সমুদ্রে কনটেইনার হারিয়ে যাওয়ার পরিণতি বেশির ভাগই অজানা

টি-শার্ট থেকে টেলিভিশন, সেলফোন থেকে ট্র্যাক্টর, প্রতিদিন সমুদ্রপথে বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল ও দৈনন্দিন পণ্য দীর্ঘ দূরত্বে স্থানান্তর হয়। সব মিলিয়ে বার্ষিক ২৫ কোটির মতো কনটেইনার সচল রাখে এ রুট। এর মধ্যে গত দেড় দশকে দুর্ঘটনা বা অসাবধানতাবশত ২০ হাজারের বেশি কনটেইনার হারিয়ে গেছে যাত্রা পথে। সেখান থেকে কিছু ধ্বংসাবশেষ ভেসে গেছে উপকূলে, যোগ হয়েছে সামুদ্রিক প্রাণীর আবাসস্থল বা আবর্জনার ঘূর্ণিতে। কিন্তু ধ্বংবাবশেষের বড় অংশ কখনই উদ্ধার করা হয় না। আর্থিক বিচারে কোম্পানির ক্ষতি হিসাব করা হলেও এসব ঘটনার পরিবেশগত ক্ষতি এখনো অনির্ণীত। খবর এপি।

প্রতি বছর কী পরিমাণ কার্গো হারিয়ে যায়, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। ১৬ বছরের তথ্য অনুসরণ করে ওয়ার্ল্ড শিপিং কাউন্সিল জানিয়েছে, বছরে গড়ে প্রায় দেড় হাজার কনটেইনার হারিয়ে যায়। তবে অন্যরা বলছে, প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি।

দুর্ঘটনার ধরনের ওপর ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করে। ২০২০ সালের নভেম্বরে দৈত্যাকার কার্গো জাহাজ ওয়ান আপুস থেকে প্রায় দুই হাজার কনটেইনার প্রশান্ত মহাসাগরে ছড়িয়ে যায়, তখন জাহাজটি চীন থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় যাচ্ছিল। এতে ছিল সাইকেল হেলমেট ও জুতা। ইলেকট্রনিকসের পাশাপাশি ছিল ব্যাটারি, ইথানল ও আতশবাজির মতো বিষাক্ত পণ্য। গবেষকরা প্রশান্ত মহাসাগরীয় কয়েক হাজার মাইল উপকূলরেখায় এ ধ্বংসাবশেষ প্রবাহ চিহ্নিত করেছেন, যেখানে রয়েছে ওয়াশিংটনের লংবিচ ও হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জের সামুদ্রিক পাখিদের অভয়ারণ্য।

ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরি বে ন্যাশনাল মেরিন স্যাঙ্কচুয়ারির সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু ডিভোগেলার বলেন, ‘দৃষ্টির বাইরে বলে এসব ঘটনা মনের বাইরে, এমনটা ভাবতে পারেন। এর অর্থ এই নয় যে এসব ঘটনার বিশাল পরিবেশগত পরিণতি নেই। আমরা যা কিছু কেনাবেচা করি, তার কিছু সমুদ্রের তলদেশে টাইম ক্যাপসুল হিসেবে রেখে যাচ্ছি, সম্ভবত কয়েকশ বছর ধরে সেখানে থাকবে।’

গত গ্রীষ্মে শ্রীলংকার কলম্বো উপকূলের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে প্লাস্টিকের কণা। এ উপকূলের কাছে তিন বছর আগে পুড়ে যাওয়া কার্গো জাহাজ এক্স-প্রেস পার্লের ধ্বংসাবশেষ এভাবে স্থানীয় আবহাওয়াকে দূষিত করছে। এ বিপর্যয়ে ১ হাজার ৪০০টির বেশি শিপিং কনটেইনার সমুদ্রে ফেলে দেয়া হয়। যেখানে ছিল নর্ডল নামে পরিচিত বিলিয়ন বিলিয়ন প্লাস্টিক কণা। সেই সঙ্গে হাজার হাজার টন নাইট্রিক অ্যাসিড, সিসা, মিথানল ও সোডিয়াম হাইড্রো-অক্সাইড, যা সামুদ্রিক জীবনের জন্য বিষাক্ত। ফলে স্বেচ্ছাসেবকরা হাজার হাজার মরা মাছের দেখা পায়। তারা প্রায় ৪০০টি মৃত বিপন্ন সামুদ্রিক কচ্ছপ, ৪০টিরও বেশি ডলফিন ও ছয়টি তিমি উদ্ধার করে। এসব প্রাণীর মুখ ছিল প্লাস্টিকে ভর্তি। জলপথটি তিন মাস বাণিজ্যিক মাছ ধরার জন্য বন্ধ থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১২ হাজার মৎস্যজীবী পরিবার। শ্রীলংকার সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল জাস্টিসের প্রতিষ্ঠাতা হেমন্ত উইথানেজ জানান, এ ঘটনায় মৎস্যজীবীদের ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৭ কোটি ২০ লাখ ডলার।

গত ফেব্রুয়ারিতে কার্গো জাহাজ প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার মধ্য ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে ২৪টি কনটেইনার আনলোড করে। কিন্তু সেখান থেকে কিছু সমুদ্রে পড়ে গেলে ধ্বংসাবশেষ স্থানীয় পরিবেশকে ঝুঁকিতে ফেলে। সেগুলো উদ্ধারে অনেক সংস্থা কাজে নামে। কিন্তু সবসময় এমনটা যে সম্ভব নয়, তা দেখিয়ে দেয় শ্রীলংকার ঘটনা। ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমসফিরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনওএএ) সামুদ্রিক আবর্জনা সংগ্রহ বিভাগের জেসন রলফ বলছিলেন, ‘কনটেইনারগুলোর বেশির ভাগই ডুবে যায়। অনেক সময়, তারা সত্যিই গভীর জলে থাকে।’ সব মিলিয়ে মহাসাগরগুলোয় প্রতি বছর গড়ে এক হাজারের বেশি কনটেইনার যোগ হওয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এখনো অজানা রয়ে গেছে।

সমুদ্রের তলদেশে কনটেইনার পতনজনিত পরিবর্তন অধ্যয়ন করছেন ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরি বে অ্যাকোয়ারিয়াম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। তাদের গবেষণা দলের রিমোট কনট্রোল যান ২০০৪ সালে পানির ১ হাজার ২৮০ মিটার নিচে একটি কনটেইনার আবিষ্কার করে। গবেষকরা জানান, এসব ক্ষেত্রে কনটেইনারটি প্রথমে নিচের সবকিছুকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলে। তারপর পানি ও পলির প্রবাহসহ চারপাশের বাস্তুসংস্থানকে সম্পূর্ণরূপে বদলে ফেলে, যা সমুদ্রতলের প্রজাতিগুলোকে প্রভাবিত করে। এ ক্ষতি বুঝতে বিজ্ঞানীরা এখনো কাজ করছেন।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮০ শতাংশের বেশি সমুদ্রপথে হয়ে থাকে, যার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। আজকের বৃহত্তম মালবাহী জাহাজ তিনটি ফুটবল মাঠের চেয়ে বড়। প্রায় ৫০ বছর আগে যখন শিপিং শিল্পের শুরু, তখন পণ্য পরিবহন ছিল এখনকার তুলনায় প্রায় দশমাংশ। তাই এখন আগের তুলনায় সামুদ্রিক পরিবেশের জন্য ঝুঁকিও বেড়েছে। বীমা দাবির ওপর ভিত্তি করে তৈরি ফেব্রুয়ারির এক জরিপে দেখা যায়, ৯ শতাংশ অতিবড় জাহাজের কনটেইনার কোনো না কোনোভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে। উল্টোদিকে ছোট জাহাজে ক্ষতির পরিমাণ ১ শতাংশ।

ভুল লেবেল অনেক দুর্ঘটনার ক্ষতিকে বাড়িয়ে তোলে বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ জাহাজ অপারেটরদের সব কনটেইনার ওজন ও পণ্য যাচাই করার ক্ষমতা নেই। এর পরিবর্তে শিপারদের দেয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। এক জরিপ অনুসারে, ভুল লেবেলিং ও যথাযথ মান অনুসরণ ছাড়ায় যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে প্রায় ৭০ শতাংশ শিপিং কনটেইনার।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে কনটেইনার হারানোর ঘটনা কমছে। বিশ্ব শিপিং কাউন্সিল জানিয়েছে, ২০২৩ সালের মধ্যে ১৬ বছরে গড়ে ১ হাজার ৪৮০টি কনটেইনার হারিয়েছে। তবে ২০২২ ও ২০২৩ সালে এ সংখ্যা যথাক্রমে ৬৫০ ও ২০০।

আরও