ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থী

প্রতিকূলতার পাহাড় ঠেলে চবিতে খুমি সম্প্রদায়ের প্রথম শিক্ষার্থী লিংকু

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রুমা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের একটি ছোট্ট গ্রাম। নাম রুংতং পাড়া।

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রুমা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের একটি ছোট্ট গ্রাম। নাম রুংতং পাড়া। গ্রামটির দূরত্ব রুমা থেকে ১৬ কিলোমিটার এবং বান্দরবান শহর থেকে ৯৫ কিলোমিটারেরও বেশি। খুমি সম্প্রদায়ের আবাসস্থল গ্রামে না ছিল বিদ্যুৎ, না ছিল ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা। পাহাড় বেয়ে চলাচল করতে হতো। হাসপাতাল কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দূরত্ব ছিল গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে পাহাড়ি পথ। ইন্টারনেট সংযোগ তো দূরের কথা, সেলুলার নেটওয়ার্কও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। এই দুর্গম পাহাড় বেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির গৌরব অর্জন করেছে লিংকু খুমি। দর্শন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। খুমি সম্প্রদায় থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া তিনিই প্রথম শিক্ষার্থী। তার গ্রাম থেকে তিনিই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী।

দীর্ঘ পাহাড়ি পথ বেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসা লিংকুকে সংগ্রাম করতে হয়েছে দারিদ্র্যের সঙ্গেও। বাবা রিংলুহ খুমি এবং মা প্রাইলং খুমির ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয়। অন্য আট সদস্যের পরিবারের খরচ চালানো এবং সন্তানদের পড়াশোনা করানো জুমচাষী বাবার জন্য ছিল দুঃসাধ্যের। তবে দরিদ্র হলেও বাবা ছিলেন শিক্ষানুরাগী। অভাব-অনটনের সংসারে সংগ্রাম করেই পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া লিংকুর জন্য সহজ ছিল না। বিদ্যুৎ না থাকায় হারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করতে হতো। অর্থের অভাবে হারিকেনের কেরোসিন কেনারও সুযোগ হতো না। ফলে অন্যের হারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করতে হয়েছে। কোনো কোনো দিন আলোর অভাবে পড়াই হতো না।

লিংকু প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করে বড় ভাইয়ের কাছে। পরে ছয় বছর বয়সে রুমা উপজাতীয় আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বাড়ি থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরবর্তী বিদ্যালয় ছিল তার প্রথম সংগ্রাম। যেখানে প্রথম ধাক্কা আসে ভাষা নিয়ে। ভাষা না জানায় শিক্ষক-সহপাঠীদের সঙ্গে ইশারা-ইঙ্গিতে যোগাযোগ করতে হতো তাকে। ভাষার কারণেই পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়তেন তিনি। স্কুল বন্ধের সময় দিনমজুরি করে বই-খাতার খরচ জোগাতেন। এভাবে লিংকুর ১০ বছরের জীবন কেটে যায়।

লিংকুর কলেজের দূরত্ব ছিল ৯৫ কিলোমিটার। বাবা আর্থিক অভাবে কলেজে ভর্তি করাতে পারেননি। পরে এক পরিচিত শিক্ষকের সুপারিশে বান্দরবান কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিনা বেতনে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। অভাবের তাড়নায় কলেজ অধ্যয়নকালে টিউশনি করতে হয়েছে তাকে। মাঝেমধ্যে কলেজে যেতে না পারায় মিলেছে কর্তৃপক্ষের তিরস্কারও। অধিকাংশ সময় কলেজের পাঠ বাড়িতে রিভিশন করার সুযোগ হতো না। এসব কারণে কলেজে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করেন তিনি। অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এভাবে কলেজ জীবন পার করেন তিনি।

কলেজ শেষের পর এল আরেক সন্ধিক্ষণ। বান্দরবানের খুমি সমাজের ছেলেমেয়েরা বেশি পড়াশোনার সুযোগ পায় না। খুমি মা-বাবারা মনে করেন সন্তানরা এত পড়াশোনা করে কী করবে। কিন্তু লিংকু স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে শুরু করলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি একদিন ভর্তি হবেনই। বিশ্বাস করতেন তার সংগ্রাম একদিন সফল হবেই। পরিশ্রম কখনো বৃথা যেতে পারে না। বাবাকে সুপ্ত স্বপ্নের কথা জানালেন। আর্থিক সংকটের দোহাই দিয়ে অপারগতা প্রকাশ করলেন দরিদ্র বাবা। বাবার কথা শুনে হতাশ হলেন লিংকু। তবে হাল ছাড়েননি। পরে জুম একাডেমি নামে ফ্রি কোচিং সেন্টারের সহায়তায় স্বপ্ন পূরণ হয় লিংকুর।

প্রথমত, সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করতে চান পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী। নিজ পরিবার সমাজের জন্যেও কাজ করার পরিকল্পনা আছে তার। আর্থিক অনটন সত্ত্বেও পরবর্তী গন্তব্যে তিনি পৌঁছাতে চান। বণিক বার্তাকে লিংকু খুমি বলেন, ‘আমি ১২ বছরের পথ অতিক্রম করতে পেরেছি সফলভাবে। আগামী পাঁচ বছরের পথও পাড়ি দিতে পারব, সংগ্রাম করতে পারব।

নিজ সম্প্রদায়ের উদ্দেশে লিংকু একটা বার্তা পৌঁছে দিতে চান। তিনি বলেন, ‘আমি খুমিদের কাছে বলতে চাই। যদি সফল হতে চান, আমার চেয়ে দ্বিগুণ সংগ্রাম করতে হবে। বর্তমান সময়ে টিকে থাকতে হলে আরো বেশি পরিশ্রম করতে হবে। আর আমার মতো আর্থিক অভাবে যেন থাকতে  না হয়। সেজন্য সমাজের বিত্তবান অংশকে হাত বাড়াতে হবে।

পাহাড় বেয়ে আসা লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে বেঁচে থাকা সংগ্রামী জীবনের গল্প বৃহত্তর সমাজের কাছে তুলে ধরতে চান লিংকু খুমি।

আরও