হালদা থেকে ডিম সংগ্রহ

কার্যকর সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনাই গড়ে তোলা যায়নি!

হালদা নদীতে মা-মাছের ডিম থেকে রেণু উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সরকারি ও বেসরকরি পাঁচটি হ্যাচারিতে ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ আট হাজার কেজি ডিমের। কিন্তু সনাতন পদ্ধতিতে হ্যাচারি পরিচালনার কারণে এতে সংরক্ষণ করা ডিম নষ্ট হয়েছে কয়েক জায়গায়। অন্যদিকে ডিম থেকে রেণু উৎপাদনে কুয়া ও হ্যাচারিতে জায়গা সংকটের কারণে নদী থেকে ডিম সংগ্রহ করেননি স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা। এ কারণে মা-

হালদা নদীতে মা-মাছের ডিম থেকে রেণু উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সরকারি ও বেসরকরি পাঁচটি হ্যাচারিতে ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ আট হাজার কেজি ডিমের। কিন্তু সনাতন পদ্ধতিতে হ্যাচারি পরিচালনার কারণে এতে সংরক্ষণ করা ডিম নষ্ট হয়েছে কয়েক জায়গায়। অন্যদিকে ডিম থেকে রেণু উৎপাদনে কুয়া ও হ্যাচারিতে জায়গা সংকটের কারণে নদী থেকে ডিম সংগ্রহ করেননি স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা। এ কারণে মা-মাছের ডিম ছাড়ার হার বেশি হলেও সংরক্ষণের শঙ্কায় ডিম সংগ্রহ করেননি অনেকে। হ্যাচারিগুলোয় আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে ডিম বা রেণু নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতা সংকটে রয়েছে হ্যাচারি কর্তৃপক্ষ।

হালদা গবেষকরা বলছেন, নদীতে মা-মাছের ডিম ছাড়ার হার এবং সংগ্রহের হারে বেশ পার্থক্য দেখা গেছে। হালদাকে বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ ঘোষণা করলেও মা-মাছের ডিম সংরক্ষণে সরকারি পর্যায়ে হ্যাচারিগুলোর আধুনিকায়ন হয়নি। এতে হালদা থেকে যে পরিমাণ রেণু পাওয়ার কথা সেটি হচ্ছে না। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, হালদা নদীর ডিম সংগ্রহ এবং রেণু উৎপাদনে সরকারিভাবে চারটি হ্যাচারি স্থাপন করেছে মৎস্য অধিদপ্তর। এগুলো হলো চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় মদুনাঘাট মৎস্য হ্যাচারি, শাহ্ মাদারী মৎস্য হ্যাচারি, মাছুয়াঘোনা মৎস্য হ্যাচারি ও রাউজান উপজেলায় মোবারকখীল মৎস্য হ্যাচারি। এছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইডিএফের একটি হ্যাচারির মাধ্যমে ডিম সংগ্রহ করে রেণু উৎপাদন করে বিক্রি করে। বাকি ডিম ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগ্রহ করে রেণু উৎপাদন করেন সংগ্রহকারীরা।

গতকালের তথ্যমতে, হালদার ডিম সংগ্রহ করে রেণু উৎপাদনে ১৯৯২ সালে প্রথম মদুনাঘাট মৎস্য হ্যাচারি নির্মাণ করে মৎস্য অধিদপ্তর। এ হ্যাচারিতে সব মিলিয়ে ১০ কেজির ১২৮ বালতি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে, যা থেকে ১ হাজার ২৮০ কেজি রেণু উৎপাদনে কাজ করছে। অন্যদিকে মাছুয়াঘোনা হ্যাচারিতে ২ হাজার ৪০০ কেজি (২৪০ বালতি), শাহ্ মাদারী মৎস্য হ্যাচারিতে ১ হাজার ৯০০ কেজি (১৯০ বালতি) ও মোবারকখীল মৎস্য হ্যাচারিতে রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫৪০ কেজি (১৫৪ বালতি) ডিম। সব মিলিয়ে সরকারি চারটি হ্যাচারিতে ৭ হাজার ১২০ কেজি ডিম থেকে রেণু উৎপাদনে কাজ শুরু হয়েছে। এদিকে বেসরকারি আইডিএফের হ্যাচারিতে ১ হাজার ৩০০ কেজি (১৩০ বালতি) ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে।

মদুনাঘাট মৎস্য হ্যাচারির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসান আহসানুল কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ হ্যাচারিতে কোনো বাজেট বরাদ্দ নেই। এমনকি সরকারি কোনো লোকবলও নেই। এ কারণে হালদাপাড়ের প্রথম এ হ্যাচারি বেশ দুরবস্থায় আছে। সরকারিভাবে হ্যাচারিতে যতটুকু ডিম থেকে রেণু উৎপাদন করা যায় সে পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে এখনো রেণু বিক্রি শুরু হয়নি। ক্রেতাও আসেননি। বিক্রি শুরু হলে আমরা চাহিদা বুঝতে পারব।’

হালদা গবেষক, চবির হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মনজুরুল কিবরিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জলবায়ুর বিরূপ প্রবাহের কারণে মা-মাছের ডিম ছাড়তে দেরি হয়েছে। কিন্তু ডিম সংরক্ষণে বড় ধরনের ঘাটতি ছিল, সেটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সরকারিভাবে যতগুলো পদক্ষেপ নেয়ার কথা তা নেয়া হয়নি। সরকারি হ্যাচারিতে সংকুলান না হওয়ার কারণে অনেকের ডিম নষ্ট হয়ে গেছে। অন্তত ১০০টি কুয়া এবার নষ্ট হয়েছে। এ কারণে বেশি পরিমাণে ডিম সংগ্রহ করে এ কুয়ায় সংরক্ষণের কাজ করেছিলেন। তবে তাদের অধিকাংশেরই ডিম কুয়ায় দেয়ার কারণে রেণু নষ্ট হয়ে গেছে।’ কীভাবে আরো বেশি ডিম সংগ্রহ ও রেণু উৎপাদন করা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানান এ হালদা গবেষক।

চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘লোকবল সংকটের কারণে সরকারি হ্যাচারিগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছি না। সেখানে আমাদের কোনো বাজেট নেই। বিভিন্ন বিশ্লেষক হালদায় মাছের ডিম সংগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন। কুয়া সংকটের কারণে অনেক ডিম ও রেণু নষ্ট হয়ে গেছে। তবে আমরা একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছি, যাতে হ্যাচারিগুলোতে ডিমের ধারণক্ষমতা দ্বিগুণ করা সম্ভব হয়। তবে কী পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে সে সংখ্যা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।’ বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে পরিসংখ্যান দেয়া হচ্ছে সেটা সত্য নয় বলে জানান এ কর্মকর্তা। 

হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মা-মাছ হালদায় এবার ভালো পরিমাণে ডিম দিয়েছে। কিন্তু সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় ডিম সংগ্রহে বেশ কিছুটা ভাটা রয়েছে। তাছাড়া হ্যাচারিতে পর্যাপ্ত কুয়া নেই। এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও তেমন কুয়া গড়ে ওঠেনি। একটি কুয়ায় চার বালতি ডিম ধারণক্ষমতা থাকলেও সেখানে ছয়-সাত বালতি ডিম ফেলা হয়েছে কুয়া সংকটের কারণে। এ কারণে কুয়ায় অতিরিক্ত ধারণক্ষমতার রেণু নষ্ট হয়ে গেছে। সরকারি হ্যাচারিতে যদি ধারণক্ষমতা বাড়ানো না যায়, তাহলে হালদা নিয়ে আমাদের এত কাজ সব মাটি হয়ে যাবে।’

হাটহাজারীর মদুনাঘাট এলাকার ডিম সংগ্রহকারী আশু বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হালদায় এ বছরের সর্বশেষ জোতেই ডিম ছেড়েছে মা-মাছ। ডিম সংগ্রহে অতিরিক্ত সুযোগ থাকলেও সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় বেশির ভাগ সংগ্রহকারী ডিম সংগ্রহ কমিয়ে দেন। অন্তত এক-চতুর্থাংশ মা-মাছের ডিম হালদা নদীতেই নষ্ট হয়েছে। তাছাড়া সরকারি হ্যাচারিতেও পর্যাপ্ত ডিম থেকে রেণু উৎপাদন সুবিধা নেই।’

আরও