রাজশাহীর আম ও পেয়ারার গন্তব্য ইউরোপ

রাজশাহীর আমের সুনাম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। এখানকার মিঠাপানও পিছিয়ে নেই। পেয়ারা, কুল ও ড্রাগন দিচ্ছে নতুন দিনের হাতছানি। তাজা শাক-সবজিও ফলছে বরেন্দ্রখ্যাত রাজশাহীজুড়ে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে এখানকার কৃষিপণ্য। সম্প্রতি রফতানিও হচ্ছে।

রাজশাহীর আমের সুনাম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। এখানকার মিঠাপানও পিছিয়ে নেই। পেয়ারা, কুল ও ড্রাগন দিচ্ছে নতুন দিনের হাতছানি। তাজা শাক-সবজিও ফলছে বরেন্দ্রখ্যাত রাজশাহীজুড়ে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে এখানকার কৃষিপণ্য। সম্প্রতি রফতানিও হচ্ছে।

চাষীরা বলছেন, তারা যে ফসল ফলাচ্ছেন, তার বেশির ভাগই উদ্বৃত্ত থাকছে। কিন্তু অবকাঠামো ও যোগাযোগ সংকটে তারা রফতানিতে বেশি দূর এগোতে পারছেন না। আর কৃষি দফতর বলছে, রফতানিকারক ও উৎপাদনকারীদের লিংকেজ ঘাটতিতেই এ সংকট। তবে সংকট কাটিয়ে কৃষিপণ্য রফতানি বাড়লে এ অঞ্চলের অর্থনীতির গতি পাল্টে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি মৌসুমে কেবল রাজশাহী জেলা থেকে রফতানি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৭ টন আম। এবার আমের গন্তব্য ছিল ইতালি, হংকং, জার্মানি, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স।

পেয়ারাও রফতানি হয়েছে এবার। ১ দশমিক ৪ টন পেয়ারা গেছে ইতালি ও সুইডেনে। এ দুই দেশে গেছে শূন্য দশমিক ৯৫ টন কুল। এছাড়া দশমিক ১৫ টন পেঁপে গেছে সুইডেনে। সব মিলিয়ে রফতানি হয়েছে ১২ দশমিক ৪৭ টন কৃষিপণ্য, যা থেকে আয় হয়েছে ৮ লাখ ৬২ হাজার ৫৯৫ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজশাহীজুড়ে এখন বাণিজ্যিক ফল বাগানের ছড়াছড়ি। এসব বাগানে নিরাপদ ও রফতানিযোগ্য আম, পেয়ারা, কুল, ড্রাগনসহ প্রচলিত ও অপ্রচলিত বিভিন্ন ফল উৎপন্ন হয়। ফলন এবং বাগানের ব্যাপ্তির সঙ্গে সেই অর্থে বাড়েনি বাজার। ফলে ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না চাষী-বাগান মালিকরা। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রফতানি বাড়ানোর বিকল্প নেই।

রাজশাহীর কৃষিপণ্য রফতানি বাড়ানোর জন্য ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, রাজশাহী বিমানবন্দর থেকে কার্গো সুবিধা চালুসহ বেশকিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন হবে। এরই মধ্যে ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক।

সে অনুযায়ী পরিকল্পনাও প্রণয়ন করেছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। এ পরিকল্পনা অনুমোদনের পর তা বাস্তবায়ন করা গেলে বছরে ৫০ কোটি টাকার বেশি আম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা যাবে বলে মনে করছে বিএমডিএ।

রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের পাশে বিমানবন্দরসংলগ্ন পবার তকিপুর মৌজায় ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে সংস্থাটি। প্রায় ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের সম্ভাব্য মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। যদিও পরিকল্পনা কমিশনে এখনো এর অনুমোদন মেলেনি।

বিএমডিএর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কেবল আম প্রক্রিয়াজাত করেই প্লান্ট থেকে মৌসুমে আয় সম্ভব কোটি টাকার বেশি। আম ছাড়াও রফতানির উদ্দেশ্যে অন্যান্য ফল ও শাক-সবজি প্রক্রিয়াজাত করা যাবে এখানে। রাজশাহী বিমানবন্দরে কার্গোসুবিধা চালু হলে এখান থেকে সহজেই রফতানি করা যাবে বিভিন্ন কৃষিপণ্য। এ বিপুল কর্মযজ্ঞ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অর্থনীতির গতি পাল্টে দেবে। সৃষ্টি হবে বিপুল কর্মসংস্থান।

এ উদ্যোগ সময়ের দাবি বলে মনে করেন রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক প্রধান ড. আলীম উদ্দিন। তিনি জানান, ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত আমের প্রচুর চাহিদা রয়েছে জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। রাজশাহীতে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট হলে এসব দেশে আম রফতানির সুযোগ মিলবে। কৃষক আমের ভালো দাম পাবেন।

গত কয়েক বছর বিভিন্ন দেশে ফল রফতানি করছেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা এলাকার চুক্তিভিত্তিক আমচাষী শফিকুল হক ছানা। তিনি বলেন, ‘রফতানির উদ্দেশ্যে বাগান থেকে আম প্রথমে ঢাকায় কোয়ারেন্টিনে নিতে হয়। সেখান থেকে প্যাকিং হাউজে যায় আরেক জায়গায়। এরপর যায় বিমানবন্দরে। এটি একটি লম্বা প্রক্রিয়া। এতে খরচ ও ভোগান্তি বাড়ে। আমও নষ্ট হয়ে যায়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারি না।’

একই ভাষ্য রাজশাহী এগ্রো ফুড প্রডিউসার সোসাইটির সভাপতি আনোয়ারুল হকের। সমাধান হিসেবে উৎপাদন এলাকায় সমন্বিত প্যাকিং হাউজ চান আনোয়ারুল হক। আমসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য রফতানি প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন করতে রাজশাহীতে ল্যাব পরীক্ষা, কোয়ারেন্টিন সুবিধা এবং রাজশাহী বিমানবন্দরে কার্গো সুবিধা চান তিনি।

এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, রাজশাহী জেলায় মোট জমি ২ লাখ ৪২ হাজার ৫৪০ হেক্টর। এর মধ্যে আবাদযোগ্য জমি ১ লাখ ৮২ হাজার ২৭১ হেক্টর। আবাদযোগ্য পতিত জমি ২৩১ হেক্টর।

২০২১-২২ মৌসুমের তথ্যানুযায়ী, জেলায় ফল বাগান রয়েছে ২৭ হাজার ৮৯২ হেক্টর। এর মধ্যে ১৭ হাজার ৮৬৮ হেক্টর আম, ৫০০ হেক্টর লিচু, ২ হাজার ৯০৪ হেক্টর পেয়ারা, ৩৩৭ হেক্টর কুল এবং ৬ হাজার ৪৬৫ হেক্টরে অন্যান্য ফল বাগান রয়েছে। জেলায় বছরজুড়ে ফল পাওয়া যায় ৩৫ হাজার ৮৫৩ হেক্টর বাগানে। অন্যদিকে ২০২১-২২ মৌসুমে (খরিপ-১) জেলায় শাক-সবজি আবাদ হয়েছিল ৮ হাজার ৩২০ হেক্টর। গড়ে ১৬ দশমিক ৮৪ টন হারে উৎপাদন ছিল ১৪ হাজার ১০৯ টন।

এ অঞ্চল খাদ্য উদ্বৃত্ত অঞ্চল বলে নিশ্চিত করেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন। তিনি বলেন, ‘রাজশাহীর চাষীরা নিরাপদ ও রফতানিযোগ্য কৃষিপণ্য উৎপাদন করছেন। এসব কৃষিপণ্য রফতানিও হচ্ছে। তবে উৎপাদনকারী ও রফতানিকারকদের মাঝে লিংকেজ ঘাটতি এবং পারস্পরিক আস্থার সংকটও রয়েছে। ফলে সেভাবে রফতানি এগোচ্ছে না।

তিনি আরো বলেন, ‘কৃষিপণ্য রফতানিসংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত সংকট রয়েছে এখানে। স্থানীয় পর্যায়ে যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে কৃষিপণ্য প্যাকেটজাত করে কার্গো বিমানে তোলা গেলে রফতানি আরো বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে কৃষকের আয়।’

এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, ‘কৃষিপণ্যের রফতানি বাড়লে তা আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য সুফল বয়ে আনবে। কেননা এ অঞ্চল কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিনির্ভর। কিন্তু প্রকৃত সুবিধা ভোগ করে ব্যবসায়িক শ্রেণী, অন্যদিকে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা সবসময় সুবিধাবঞ্চিত হয়ে থাকেন। তবে রফতানি খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়লে কিছুটা হলেও কৃষক লাভবান হবেন বলে আমি মনে করি।’

রফতানি বাড়লে অর্থনীতির দিক কীভাবে পরিবর্তন হতে পারে—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কৃষি খাতে রফতানি আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। সেটা যেমন পণ্যই হোক না কেন। তবে সবজি জাতীয় পণ্যের তুলনায় ফল, পাট কিংবা চিংড়ি জাতীয় কৃষিপণ্যের রফতানি আমাদের জন্য বেশি লাভজনক।’


লেখক: সাংবাদিক

আরও