওঠানামার মাঝে সুরক্ষা পেতে বিকল্পগুলোয় বিনিয়োগকারীরা কী পরিমাণ খরচ করতে ইচ্ছুক সিবিও ভোলাটিলিটি ইনডেক্সের (ভিআইএক্স) মাধ্যমে তা পরিমাণ করা হয়। এ সূচক বাড়ার অর্থ হলো, সম্পদ সুরক্ষার চাহিদা বাড়ছে, যা প্রায়ই বাজারের অনিশ্চয়তার কারণে হয়ে থাকে। গত মঙ্গলবার ভিআইএক্স তিন সপ্তাহের সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৭৩-এ পৌঁছে পরে ১৯ দশমিক ২৫-এ নেমে যায়। কুইন্সি ক্রসবির মতে, ভিআইএক্সের উত্থান ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের ইঙ্গিত দেয়। তবে ২০-এর নিচে থাকার অর্থ হলো, চরম সামরিক সংঘর্ষ বা সংকটের পূর্বাভাস নেই। অর্থাৎ বাজারে উদ্বেগ থাকলেও অতিমাত্রায় আতঙ্ক নেই। 

সব মিলিয়ে সংঘাত বাড়ার ভয় কতটা স্থায়ী হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে বাজার। পেপারস্টোনের সিনিয়র গবেষণা কৌশলবিদ মাইকেল ব্রাউনের মতে, আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যেকোনো নতুন ভূরাজনৈতিক সংবাদে বাজারগুলো খুব জোরালোভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।

আরও