চা রফতানির হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার চ্যালেঞ্জ

পাকিস্তান আমল থেকে পাটের পর পরই রফতানি পণ্যের তালিকায় প্রথম সারিতে ছিল চা। নির্দিষ্ট করে বললে, চা ছিল কৃষিজ দ্বিতীয় রফতানি পণ্য। পাট, চামড়া ও চা এ ত্রয়ী অর্থকরী রফতানি পণ্য কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে ভূমিকা রেখেছিল। নব্বইয়ের দশকেও উৎপাদিত চায়ের অর্ধেকেরও বেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করত বাংলাদেশ।

পাকিস্তান আমল থেকে পাটের পর পরই রফতানি পণ্যের তালিকায় প্রথম সারিতে ছিল চা। নির্দিষ্ট করে বললে, চা ছিল কৃষিজ দ্বিতীয় রফতানি পণ্য। পাট, চামড়া ও চা এ ত্রয়ী অর্থকরী রফতানি পণ্য কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে ভূমিকা রেখেছিল। নব্বইয়ের দশকেও উৎপাদিত চায়ের অর্ধেকেরও বেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করত বাংলাদেশ। 

নব্বইয়ের দশকে রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের বিকাশ শুরু হলে ফিকে হতে থাকে দেশজ উৎপাদনের রফতানিমুখী কৃষিপণ্যগুলো। এ ধারায় আধিপত্য হারাতে থাকে বাংলাদেশীচা। এখনো বিশ্বে চা উৎপাদনে প্রথম পাঁচটি দেশের অন্যতম হলেও রফতানিতে বাংলাদেশের অবস্থান একদম তলানিতে। এমনকি দেশীয় শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণমূলক পন্থা গ্রহণের আগে চা আমদানিকারক দেশের অন্যতম হিসেবে হাজির হয়েছিল বাংলাদেশ। সম্প্রতি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) আরোপের কারণে আমদানি কমেছে বটে, কিন্তু চা রফতানির হারানো গৌরব ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় একটি সুযোগ আর ফেরত আসেনি। 

কেন বাংলাদেশ চা রফতানিতে পিছিয়ে পড়ছে? এ প্রশ্নে একাধিক উত্তর কিংবা আত্মসমালোচনা রয়েছে দেশীয় উৎপাদক ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার। ব্রিটিশরা এ দেশে চা উৎপাদন শুরুর পর এখানকার মানুষদের চা পানে অভ্যস্ত করতে নানান কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। চা ছিল বিলাসী পণ্য, তৎকালীন সমাজের অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে চা মুখ্য পানীয় ছিল না। তবে সময় পাল্টেছে, বাংলাদেশের মানুষ চায়ে অভ্যস্ত হওয়ার পর ক্রমেই দ্রুততার সঙ্গে চায়ের ভোগ বাড়ছে। বলা হয়ে থাকে, এ দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে চায়ের ভোগও বেড়েছে। একসময় পুঁজিবাদী সমাজে আর্থসামাজিক উন্নয়ন কিংবা অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্যারামিটার হিসেবে ইস্পাতের ব্যবহার গণনার পাশাপাশি বর্তমানে চায়ের ভোগ্যতাও যোগ্য মাপকাঠি হয়ে উঠেছে। যার কারণে মানুষের হাতে অর্থের প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় চা-পান নিত্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে হাজির হয়েছে প্রতিদিনের সকালে, অবসরের বিকাল কিংবা একান্ত আলাপ-উপলক্ষে। 

বাংলাদেশের চায়ের ভোগ্য ধরা হয় নয় কোটি কেজিরও বেশি। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে চা উৎপাদন সাড়ে নয় কোটি কেজি। চায়ের ভোগ প্রতি বছর ৪ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ হারে বাড়লেও উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি এর থেকে কিছুটা পিছিয়ে। ফলে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় ভোগের প্রবৃদ্ধি বেড়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতেই বেগ পেতে হয় বাংলাদেশকে। ফলে এ দেশের বিপণনকারীরা রফতানির পরিবর্তে আমদানিনির্ভরতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে উচ্চ শুল্কের আমদানিতেও পিছিয়ে নেই এখানকার প্রধান প্রধান ব্র্যান্ডের বিপণনকারী কোম্পানি। ফলে একসময় মানসম্মত চা বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের নামকে যেভাবে উজ্জ্বল করেছিল সেটি ম্নান হয়ে গেছে সময়ের সঙ্গে আশানুরূপ উৎপাদন বাড়াতে না পারায়। আবার সময়ের সঙ্গে চায়ের গুণগত মান বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় ব্যর্থতার গল্প লিখে বিদেশী চায়ের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছেন এখানকার উৎপাদকরা। 

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে পানীয় হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় চা। হালে কোমলপানীয়, কফিসহ বিভিন্ন পানীয় জনপ্রিয় হলেও চায়ের স্থান এখনো কেউ দখল করতে পারেনি। বরং একসময়ের ব্ল্যাক টির পাশাপাশি বিভিন্ন ফ্লেবার, বৈশিষ্ট্য ও স্বাদের চা পান জনপ্রিয় হচ্ছে। চীন যেখানে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর চা চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বব্যাপী চা রফতানিতে এগিয়ে রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ নিজস্ব চা উৎপাদনের মাধ্যমে চাহিদা পূরণ ছাড়াও আমদানি করে যাচ্ছে। আবার সীমান্তবর্তী ভারতের বিভিন্ন জেলা থেকে চোরাই চায়ের মাধ্যমে দেশীয় চায়ের বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে চা। 

বাংলাদেশের চা রফতানির চিত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, কয়েক দশক আগেও কয়েক মিলিয়ন কেজি চা বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হতো। বর্তমানে বাংলাদেশ সীমিত পরিসরে হলেও চা রফতানি করছে, তবে সেটি পাকিস্তান-আফগানিস্তানসহ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোয়। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী দুর্গম অঞ্চলগুলোর বাসিন্দারা কম দামের চা পান করে, যা বাংলাদেশ থেকে সরবরাহ হয়। মূলত ওখানকার দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ চায়ের সঙ্গে রুটি ভিজিয়ে আহার সম্পন্ন করার প্রয়োজনেই কম দামে বাংলাদেশী চায়ের চাহিদা রয়েছে। 

তবে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের চা রফতানি ২ কোটি কেজিতে উন্নীত করতে কাজ করছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের চা নীতিতে বলা আছে, ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের চা উৎপাদন ১৪ কোটি কেজিতে উন্নীত হবে। ওই সময়ে আমাদের চাহিদা থাকবে ১২ কোটি কেজি, ফলে উদ্বৃত্ত ২ কোটি কেজি চা রফতানিযোগ্য থাকবে বাংলাদেশের। এজন্য ২০২২ সাল থেকে চা রফতানিতে নগদ অর্থ প্রণোদনা দেয়া শুরু করেছে সরকার। চা রফতানিতে বর্তমানে ৪ শতাংশ ক্যাশ ইনটেনসিভ দেয় সরকার। যার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে চা রফতানি বাড়লেও দেশীয় চাহিদা ও উৎপাদনের বিবেচনায় রফতানি আশানুরূপ বাড়েনি। 

বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম, এনডিসি, পিএসসির মতে, চা রফতানিতে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। হারানো গৌরব ফিরে পেতে উদ্যোগ নেয়া হলেও এজন্য প্রণোদনা সুবিধাও দেয়া হচ্ছে। এর জন্য চা চাষের আওতাধীন জমিগুলোকে বার্ষিক আড়াই শতাংশ হারে চায়ের আবাদ বাড়ানোর প্রতি বেশি মনোযোগী চা বোর্ড। শুরুতে সচেতনতা বাড়ানো হলেও বর্তমানে চা চাষ বাড়াতে বাগানগুলোকে আর্থিক জরিমানা করা হচ্ছে। বাগান মালিকদের সুরক্ষা দিতে অবৈধ চা বিপণন, চোরাই চা বন্ধ করাসহ চা খাতকে লাভজনক করতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এসব কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের চা খাত দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রফতানিতেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের নতুন খাত হিসেবে হাজির হবে বলে মনে করছেন তিনি। 

বাংলাদেশের চা চাষ ও উৎপাদনের আওতা আরো কয়েক গুণ বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ১৬৮টি চা বাগান ও উত্তরবঙ্গের সমতল ভূমিতে চা চাষের ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় এ চিত্রই পাওয়া যায়। যদিও শ্রমিক সংকট, চা চাষ বৃদ্ধিতে বাগান মালিকদের অনীহা, উৎপাদন খরচের সঙ্গে বাজারমূল্যের পার্থক্য, হেক্টরপ্রতি চা উৎপাদনে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশে চা উৎপাদনের সম্ভাবনাকে ধীরগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালের হিসাবে ১৬৮টি চা বাগানের মোট ভূমির পরিমাণ ২ লাখ ৯০ হাজার ৫৮৪ একর। এর মধ্যে চা চাষযোগ্য ভূমি ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯০১ একর, নার্সারিসহ চাষাধীন ভূমি ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯৫৩ একর এবং নার্সারি বাদে চা চাষাধীন ভূমি রয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৩৩৯ একর। ভবিষ্যতে আরো ১৭ হাজার ৭৯ একর জমি চা চাষের আওতায় নিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে ২০২২ সালে একরপ্রতি ৬৬৪ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। ফলে আবাদযোগ্য ভূমি চা চাষের আওতায় নিয়ে এলে ১ কোটি ২০ লাখ কেজি চা উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের সমতলের চা চাষ বৃদ্ধি, পার্বত্য এলাকায় চা চাষ বাড়ানোর মাধ্যমেও উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। 

দেশে চায়ের বাজার প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার। উৎপাদনের পর চা বোর্ডের মাধ্যমে নির্দিষ্ট গুদামে রেখে নিলামের মাধ্যমে এসব চা বিক্রি করা হয়। বিক্রি পরবর্তী সময়ে চায়ের সঙ্গে ১৫ শতাংশ শুল্কসহ ২ শতাংশ বিভিন্ন কমিশন জমা দিয়ে গুদাম থেকে নিলামে ক্রয় করা চা সংগ্রহ করেন ব্যবসায়ীরা। তবে একটি নির্ধারিত চা-ই বিক্রয়যোগ্য চা নয়। বিভিন্ন গ্রেডের চায়ের মিশ্রণ বা ব্লেন্ডিং করে পানের জন্য নির্দিষ্ট স্বাদের চা প্রস্তুত (দানাদার বা গুঁড়ো) করা হয়। তবে নিলাম পদ্ধতির কারণে চাইলে বাড়তি দাম সংগ্রহ করতে না পারা, একটি মাত্র নিলাম বাজারের (বর্তমানে দুটি) চা বিক্রিতে জটিলতায় ন্যায্যমূল্যবঞ্চিত হয়েছেন বাগান মালিকরা। বর্তমানে দুটি নিলাম বাজারের পাশাপাশি পঞ্চগড়ে দেশের প্রথম অনলাইন চা নিলাম বাজার স্থাপিত হচ্ছে। এতে চায়ের বিক্রয় বাজারে প্রতিযোগিতা ও বৈচিত্র্য খাতসংশ্লিষ্টদের আরো বেশি বিনিয়োগবান্ধব করবে, যা বাংলাদেশের চা রফতানি বাড়াতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে চা বোর্ড। 

বাংলাদেশের চা রফতানি অতীত পরিসংখ্যান ছিল বর্ণিল। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ চা রফতানি করেছিল ২ কোটি ৫০ লাখ ৬৮ হাজার কেজি। ২০০২ সালে চা রফতানি হয়েছিল ১ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার কেজি। তবে ২০১৫ সালে এসে চা রফতানি কমে ৫ লাখ ৪০ হাজার কেজিতে নেমে আসে। ২০১৬ সালে রফতানি হয়েছে ৬ লাখ ২০ হাজার কেজি, ২০১৭ সালে ২৫ লাখ ৬০ হাজার কেজি, ২০১৮ সালে ৬ লাখ ৫০ হাজার কেজি, ২০১৯ সালে ৬ লাখ কেজি, ২০২০ সালে ২১ লাখ ৭০ হাজার কেজি, ২০২১ সালে ৬ লাখ ৮০ হাজার কেজি, ২০২২ সালে ৭ লাখ ৮০ হাজার কেজি এবং ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত চা রফতানি হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার কেজি। বছর শেষে চা রফতানি ১ মিলিয়ন কেজি ছাড়িয়ে গেলেও দুই দশক আগের অবস্থানে ফিরে যেতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে চা বোর্ড, চা উৎপাদক কিংবা ব্যবসায়ীদের।

বাংলাদেশ চা সংসদের সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলমের দৃষ্টিতে চা খাতের রফতানি গৌরব নির্ভর করছে বাগান মালিকদের উৎপাদন ও লাভজনকভাবে চা বাগান পরিচালনার ওপর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের চা উৎপাদন খরচ এখনো বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে বাগানগুলোতে শ্রমিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে উৎপাদন বাড়াতে না পারায় চা উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু গতানুগতিক বাজারে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় লোকসানের কারণে বাড়তি বিনিয়োগও সম্ভব হয় না। এতে গুণগত মানে ভালো চা ও বাড়তি চা উৎপাদন কঠিন হয়ে পড়ে। দেশীয় চাহিদা মেটাতে না পারলে চা উৎপাদন রফতানি বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারবে না বলে মনে করছেন তিনি। 

বাংলাদেশের চা রফতানি বাজারের বড় সমস্যা হচ্ছে ভালো মানের চা বাংলাদেশী ক্রেতারাই অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য কিনে নেয়। আবার চাহিদা অনুযায়ী ভালো মানের চায়ের সংকট থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানই উচ্চ শুল্ক দিয়ে এখনো বিশ্ববাজার থেকে চা আমদানি করে। ফলে সীমিত পরিসরে বাংলাদেশের যেসব চা বিশ্ববাজারে রফতানি হয় সেগুলো দেশের নিলাম বাজার বা খুচরা বাজারে অবিক্রীত চা। এতে রফতানি হলেও এসব চা রফতানিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হার অনেক কম। যেমন ২০০২ সালে দেশে ৫৩ দশমিক ৬২ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের বিপরীতে রফতানি হয়েছিল ১৩ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন কেজি বা ১ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা। এ পরিমাণ চা রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছিল ৯৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। যদিও সর্বশেষ ২০২২ সালে মাত্র ৭ লাখ ৮০ হাজার কেজি চা রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ২০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। অতীতের মতো চায়ের রফতানি ফিরিয়ে আনা কিংবা বাড়ানো গেলে চা রফতানি খাতেই হাজার কোটি টাকারও বেশি আয় করা সম্ভব বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। 

বাংলাদেশের চা উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, বিপণন শেষে উদ্বৃত্ত রফতানির বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন বিপণনকারী কোম্পানি ও ব্যবসায়ীরা। তাদের দৃষ্টিতে এখানকার উৎপাদকরা বিনিয়োগে প্রতিযোগিতামূলক কিংবা দক্ষ নয়। একসময় ইউরোপীয় বিভিন্ন চা কোম্পানির মালিকানা ছিল এখানকার চা বাগানে। পরবর্তী সময়ে স্থানীয়দের হাতে বাগানের মালিকানা চলে এলেও প্রতিযোগিতামূলক ও লাভজনক পন্থায় চা বাগান পরিচালনার মানসিকতা নেই অনেকের। কেউ কেউ বাংলাদেশে ঈর্ষণীয় চা উৎপাদন ও ভালো মানের চা উৎপাদনে এগিয়ে থাকলেও অধিকাংশ বাগানই রুগ্‌ণ, গতানুগতিক ও লোকসানি। বাগানগুলোর অধিকাংশই চা উৎপাদনের পরিবর্তে ভিন্নভাবে লাভের ধারা অব্যাহত রাখতে চায়। কেউ কেউ শ্রমিকের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল না থেকে যান্ত্রিক সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিযোগী একাধিক শীর্ষ দেশের তুলনায় একরপ্রতি বেশি চা উৎপাদন করছে। বাংলাদেশের বার্ষিক গড় উৎপাদন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম হওয়ায় বাগানগুলো লাভের পরিবর্তে ক্রমেই লোকসানের কারণে বাড়তি বা উদ্বৃত্ত চা উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ছে। ফলে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে চা রফতানির যে সম্ভাবনা বা সুযোগ রয়েছে সেটি অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হিসেবে হাজির হয়েছে বাংলাদেশের জন্য।

বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর মতামত হচ্ছে, দেশেই ভালো মানের চায়ের কদর রয়েছে। ফলে রফতানির পর যদি ফের আমদানি করতে হয় তবে দেশের নিট লাভ হবে না। বাংলাদেশের সাধারণ ভোক্তারাও ভালো মানের চা পান করতে চায়। এজন্য রফতানি বাড়াতে পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি গুণগত মানও বাড়াতে হবে। বিশ্বব্যাপী ভালো মানের চাহিদা বেশি থাকায়, প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে দেশীয় চা উৎপাদন অবকাঠামোর আধুনিকায়ন জরুরি। এর সঙ্গে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার তদারকি বাড়ানো, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করে প্রকৃতিনির্ভর চা শিল্পকে রফতানিমুখী শিল্পে পরিণত করতে সরকার, বাগান মালিক ও বিপণনকারী সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে যৌথ সমন্বয়ে। 


লেখক: সাংবাদিক

আরও