আমাদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে তহবিলের স্বল্পতা। তহবিল ছাড়া তো ঘরে বসে গবেষণা করা যায় না! বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা অল্প পরিমাণের একটি তহবিল পাই যা দিয়ে আসলে কিছু হয় না
শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর যাত্রা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ (ডিইউআরএস)। ‘সুন্দর পৃথিবীর জন্য গবেষণা’ স্লোগানে ঢাবির বিভিন্ন বিভাগের ৩৩ জন মেধাবী তরুণের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রথম এ গবেষণা সংগঠন। বহুমুখী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের একাডেমিক গবেষণায় সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি গবেষণাকে পেশা হিসেবে গ্রহণে উৎসাহ ও সহযোগিতা করার লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় সংগঠনটি।
আর
পেশা যখন গবেষণা, তখন দরকার নিবিড় তত্ত্বাবধান। প্রয়োজন প্রেরণা শক্তির জোগান। এ কাজটিই করছে গবেষণা সংসদ। গবেষণার মাধ্যমে উদার, যৌক্তিক, অসাম্প্রদায়িক ও চিন্তাশীল প্রজন্ম তৈরিতে ভূমিকা রাখাসহ ছাত্র-ছাত্রীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী বিনির্মাণে কাজ করা এ সংগঠনের মূল লক্ষ্য।
চলমান
প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে একজন প্রকৃত ‘গ্লোবাল সিটিজেন’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যেসব আনুষঙ্গিক বিষয়ে অভিজ্ঞতা, ধারণা লাভ ও জ্ঞান অর্জন আবশ্যক, তা নিয়ে নানা কাজ করে থাকে সংগঠনটি। নিয়মিত সভা, সম্মিলিত ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা, নিয়মিত সাপ্তাহিক গবেষণা সেশন, মাসিক গবেষণা অনুষ্ঠান (মিট দ্য রিসার্চার), দক্ষতা
উন্নয়নে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি কর্মশালার আয়োজন, শিক্ষার্থীদের থিসিস ও গবেষণা মনোগ্রাফ, প্রপোজাল তৈরির জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ আয়োজন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা সেমিনার, সম্মেলন, যুব গবেষক সম্মেলন, স্কুল-কলেজভিত্তিক গবেষণা সম্মেলন, গবেষণা উৎসব, ধারণাপত্র ও পোস্টার প্রেজেন্টেশন প্রতিযোগিতা ইত্যাদি আয়োজন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা পরিচালনার স্বার্থে খ্যাতিমান গবেষক, স্কলার, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি বহুমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে এ সংগঠন কাজ করছে।
ইতিহাস
বিভাগের তত্কালীন এমফিল গবেষক সাইফুল্লাহ সাদেকের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় গবেষণা সংসদ। সাংবাদিকতা ও টিএসসিকেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার সুবাদে রিসার্চ সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করার আগ্রহ জাগে তার মধ্যে। দীর্ঘদিনের চিন্তার ফল হিসেবে বিভিন্ন বিভাগের গবেষণামনস্ক প্রায় ৩৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রথম বর্ষ থেকে শুরু করে এমফিল পিএইচডি গবেষকরাও এ সংগঠনের সদস্য হতে পারেন।
প্রতি
বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সংগঠনের সদস্য আহ্বান করা হয়। তবে গবেষণায় আগ্রহী ও গবেষণাকর্মের অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের বছরের যেকোনো সময় সংগঠনের ওয়েবসাইটে (www.dursbd.com) গিয়ে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে সদস্য হিসেবে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বর্তমানে
প্রায় এক হাজার সদস্য নিয়ে ২০টি গবেষণা দলে বিভক্ত হয়ে কাজ করছে গবেষণা সংসদ। গবেষণার বিস্তৃত শাখাকে নির্দিষ্ট করে বিষয়ভিত্তিক বিশেষায়িত গবেষণা দলগুলোর মধ্যে রয়েছে এডুকেশন রিসার্চ টিম, সায়েন্স, বায়োসায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, আইসিটি, আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, হেলথ অ্যান্ড সোস্যালওয়ার্ক, ইকোনমিকস, হিস্ট্রি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন্স, পলিটিকস ল অ্যান্ড লিগ্যাল সিস্টেম, সোস্যাল সায়েন্স, গ্লোবাল ব্র্যান্ডিং, ইথিকস অ্যান্ড রিলিজিয়ন, শিল্প ও সংস্কৃতি, মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স, জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ওয়ার, পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটি, ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন এবং অ্যানথ্রোপলজি অ্যান্ড আর্কিওলজি।
গবেষণা
দলগুলো বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণা প্রস্তাবনা গ্রহণ করে সে অনুযায়ী গবেষণা পরিচালনা করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু গবেষণা প্রজেক্ট হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ছাত্রীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা, ঢাবির বর্জ্য, ময়লা ও পানি ব্যবস্থাপনা এবং পর্যালোচনা, ছাত্র-ছাত্রীদের সহশিক্ষা কার্যক্রমে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ, ঢাবির পরিবহন ব্যবস্থাপনা: সমস্যা ও সম্ভাবনা, ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর ফেসবুকের প্রভাব: পর্যালোচনা, ছাত্রীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা: একটি পর্যালোচনা, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, ক্যাম্পাসে শব্দদূষণ ও এর প্রভাব, ক্যাম্পাসের স্ট্রিট ফুড, টিএসসির সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস পর্যালোচনা, ক্যাম্পাস সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ ও সীমাবদ্ধতা, বাংলাদেশের টেলিভিশন সাংবাদিকতায় নারী: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা, তরুণদের চিন্তা-চেতনায় ছাত্র রাজনীতির প্রভাব ও সমস্যা, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা সংগঠনের অগ্রযাত্রা ও বিকাশ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্তির প্রভাব ও পর্যালোচনা ইত্যাদি।
নিজেদের
মধ্যে গবেষণা পরিচালনার পাশাপাশি এ সংগঠন দেশ-বিদেশের গবেষণা সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞ গবেষক-স্কলারদের সমন্বয়ে কাজ করে থাকে এবং অংশগ্রহণ করে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গবেষণা সেমিনার ও কর্মশালায়। গবেষণা সংসদের নিয়মিত প্রকাশনা সাময়িকী ‘বিনির্মাণ’, যেখানে
রয়েছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গবেষণাধর্মী লেখার সমাহার। এরই মধ্যে ২০২০ সালের জন্য গবেষণা সংসদ দ্বিতীয় স্নাতক গবেষণা ফেলোশিপ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে গবেষণা সংসদ আগামী ১ এপ্রিল আয়োজন করবে বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক স্টুডেন্ট রির্সা কনফারেন্স। এ সম্মেলনে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি গবেষকরা নিজেদের গবেষণাপত্র উপস্থাপন করবেন।
এরই
মধ্যে ভারত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংগঠনের আয়োজনে সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়েছে গবেষণা সংসদ। গত বছর গবেষণা সংসদের ২০ সদস্য ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় ও কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার ও কনফারেন্সে যোগ দেন। ২০১৮ সালের আগস্টে প্রথমবারের মতো ভারতের মেঘালয়ের নর্থ ইস্টার্নহিল ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত নয়দিনের গবেষণা কর্মশালা ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করে। সেখানে গবেষণা সংসদের ২২ জন তরুণ গবেষক কর্মশালা ও রিসার্চ পেপার উপস্থাপন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটভুক্ত এ সংগঠনের অনুপ্রেরণায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে গবেষণা সংসদ যাত্রা করেছে। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণা সংগঠন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদ্যোগ চলছে বলে জানান গবেষণা সংসদের বর্তমান সভাপতি নাসরিন জেবিন। নিজেদের প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিটি সৃজনশীল কাজেই চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা থাকে। আমাদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে তহবিলের স্বল্পতা। তহবিল ছাড়া তো ঘরে বসে গবেষণা করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা অল্প পরিমাণের একটি তহবিল পেয়ে থাকি, যা দিয়ে আসলে কিছু হয় না। ছাত্র-শিক্ষক এবং দেশের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি আমাদের এ গবেষণায় সহযোগিতা করত, তাহলে আমরা আরো ভালো করতে পারতাম।