সাক্ষাৎকার

বিগত ৫০ বছরে আর্থিক খাত আস্থা তৈরির পরিবর্তে হারিয়েছে

তানজীম আলমগীর ২০২০ সালে ইউসিবি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের (ইউসিবিআইএল) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগদান করেন।

তানজীম আলমগীর ২০২০ সালে ইউসিবি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের (ইউসিবিআইএল) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগদান করেন। আর্থিক খাতে ১৫ বছরের বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই পেশাজীবী বিনিয়োগ, পরিচালনা ও কৌশলগত পরিকল্পনায় বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। সিইও হিসেবে যোগদানের চার বছরের মধ্যে ইউসিবিআইএলকে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার এনে দিয়েছেন। তার কর্মজীবনের শুরুর গল্প, বন্ড মার্কেট ও পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মহিউদ্দিন মাহি

কর্মজীবন শুরুর ১৫ বছরের মধ্যেই বেশ সাফল্য পেয়েছেন আপনি। আপনার এ যাত্রা সম্পর্কে বলুন।

যাত্রাটা পরিকল্পনামাফিক ছিল এটা বলার সুযোগ কম। পরিস্থিতি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। পুঁজিবাজারে প্রায় ১১ বছর ধরে কাজ করছি। মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে গিয়ে এটার প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয়। মানুষ যা করতে পছন্দ করে, সেটা যদি চাকরি হয়ে যায়, তাহলে সফলতার হার অনেক বেশি হয়। মানুষের সঙ্গে কথা বলা আমার অনেক আগে থেকেই পছন্দের, শেষ পর্যন্ত সেটাই আমার পেশায় রূপান্তরিত হয়েছে।

ইউসিবিআইএলে আপনি প্রায় চার বছর ধরে কাজ করছেন। আপনার যোগদানের পর প্রতিষ্ঠানটির অর্জন কী?

কভিডের সময় যখন শুরু করলাম, তখন বেশকিছু ব্যাংকে পুঁজির ঘাটতি ছিল। প্রতিটা সমস্যার সঙ্গে একটা করে সুযোগ থাকে। দেখা গেল কেউ বন্ডে ভালো, কেউ সিন্ডিকেশনে ভালো, কেউ আবার আইপিওতে। আমরা সবগুলো সেবা এক ছাতার নিচে দিতে চেয়েছিলাম। এরপর একটা দল তৈরি করতে চেয়েছি, যেখানে আমরা সমস্যা চিহ্নিত করব ও একই সঙ্গে সমাধান দেব। এ চিন্তা থেকেই কাজ করা। সবশেষ চার বছরে আমরা নেতৃত্বস্থানীয় বিনিয়োগকারী ব্যাংক হয়েছি। প্রথম বছরেই আমরা বিএসইসি (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন) থেকে স্বীকৃতিস্বরূপ প্রথম পুরস্কার লাভ করি।

গত দুই বছরে আন্তর্জাতিকভাবে ইউরো মানি ও ফাইন্যান্স এশিয়ায় বেস্ট ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক হয়েছি। ২০২৪ সালে অনেকগুলো স্বীকৃতি এসেছে। চলতি বছর আমরা ইউরো মানি সিকিউরিটিজ হাউজ পুরস্কার পেয়েছি। এছাড়া ফাইন্যান্স এশিয়ায় এশিয়া-প্যাসিফিকের মধ্যে বেস্ট ইসলামিক ব্যাংকিং হাউজ হয়েছি। এছাড়া গত চার বছরে আমরা অর্ধশতাধিক চুক্তি সম্পাদন করেছি। গড়ে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করেছি। এগুলো বাজারের জন্য খুবই রোমাঞ্চকর সংখ্যা।

কভিডের সময় পুঁজিবাজারে অন্যরা যেখানে পিছিয়ে পড়েছে, সেখানে ইউসিবিআইএল এগিয়ে গেল কীভাবে?

সফলতার জন্য আমরা দুটি ‘এস’ নির্ধারণ করেছি। স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) ও সার্ভিস (সেবা)। ২০২০-এ কভিডের সময় আমরা যখন শুরু করি, তখন আমাদের ধারণাকে পাল্টে দিয়ে বাজারটা বেশ ভালো ছিল। এ সময়ের কথা ভাবলেও সরকারি ট্রেজারি কিংবা বন্ডে আমাদের বিনিয়োগ অনেক বেশি। সে তুলনায় বাজারে আমাদের মোট বিনিয়োগ পুরো পোর্টফোলিওর ১৫-১৬ শতাংশ। বাকি পোর্টফোলিওটা স্থায়ী আয়ে বিনিয়োগ করা। এই যে পুরো টাকাটা একটা একক ঝুঁড়িতে না রাখার যে দূরদর্শিতা, আমার মনে হয় সেটাই আমাদের সফলতার বড় একটা কারণ। বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো মার্চেন্ট ব্যাংক মার্জিন লোন দেয়। আমরা ভাবলাম, বাকিরা এটা করুক, আমরা অ্যাডভাইজরি করি। এর কারণ আমরা একটা টেকসই মুনাফা চেয়েছি। সেজন্যই হয়তো সফল হতে পেরেছি।

ইউসিবিআইএল এ পর্যন্ত বাজারে কয়টি আইপিও নিয়ে এসেছে?

চার বছরে আমরা দুটি আইপিও করেছি। একটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, আরেকটা ব্যাংকের আইপিও। গত চার বছরে বাজারে তিনটা রাইট (স্বত্ত্ব) অনুমোদিত হয়েছে, তিনটাই আমাদের করা। বাজারের ৫০ শতাংশ বন্ড ইউসিবিআইএলের করা। এর বাইরে আমরা সিন্ডিকেশন করেছি। ৩৬টির বেশি বন্ড করেছি গত চার বছরে। শুধু আইপিও নিয়ে কাজ করছি না, আমরা ৩৬০ ডিগ্রি সেবা দিতে চাই। সামনে আরো অনেক সুযোগ আসছে। নতুন বাংলাদেশে আমরা ভালো ভালো আইপিও নিয়ে এসে বাজারকে সহযোগিতা দিতে চাই।

পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ কেমন হবে বলে মনে করেন?

নতুন বাংলাদেশে সবগুলো জায়গাতেই আমরা একটু ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। পরিস্থিতি দুই ধরনের হতে পারে; ক্রয় অথবা বিক্রয়। এ সময়টাকে আমি ক্রয়ের পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনা করছি। বাজারে অবমূল্যায়িত অনেক শেয়ার আছে। এ মুহূর্তে সেখানে বিনিয়োগ করতে হবে। সেখান থেকে মুনাফা আসার জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হবে। আশা করি, একটা সময় পর ভালো রিটার্ন তৈরি করা যাবে।

বাংলাদেশের বন্ড মার্কেটের বর্তমান অবস্থাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

আমরা যদি একটা ভালো বাজার চাই, সেখানে অবশ্যই ভালো মানুষ থাকতে হবে। সেজন্য স্বচ্ছতা ও ভালো উদ্দেশ্য থাকা দরকার। আমি তো নিরীক্ষণ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেব। এখন সেই প্রতিবেদন যদি ভালো না হয়, তাহলে তো সেখান থেকে ভালো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। এজন্য স্বচ্ছতাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেখতে হবে বাজারে কোনো কারসাজি করা হচ্ছে কিনা। জানি, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এ বিষয়ে যথেষ্ট কাজ করছে। সেখানে আমাদের অবদান রাখার সুযোগ আছে।

স্বচ্ছতার এ জায়গাটা কীভাবে দৃঢ় করা যায়?

শুরু করতে হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে। আমরা কথা বলার সময় তালিকা ধরে শুধু অন্যের কী করা উচিত, সে বিষয়ে জ্ঞান দেই। এটা না করে আমাদের নিজেদের কী করা উচিত, সেটা ভাবা জরুরি। অবশ্যই বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রকদের কাছ থেকে আসবে। তবে আমাদের নিজেদেরই আত্মসমালোচনা করতে হবে। যেসব নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষণে কারসাজি করেছে, তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে। শুধু কিছু আর্থিক জরিমানা না করে ৫-১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা উচিত। শাস্তিটা যদি কঠোর না হয়, তাহলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অনেক কঠিন।

বন্ড মার্কেটের জন্য কাঠামোগত পরিকল্পনাকে কীভাবে দেখেন আপনি?

আমরা গত চার বছরে যত বন্ড করেছি, অধিকাংশই ছিল ব্যাংকের। আমরা বিনিয়োগকারীদের বিষয়েও ভাবি। হ্যাঁ, পূর্বানুমান হয়তো সবসময় সঠিক না-ও হতে পারে, কিন্তু সেটা সৎ হতে হবে। সরকার বন্ড নিয়ে অনেক কাজ করছে। তবে সচেতনতা কম বলে মনে হয় আমার। পাঁচ বছরের একটা বন্ড তিন বছরের বাজার থেকে কিনতে চাইলে কী দামে নেয়া উচিত, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কিন্তু এ হিসাবটা না-ও বুঝতে পারে। এ জায়গায় সরকার ও আমাদের অনেক কাজ করার সুযোগ আছে। পুরো জিনিসটাকে একটা সামগ্রিক দিক হিসেবে চিন্তা করতে হবে।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের হয়তো ধারণাগত সমস্যা আছে। বন্ডের বিনিয়োগকারী যতই ব্যাংকের বাইরে চিন্তা করি না কেন, বিনিয়োগের জন্য সবাই কিন্তু ব্যাংকের দিকেই তাকিয়ে থাকবে। মানুষের শেষ ভরসার জায়গা ছিল ব্যাংক। ব্যাংক যদি মানুষের আমানত দিতে সমস্যায় পড়ে, তাহলে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ওপর বিশ্বাস তৈরির সে সক্ষমতা আছে বলে মনে হয় না। সাধারণ মানুষ যখন একটা করপোরেট বন্ডকে মূল্যায়ন করবে কিংবা সেখানে বিনিয়োগ করবে, সে ধরনের ক্রেডিট বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা কি তার আছে? এ জায়গাটি নিয়ে আরো কাজ করা উচিত।

বন্ডের বাজার উন্নতিতে কী করা যায়?

প্রাথমিকভাবে বাজারকে ভালো করতে হলে অ্যাসেট বন্ড বা ব্যাংক বন্ডের বাইরে গিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। দ্বিতীয়ত করপোরেটদের গ্যারান্টি মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে দিয়ে বাজারে বন্ড আনতে হবে। এক্ষেত্রে রিটেইলারদের বোঝানোর বিষয়ও আছে। যাতে তারা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তারা শেয়ারবাজারসহ সব জায়গাতেই টাকা রেখে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারপর একটা পর্যায়ে গিয়ে রিটেইলাররা সরাসরি বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারবে।

এক্ষেত্রে গভর্ন্যান্সের দিক থেকে কী করার আছে বলে মনে করেন?

বিএসইসি যখন একটা বন্ডের অনুমোদন দেয়, তখন তার নগদ প্রবাহকে কীভাবে আরো সুরক্ষিত করা যায় সেটা দেখতে হবে। বন্ডের রিপেমেন্ট যদি যথাসময়ে না হয়, তাহলে কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর থেকেও বিনিয়োগকারীর আস্থা চলে যাবে। বিনিয়োগকারীদের একটা প্রথাগত ধারণা আছে যে বিএসইসি যেহেতু অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে, তার মানে তারা দেখেশুনে বুঝেই দিয়েছে। কিন্তু ক্রেডিট ঝুঁকিটা তো বিএসইসি নিচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক বা বড় বিনিয়োগকারীদের ক্রেডিট বিশ্লেষণ করার সে সক্ষমতা থাকলেও রিটেইলারদের তা নেই। তাদের জন্য ভিন্নভাবে চিন্তা করতে হবে। গত ৫০ বছরে আমরা আস্থা তৈরির পরিবর্তে হারিয়েছি মাত্র। আস্থা তৈরি করতে না পারলে কোনো বাজারই টিকতে পারবে না। সেটা যা-ই হোক না কেন।

বন্ড বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে কীভাবে ভূমিকা রাখছে?

ব্যাংকের বন্ডগুলো প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। ব্যাংকের নিজেদের প্রবৃদ্ধির জন্যই পুঁজি প্রয়োজন। ব্যাংক তো বিভিন্ন ব্যবসাকেই সহায়তা দিচ্ছে। এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বন্ডে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের কথা বললে আমাদের গোড়াটাকেই ঠিক করতে হবে। যেমন পাঁচ বছরের জন্য একটা বন্ড করলাম, কিন্তু সরকারি প্রকল্পটা পাঁচ বছরের জায়গায় ছয় বা সাত বছরে গিয়ে খরচটা বেড়ে যাচ্ছে। তখন ৫০০ কোটি টাকার বন্ডের খরচ ১ হাজার কোটি টাকা হয়ে গেলে বাড়তি টাকাটা কোথা থেকে আসবে? সে জন্য সময়োচিত প্রকল্পের বন্ডের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

ইউসিবিআইএলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

আমরা এরই মধ্যে কিছু বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছি। সে জায়গাটা ধরে রেখে দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা বিনিয়োগকারী হতে পারি কিনা কিংবা এশিয়া-প্যাসিফিকে আরো কী কী অবদান রাখা যায়, আরো কী কী আন্তর্জাতিক ডিল করা যায়, সেগুলো ভাবছি। অবশ্যই আমাদের ইচ্ছা আছে বৈশ্বিক মঞ্চে নিজেদের নিয়ে যাওয়ার।

সরকারের প্রতি কোনো বার্তা আছে কি-না?

অনেক কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। সব পরিবর্তন রাতারাতি হয়ে যাবে না। তবে এ পরিবর্তনটা ভালোর দিকে যাচ্ছে কিনা, সেটা ভাবতে হবে। শুধু পুঁজিবাজারের কথাই যদি বলি, এখানে সরকার ভালোভাবে ভূমিকা রাখছে। হ্যাঁ, ফলাফল হয়তো রাতারাতি পাব না। কিন্তু এভাবে যেন ভবিষ্যতেও ভূমিকা রেখে যায়।

আরও