উচ্চ শিক্ষায় সংস্কার

কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই?

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের বার্তা ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কিছু সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের বার্তা ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কিছু সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও নানা সংস্কার চাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীরা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন তাদের ভাবনা।

গবেষণায় বাজেট বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি

নাঈম আহমদ শুভ 

শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো অনেক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যার কারণে বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। দলীয় প্রভাব, নিয়োগে স্বজনপ্রীতি-অঞ্চলপ্রীতি, কম যোগ্যদের নিয়োগদান, নতুনত্বহীন শিক্ষা কারিকুলাম, গবেষণাবিমুখতা, সৃজনশীলতার অভাব, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সমন্বয়হীনতা, পড়াশোনার অনুপযুক্ত পরিবেশ, পুষ্টিকর খাবারের অভাব, হলে গাদাগাদি পরিবেশ, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ও সেমিনার লাইব্রেরি না থাকা, একাডেমিক ক্যালেন্ডারের অনুসরণ না করা এবং পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পার্টটাইম কাজ করার সুযোগের অভাব ইত্যাদি বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতির অন্তরায়। বিগত এক দশকের কথাই যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাই প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও অঞ্চলপ্রীতির ঘটনা ঘটেছে। অনেক জায়গায় বেশি যোগ্যদের অবমূল্যায়ন করে কম যোগ্যদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যার প্রভাব শিক্ষাদানে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া গতানুগতিক শিক্ষা কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা পড়ে আসায় এতে সৃজনশীলতার বালাই থাকে না। এতে নতুনত্ব যতটুকু থাকার কথা তা থাকে না। গবেষণা ক্ষেত্রে বাজেট বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি।

পাবলিক ও প্রাইভেট অভিন্ন সিস্টেমে চলা উচিত

তাসনীম হাসান

শিক্ষার্থী, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে পাবলিক ও প্রাইভেট নামে এক বিভাজন রয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বলতে পাবলিক, প্রাইভেট ভিন্ন চোখে দেখার সুযোগ নেই। শিক্ষা সাংবিধানিক অধিকার হয়ে থাকলে এত বড় জনগোষ্ঠীর উচ্চ শিক্ষার বড় একটি অংশ কেন বেসরকারিভাবে পরিচালিত হবে। রাষ্ট্র কেন দায়িত্ব নেবে না সে ব্যাপারে নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে। আর্থিক সামর্থ্য উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের মাপকাঠি হতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত লাখের বেশি শিক্ষার্থী আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। উচ্চ শিক্ষার বড় একটি অংশের চাহিদা পূরণ করছে বেসরকারি খাত। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক ও অভিন্ন সিস্টেমে চলা উচিত। কিন্তু আমরা দেখি উভয়ের মধ্যে সচেতনভাবে পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রাইভেটের কোর্স কারিকুলাম, গ্রেডিং সিস্টেম, পরীক্ষা পদ্ধতি, টিউশন ফি—মোট কথা এ দুই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা ও সুযোগ-সুবিধা একে অন্যের বিপরীত। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বলছে তারা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। যদি তাই হতো তাহলে এত অর্থ ব্যয় করে কেন উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। যেখানে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই আবাসন সুবিধা, পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, ল্যাব সরঞ্জাম ও গুণগত শিক্ষক।

পাঠ্যক্রম যুগোপযোগী হওয়া জরুরি

মৌমিতা পাল চৌধুরী

শিক্ষার্থী, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এমন হওয়া উচিত যেখানে শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শিক্ষকদের যথাযথ যোগ্যতা থাকা এবং পাঠ্যক্রম যুগোপযোগী হওয়া জরুরি। বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম, বিদেশে পড়াশোনা বা ইন্টার্নশিপের সুযোগ থাকা উচিত। গ্রেডিংয়ের নিয়ম ও মানদণ্ড খুবই স্বচ্ছ হওয়া উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে কীভাবে তাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে। একাডেমিক দক্ষতা ও কনসেপ্টের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন হওয়া উচিত, কোনো পক্ষপাত ছাড়াই। শুধু সেমিস্টার ফাইনাল বা মিডটার্ম পরীক্ষার ওপর নির্ভর না করে ক্রমাগত মূল্যায়নের ভিত্তিতে গ্রেডিং হওয়া উচিত। প্রজেক্ট, অ্যাসাইনমেন্ট, ক্লাস পার্টিসিপেশন, কুইজ ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মূল্যায়ন করা গেলে তাদের প্রকৃত প্রগতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের গ্রেডের সঙ্গে তাদের কাজের ফিডব্যাক দেয়া উচিত, যাতে তারা বুঝতে পারে তাদের কোন জায়গায় উন্নতি প্রয়োজন এবং কীভাবে তারা নিজেদের আরো ভালো করতে পারে। শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের প্রতি সদাচরণ এবং তাদের মতামত ও প্রশ্নকে সম্মান করা। এতে শিক্ষার্থীরা সহজেই নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে সাহস পায়।

নিয়োগ প্রক্রিয়া হবে দলীয়করণমুক্ত

এ টি এম মাহফুজ 

শিক্ষার্থী, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া হতে হবে দুর্নীতি ও দলীয়করণমুক্ত। কারণ দলীয় লবিং ও আর্থিক লেনদেন করে নিয়োগপ্রাপ্তরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধ করতে তাদের সাধ্যের সবকিছুই করেন। এমনকি তারা ছাত্রদের এমনভাবে ব্যবহার করেন, যা একটি সুন্দর শিক্ষাঙ্গনকে ধ্বংস করতে সক্ষম। তাই নিয়োগ স্বচ্ছ হলে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও অনিয়ম, দুর্নীতিমুক্ত ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে কাজ করবেন। ক্যাম্পাসে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা অপরিহার্য। বর্তমানে সব ধরনের দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে প্রতিটি ক্যাম্পাসে নির্ধারিত সময়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, এটি থেকে বের হয়ে সবার জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণায় বরাদ্দের ঘাটতির কারণে অর্থাভাবে অনেক শিক্ষার্থী আগ্রহ হারাচ্ছেন।

আবাসন সমস্যার সমাধান চাই

মুরসালিন মাহমুদ খান

শিক্ষার্থী, ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ 

বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পূরণ ও মেধার বিকাশ হয় না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও স্বপ্ন পূরণে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে থাকেন। মানসম্পন্ন শিক্ষার পরিবেশ, উন্নত গবেষণাগার, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজের পরিবেশ এবং গবেষণার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ একটি ক্যাম্পাস চাই। বিশেষ করে ওপেন ক্রেডিট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোর্স রেজিস্ট্রেশনের সময় নানা ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হন, এ সমস্যার সমাধান হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। অনেক সময় দেখা যায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ টিউশন ফি এবং স্কলারশিপ রিলেটেড রুলস পরিবর্তন করে, যার দ্বারা শিক্ষার্থীরা সমস্যায় পড়েন। এক্ষেত্রে নতুন করে এমন আইন প্রণয়ন করতে হবে যাতে একজন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার পর টিউশন ফি এবং স্কলারশিপ রিলেটেড নতুন কোনো নিয়ম দ্বারা ধোঁকার শিকার না হন। আবাসিক ভবন স্থাপনের মাধ্যমে আবাসন সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে। 

আরও