কঠোর অধ্যবসায় ও তীব্র প্রতিযোগিতা পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ করে। পাশাপাশি মনের মধ্যে বিরাজ করে এক ধরনের ভীতি। নতুন পরিবেশ, বন্ধুবান্ধব ও পড়াশোনা মানিয়ে নেয়ার পাশাপাশি ক্যারিয়ার গড়া নিয়ে থাকে হতাশা-উত্কণ্ঠা। অনেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, কোন ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার গড়া তার জন্য ভালো হবে বা উপযুক্ত। কিংবা অনেক শিক্ষার্থীই করপোরেট জব বা তরুণ উদ্যোক্তা হতে চান, কিন্তু দিকনির্দেশনার অভাবে তারা বিভ্রান্ত হন কিংবা ভুল পথে পা বাড়ান।
শিক্ষার্থীদের নতুন এ যাত্রাকে সহজ
করতে, তাদের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে এবং ক্যারিয়ারে সফল হতে করপোরেট জগতের
সঙ্গে মেলবন্ধনের কাজ করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘ভয়েস
অব বিজনেস’ (ভিওবি)। ঢাবির ব্যবসায়
শিক্ষা অনুষদের শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত এ সংগঠনে রয়েছে শক্তিশালী একাডেমিক
গাইডলাইন, ক্যারিয়ার গঠনমূলক নির্দেশনা,
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা আর আগামী দিনের পাথেয় হিসেবে
করপোরেট জগতের সঙ্গে মেলবন্ধন।
ক্লাবটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা
গেছে, ২০০৭ সালে ম্যাগাজিন প্রকাশনার মাধ্যমে যাত্রা শুরু এ ক্লাবের। করপোরেট
জগতের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ব্যবধান দূর করার অভিপ্রায় নিয়ে যাত্রা করা ক্লাবটির
শুরুর দিকের কার্যক্রম মূলত বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
কিন্তু এখন কার্যক্রম অনেক বিস্তৃত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ক্লাবটি থেকে ১০টি
ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে। ম্যাগাজিনের পাতাগুলো পরিপূর্ণ থাকে সমাজের বিভিন্ন
স্তরের মানুষদের সফলতা-ব্যর্থতার গল্প থেকে শুরু করে ব্যবসায়ে নতুনত্বের নানা ধরন নিয়ে। যা
পাঠকদের স্পষ্ট ধারণা দেয় ক্রমবর্ধমান কার্যক্রম ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে আটপৌরে
ধারণা থেকে বেরিয়ে নতুন ও সম্ভাবনার পথে হাঁটার।
ম্যাগাজিন প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে
আয়োজিত হয় ‘ভিওবি উইক’। যেখানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে ম্যাগাজিনের মোড়ক উন্মোচন করা
হয়। ভিওবি উইকে মোড়ক উন্মোচনের পাশাপাশি সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন সেমিনার ও মেলার
আয়োজন করা হয়। এছাড়া রয়েছে ব্যবসার ধারণা সম্পর্কিত লেখালেখি প্রতিযোগিতা, যেখানে
সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারেন। এটাই এখন
শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত দেশের সর্ববৃহৎ ব্যবসায় ম্যাগাজিন। ভিওবি’র প্রধান
পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. শিবলী
রুবাইয়াতুল ইসলাম।
কেবল লেখনীর মধ্যেই নয়, নিজেদের বার্তাগুলোকে সবার আরো কাছে পৌঁছে দিতে বিভিন্ন সময় আয়োজন করা হয় সেমিনার কিংবা ওয়ার্কশপের। যেখানে উঠে আসে সমাজের বিভিন্ন স্তরে নিজেদের সার্থক হিসেবে প্রমাণ করতে পারা মানুষগুলোর বিভিন্ন পথ অতিক্রম করার গল্প। আয়োজিত এসব অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের যুক্তি আর পরিকল্পনাকে প্রতিষ্ঠিত হাতে ঝালাই করে নেয়ার সুযোগ পান। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘ব্র্যান্ড্রিল’। এটি একটি জাতীয় পর্যায়ের ব্র্যান্ডিং প্রতিযোগিতা, যেখানে সারা দেশ থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। এরই মধ্যে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ব্র্যান্ডিলের দুটি পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া চলতি বছর ক্লাবটি ‘বিজনোভেশন’ নামক একটি নতুন ব্যবসায়ের ধারণা সম্পর্কিত প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। এ বছর বিজনোভেশনের বিষয় ছিল পরিবেশবান্ধব ব্যবসায়ের ধারণা। ক্লাবটির রয়েছে নিজস্ব ওয়েবসাইট, যার মাধ্যমে তারা সবার সঙ্গে তাদের কার্যক্রমের মেলবন্ধন রচনা করছে। এছাড়া এ বছর ইন্টার্নশিপ ফেয়ারের আয়োজন করেছে ক্লাবটি।
স্বপ্ন যখন গঠনমূলক, তা
বাস্তবায়নে পুরো কার্যক্রমও তো নিখুঁত হওয়া উচিত। তাই কয়েকটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে
প্রতি বছর নির্ধারিত হয় তারুণ্যনির্ভর এ সংগঠনটির নেতৃত্ব। কমিটি গঠনের বিষয়ে ভয়েস
অব বিজনেসের প্রেসিডেন্ট আজমাইন আদিল জানান,
প্রথমে সংগঠনটির এক্সিকিউটিভ সদস্য বাছাই করা
হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে ভর্তি হওয়া নবীন সদস্যদের মধ্যে
থেকে তিন স্তরে বাছাই করে এক্সিকিউটিভ রিক্রুটমেন্ট করা হয়। প্রথমে লিখিত, এরপর
গ্রুপ ডিসকাশন এবং সর্বশেষ ধাপে গিয়ে ভাইভা নেয়ার পর ক্লাবের এক্সিকিউটিভ করা হয়।
এক্সিকিউটিভ সদস্যদের মধ্য থেকে কার্যক্রম মূল্যায়ন করে অ্যাসোসিয়েট সদস্য করা হয়।
এরপর আবার অ্যাসোসিয়েটদের মধ্য থেকে ১২ জনকে ক্যাবিনেট হিসেবে মনোনীত করা হয়। আগের
কমিটির সদস্যরা কার্যক্রম মূল্যায়নের মাধ্যমে এক বছরের জন্য ক্যাবিনেট সদস্যদের
নির্বাচন করেন। তারাই মূলত অ্যাসোসিয়েট ও এক্সিকিউটিভ সদস্যদের সহায়তা নিয়ে
সংগঠনটির কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
পুরো এ কার্যক্রম সার্থক করতে ভয়েস অব
বিজনেসের প্রায় ৮০ সদস্যের একটি বড় প্রশাসনিক কাঠামো রয়েছে। মূলত একটি আদর্শ
বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে যে বিষয়গুলো কাঠামোগত ও আনুষ্ঠানিকতার পরিচর্যায় রাখা হয়, তার
পুরোটা আছে ভিওবির। ফলে এর সদস্যরা কম-বেশি কর্মজীবনের একটি প্রাথমিক ধারণা এখান থেকেই পেয়ে যান। ভিওবি
প্রেসিডেন্ট আদিল বলেন, ‘পুরো সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে একটি দাপ্তরিক আবহে। যেখানে প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি
থেকে শুরু করে ম্যাগাজিন এডিটর,
কমিউনিকেশন, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ফিন্যান্স, করপোরেট
অ্যাফেয়ার্স ও পাবলিক রিলেশনসহ বিভাগগুলো আলাদাভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে
শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করার আগেই পেয়ে যাচ্ছেন কর্মজীবনের আবহ।’
‘যেহেতু ম্যাগাজিনটি প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে
বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানে দেয়া হয়,
সে সূত্রে সংগঠনটি এরই মধ্যে করপোরেট জগতে একটি
পরিচিত নাম। এছাড়া সাবেক সদস্যরা,
যারা এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভালো
অবস্থানে আছেন, তারা সার্বক্ষণিক আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। আমাদের এ প্রোগ্রামের
প্রধান উদ্দেশ্যই করপোরেট লিডার হতে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন
করে তোলা। ক্যারিয়ার-বিষয়ক বিভিন্ন দিকনির্দেশনা পেয়ে অনুজরা উপকৃত হবে, নিজেদের
সে অনুযায়ী গড়ে তুলবে, এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য’— বলছিলেন আজমাইন আদিল।
বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক কর্মক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা যাতে ভবিষ্যতের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে এখন থেকেই সচেতন হন এবং তাদের যথাযথভাবে প্রস্তুত করে তোলাকে কেন্দ্র করেই মূলত পরিচালিত হচ্ছে ভয়েস অব বিজনেস। শিক্ষার্থীরা ক্লাবটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজেদের নানা বিষয়ে পারদর্শী করে তুলতে পারছেন। তারা কেবল করপোরেট জগৎ এবং গ্লোবাল বিজনেস নিয়ে ধারণা পান না, বরং এটা তাদের এমন একটি প্লাটফর্ম, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের উপস্থাপন করতে পারেন, নিজেদের ব্যবসায় সম্পর্কিত নিত্যনতুন ধারণাকে উপস্থাপন করতে পারেন; সেসঙ্গে নিজেদের দক্ষ করে তুলতে পারেন। শিক্ষার্থীরা যেন জীবনের পরবর্তী ধাপের জন্য নিজেদের শুরু থেকেই ঝালিয়ে নিতে পারেন, ভয়েস অব বিজনেস সেটাই নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।