সংসদে প্রধানমন্ত্রী

৭০ অনুচ্ছেদ সরকারকে স্থিতিশীলতা দেয়

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সরকার ও দেশের উন্নয়নে স্থিতিশীলতা দেয়া সত্ত্বেও কতিপয় সংসদ সদস্য এর বিরোধিতা করছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘অনুচ্ছেদ ৭০ গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেয় ও জনগণের কাছে গণতন্ত্রের সুফল পৌঁছে দেয়ার জন্য এটিকে আরো শক্তিশালী করে।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সরকার দেশের উন্নয়নে স্থিতিশীলতা দেয়া সত্ত্বেও কতিপয় সংসদ সদস্য এর বিরোধিতা করছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, অনুচ্ছেদ ৭০ গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেয় জনগণের কাছে গণতন্ত্রের সুফল পৌঁছে দেয়ার জন্য এটিকে আরো শক্তিশালী করে। কিন্তু আমাদের (সংসদ) সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন অনুচ্ছেদের বিরুদ্ধে। কারণ, অনুচ্ছেদের জন্য তারা ইচ্ছেমতো সরকার ভাঙা-গড়ার খেলা খেলতে পারছেন না।

স্পিকার . শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে একাদশ জাতীয় সংসদের ২২তম (বিশেষ) অধিবেশনে সমাপনী ভাষণ প্রদানকালে গতকাল তিনি একথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রধানত সংসদ সদস্যদের ফ্লোর ক্রসিংয়ের কারণে ১৯৪৬ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর গঠিত সরকারগুলোকে উত্খাত করার কথা উল্লেখ করে তাদের অনভিজ্ঞতার কারণে কয়েকজন সংসদ সদস্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

তিনি আরো বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। যারা এটা করছেন তাদের অভিজ্ঞতার অভাব থাকতে পারে। ৭০ অনুচ্ছেদ আমাদের দেশে সরকারকে স্থিতিশীলতার সুযোগ দিয়েছেযে কারণে দেশ উন্নয়নের সাক্ষী হয়েছে।

বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের তার বক্তৃতায় সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের কথা বলেন।

এর আগে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭ ধারায় প্রধানমন্ত্রীর এপ্রিল গৃহীত একটি রেজল্যুশনের ভিত্তিতে সংসদে বিশেষ আলোচনা হয়।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সংসদে দেশের অর্জন তুলে ধরে স্মারক ভাষণ দেন।

সংসদে আরো বক্তব্য দেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, চিফ হুইপ নূর--আলম চৌধুরী বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইয়ুব, ইয়াহিয়া, জিয়া, জেনারেল এরশাদ খালেদা জিয়ার আমল প্রত্যক্ষ করায় তাদের অভিজ্ঞতা খুবই ভিন্ন।

আমেরিকায় তার প্রথম সফরের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে আন্ডার সেক্রেটারির সঙ্গে সাক্ষাৎকালে আমি বলেছিলাম, আমি এখানে আসার আগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ দেখেছি, যেখানে লেখা আছে জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার। আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি যেখানে জেনারেলের জন্য, সেনাদের দ্বারা, সেনাদের সরকার। তিনি বলেন, আমি সেই বৈঠকে বলেছিলাম, আমেরিকা আটলান্টিকের তীর পর্যন্ত তার গণতন্ত্রের চর্চা করে। আটলান্টিক পাড়ি দিলেই কি আপনাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টে যায়? তিনি বলেন, আমি তাদের প্রশ্নটিও করেছি, কেন আপনারা সামরিক স্বৈরশাসনকে সমর্থন করছেন? প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশটি (যুক্তরাষ্ট্র) প্রায়ই গণতন্ত্রের কথা বলে এবং বিরোধী দলসহ কিছু লোক সেইসব সবক শুনে উত্ফুল্ল বোধ করে। তিনি বলেন, হ্যাঁ, তারা যেকোনো দেশের সরকারকে উত্খাত করতে পারে। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলো কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর পুরো বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়েছে এবং এটাই বাস্তবতা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি রাজ্যে তিনজন কংগ্রেসম্যানের ঘটনার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তারা আমাদের গণতন্ত্রের সবক দেন। সব ক্ষেত্রেই তারা গণতন্ত্র মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেন। তাদের নিজ দেশের অবস্থা কী? এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসির তিন কংগ্রেস সদস্যের ঘটনাটি তুলে ধরে বলেন, কয়েকদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি রাজ্যে তিনজন কংগ্রেস সদস্যকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। কারণ তারা বন্দুক নিয়ন্ত্রণের জন্য আবেদন করে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, ধরনের বন্দুক সংরক্ষণ বন্ধ করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটাই ছিল তাদের অপরাধ। আর তিনজনকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু তাদের একজন শ্বেতাঙ্গ হওয়ায় বহিষ্কার হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন। তিনি বলেন, জাস্টিন জন জাস্টিন পিয়ারসন দুজনার অপরাধ হলো তারা কালো। সে কারণে তাদের আসন শূন্য হয়ে যায়। শেখ হাসিনা বলেন, তাহলে এখানে মানবাধিকার কোথায়! আমরা জিজ্ঞাসা করি, এখানে গণতন্ত্র কোথায়!

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী রাশেদ আমেরিকায় আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, আমি সেখানকার সব প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করেছি। আইনগতভাবে আমরা চেষ্টা করেছি। আমরা কূটনীতির মাধ্যমে চেষ্টা করেছি। আমি প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করেছি যে আপনি দণ্ডিত খুনিকে আশ্রয় দেবেন না। শেখ হাসিনা বলেন, শিশু খুনিরা, নারী খুনিরা, রাষ্ট্রপতি খুনিরা, মন্ত্রী খুনিরা। তারা মানবতা লঙ্ঘন করে। আপনারা তাদের আশ্রয় দেবেন না। তাকে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু তারা তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে না, বরং তাকে আশ্রয় দিয়ে খুনিদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।

তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন দেখা যাচ্ছে তারা দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষে ওকালতি করছে। তারা গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে এমন একটি সরকারকে ক্ষমতায় আনতে চায়, যেখানে কোনো গণতান্ত্রিক অস্তিত্ব থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু বুদ্ধিজীবীযারা বুদ্ধি বিক্রি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে এবং সামান্য কিছু অর্থ তাদের প্রলুব্ধ করে।

শেখ হাসিনা বলেন, একটি নামকরা পত্রিকা সাত বছরের এক শিশুর হাতে ১০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে তাকে মিথ্যা বলতে বলে। তারা তার মন্তব্য লিপিবদ্ধ করে—‘আমরা ভাত-মাছ-মাংসের স্বাধীনতা চাই এবং তা প্রকাশ করে। তিনি সংসদে বলেন, সেখানেও আছে সেই নামকরা সংবাদপত্র, যা খুবই জনপ্রিয়। এর নাম প্রথম আলো (আলো), কিন্তু এটা অন্ধকারে বাস করে। প্রথম আলো আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্র দেশের জনগণের শত্রু। শেখ হাসিনা বলেন, আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে চাই যে তারা কখনই দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চায় না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৭ সালে যখন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন তারা খুবই আনন্দিত হয়েছিল এবং সেই সময়ের ওই প্রক্রিয়ায় দুটি সংবাদপত্র সর্বাত্মকভাবে জড়িত ছিল। তাদের সঙ্গে একজন আছেন সুদখোর (ঋণদাতা), যিনি আমেরিকার খুব প্রিয়। তিনি বলেন, আমেরিকা একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করে না যে একটি ব্যাংক (গ্রামীণ ব্যাংক), যেটি একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যিনি সরকারি বেতন পেতেন, তিনি কোটি কোটি ডলার কোথায় পেলেন। তিনি কীভাবে আমেরিকার মতো জায়গায় বসে সামাজিক ব্যবসা করতে পারেন? দেশে-বিদেশে বিনিয়োগ করেন? টাকা কোথা থেকে আসে? তারা কি কখনো তাকে এটা জিজ্ঞেস করেছে? জিজ্ঞাসা করেনি। তিনি বলেন, আর এখন, আমাদের তাদের কাছ থেকেই দুর্নীতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই সম্পর্কে পাঠ নিতে হবে। মানবাধিকার সম্পর্কেও তাদের কাছ থেকে আমাদের কথা শুনতে হবে। তিনি বলেন, এই লোকেরা (. ইউনূস অন্যান্য) দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করার চেষ্টা করছে এবং জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।

শেখ হাসিনা বলেন, দেশের জনগণ বিশ্বাস করে যে আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকায় জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, এখন গ্রাম শহরের মধ্যে পার্থক্য কমে গেছে... আমরা প্রতিটি গ্রামে নাগরিক সুবিধা দিচ্ছি। সময় প্রধানমন্ত্রী ২০০৬ (বিএনপি-জামায়াত শাসনামল) এবং ২০২২ সালের মধ্যে অনেক সূচকে আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কে একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে বলেন, মাথাপিছু আয় ২০০৬ সালে ছিল মাত্র ৫৪৩ মার্কিন ডলার, তা থেকে ২০২২ সালে হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। একইভাবে জিডিপির আকার লাখ ১৫ হাজার ৭২ কোটি থেকে ৪৬ লাখ কোটি টাকা, বাজেটের আকার ৬১ হাজার কোটি থেকে লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ২১ হাজার ৫০০ কোটি থেকে লাখ ২৭ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ  দশমিক ৭৪ বিলিয়ন থেকে ৩২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, রফতানি আয় ১০ দশমিক শূন্য বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৫২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, রেমিট্যান্স প্রবাহ দশমিক বিলিয়ন থেকে ২১ দশমিক শূন্য বিলিয়ন মার্কিন ডলার, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ হাজার ৫০৫ কোটি থেকে লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা, গড় আয়ু ৫৯ থেকে ৭৩ বছর, পানীয়জলের সুবিধা ৫৫ থেকে ৯৮ দশমিক শতাংশ, বিদ্যুৎ উৎপাদন হাজার ৮৮২ মেগাওয়াট থেকে ২৫ হাজার ২২৭ মেগাওয়াট, দেশে বিদ্যুতের সুবিধাভোগী ২৮ থেকে ১০০ শতাংশ, সাক্ষরতার হার ৪৫ থেকে ৭৫ দশমিক শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

সরকারপ্রধান বলেন, ২০০৬ সালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল দশমিক ৪০ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল দশমিক ৫০ শতাংশ, মুদ্রাস্ফীতি ২০০৬ সালে ছিল ১০ শতাংশ, যা ২০১৯ সালে ছিল দশমিক শতাংশ এবং ২০২২ সালে দশমিক ৫৭ শতাংশ। তিনি বলেন, দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালে ৪১ দশমিক ৫১ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে কমে ২০ দশমিক শতাংশে, চরম দারিদ্র্যের হার ২৫ দশমিক শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে, প্রতি হাজার জন্মে শিশুমৃত্যুর হার ৮৪ থেকে ২১ জনে, মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখ প্রসবে ৩৭০ থেকে কমে ১৬১ জন হয়েছে।

শেখ হাসিনা ডিজিটাল অঙ্গনে বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়নের কথাও তুলে ধরেন।

আরও