যুক্তরাষ্ট্রে তিন দেশের পণ্যে আমদানির ওপর কঠোর শুল্ক আরোপের হুমকির মাধ্যমে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ আরো তীব্র করার মঞ্চ প্রস্তুত করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনটাই ধারণা করছেন বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ। তারা আরো জানান, এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন ভোক্তা ও কোম্পানিগুলোকে উচ্চ ব্যয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। খবর দ্য গার্ডিয়ান ও রয়টার্স।
গত সোমবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন, কানাডা, মেক্সিকো ও চীন থেকে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করবেন। দেশগুলো অভিবাসন ও মাদকপ্রবাহ কমানোর ব্যবস্থা না নেয়া পর্যন্ত এ পদক্ষেপ চলবে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনই এ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হুমকি শুধু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কই নয়, বৈশ্বিক বাণিজ্যকে প্রভাবিত করবে বলে অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা সতর্ক করেছেন। অবশ্য নির্বাচনী প্রচারণায় রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পের সর্বজনীন শুল্কের প্রতিশ্রুতির কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন পক্ষ পরবর্তী কৌশল নিয়ে প্রস্তুতির কথা জানিয়েছিল।
ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্যের জেরে ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউটিও) সাবেক পরিচালক কিথ রকওয়েল সতর্ক করেছেন যে এ সিদ্ধান্ত বাণিজ্য যুদ্ধ উসকে দিতে পারে। তিনি বলেন, ‘এ দেশগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর শত শত বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে। কেউ যদি মনে করেন যে তারা এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না, তাহলে তিনি পরিস্থিতি বোঝেননি।’
তিনি সতর্ক করেন যে শুল্ক বাড়ালে দেশগুলো রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল খাতগুলোয় প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেবে। আগেও আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি শুল্ক ২০ শতাংশ করে, তাহলে একটি ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং নিশ্চিতভাবেই তারা প্রতিশোধ নেবে।’
এ বিষয়ে কর্নেল ইউনিভার্সিটির বাণিজ্যনীতি বিশ্লেষক এসওয়ার প্রসাদ বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সুরক্ষাবাদের নতুন যুগের সূচনা করছে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে বিঘ্নিত করবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্ককে একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন যা মার্কিন অর্থনীতি, সমাজ ও জাতীয় নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলা বহিরাগত বিষয়গুলো মোকাবেলায় ব্যবহার করা যেতে পারে।’
অবশ্য আরোপ করা শুল্ক সাধারণ আমদানিকারক সংস্থাগুলো দিয়ে থাকে। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায়ই ভুলভাবে বলে থাকেন যে রফতানিকারক দেশগুলোর ওপর শুল্ক আরোপ করা হবে।
মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের তথ্যানুসারে, দেশ তিনটি চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রে মোট ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য পাঠিয়েছে। এর মধ্যে নেতৃত্বে রয়েছে মেক্সিকো এবং এরপর অবস্থান চীন ও কানাডার।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুমকির পর পরই সমালোচনা করেছেন মেক্সিকো, কানাডা ও চীনের কর্মকর্তা ও প্রধান শিল্পগোষ্ঠীগুলো। তাদের মতে, এ ধরনের পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রসহ সংশ্লিষ্ট সবার অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, মূল্যস্ফীতি বাড়াবে এবং চাকরির বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এমনকি ট্রাম্পের মন্তব্যের পরদিন দেশ তিনটিতে মুদ্রা, বন্ড ও শেয়ারবাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়।
সমালোচনার পাশাপাশি সংলাপ ও সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছে দেশ তিনটি। চীন সতর্ক করে বলেছে, অর্থনৈতিক উত্তেজনার বৃদ্ধি উভয় পক্ষের জন্য ক্ষতিকর হবে। এক্স বার্তায় ওয়াশিংটনে দেশটির মুখপাত্র লিউ পেংইউ লেখেন, ‘কেউই বাণিজ্য যুদ্ধে জিতবে না।’
কানাডার উপপ্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড ও জননিরাপত্তামন্ত্রী ডমিনিক লেব্লাঁ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার দেশের ‘ভারসাম্যপূর্ণ ও পারস্পরিকভাবে উপকারী’ অর্থনৈতিক সম্পর্ক তুলে ধরেন। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউডিয়া শেইনবাউম বলেছেন, ‘একটি শুল্কের প্রতিক্রিয়ায় অন্য শুল্ক আরোপিত হবে এবং এটি আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ককে হুমকির মুখে ফেলবে।’
এবারের নির্বাচনী প্রচারে শুল্কের ওপর বেশ জোর দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। একে অভিধানের ‘সবচেয়ে সুন্দর শব্দ’ হিসেবেও অভিহিত করেন তিনি। কিন্তু শুল্ক ভোটারদের মধ্যে ততটা জনপ্রিয় নয়। বাজার গবেষণা সংস্থা হ্যারিস পোলের জরিপ অনুসারে, ৬৯ শতাংশ মার্কিন নাগরিক মনে করেন যে এটি তাদের পণ্যের দামের ওপর প্রভাব ফেলবে।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে জানান, শুল্কের পরিসর বৃদ্ধি ভোক্তাদের জন্য পণ্যের দাম বাড়াবে। অন্যান্য দেশ প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের রফতানিনির্ভর খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কবিষয়ক ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান আইএনজির অর্থনীতিবিদরা একটি গবেষণা প্রকাশ করেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত নীতিমালা, বিশেষ করে ১০-২০ শতাংশ সর্বজনীন শুল্ক ও চীনা পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি ভোক্তার জন্য বার্ষিক ২ হাজার ৪০০ ডলার অতিরিক্ত খরচের কারণ হতে পারে।
আইএনজির অর্থনীতিবিদ জেমস নাইটলি বলেন, ‘এ সম্ভাব্য ব্যয়বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে, বিশেষ করে যেখানে ভোক্তা ব্যয় অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ৭০ শতাংশ।’
ডয়েচে ব্যাংকের বিশ্লেষকদের মতে, মেক্সিকো ও কানাডার ওপর প্রস্তাবিত শুল্ক সাময়িকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। ২০২৫ সালের জন্য মূল মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস ২ দশমিক ৬ থেকে সংশোধন করে তারা ৩ দশমিক ৭ শতাংশ করেছেন।
নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলেন বিলিয়নেয়ার হেজ ফান্ড ম্যানেজার বিল অ্যাকম্যান। তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ট্রাম্প শুল্ককে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চলেছেন, যা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ফলাফল অর্জনে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে ব্যবহার হবে।’
তার মতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ধরনের ঘোষণার মাধ্যমে ডোনাল্ড"ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার আগেই পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনকে প্রভাবিত করছেন।