* তিনজনের মৃত্যু * ফসল ও মাছের ব্যাপক ক্ষতি

শেরপুর ও ময়মনসিংহে পানিবন্দি লাখো মানুষ

টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় শেরপুরের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে ময়মনসিংহের তিন উপজেলাও। এ দুই জেলার অন্তত ২০০টি গ্রামের কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির ফসল, ভেসে গেছে খামারের লাখ লাখ টন মাছ। প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নেত্রকোনায়ও বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। 

এদিকে বন্যায় শেরপুরে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে দুজনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার খলিশাকুড়া গ্রামের ইদ্রিস আলী ও বাঘবেড় গ্রামের মানিক মিয়ার স্ত্রী অমিজা খাতুন (৪৫)। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন তিনজন। তারা হলেন উপজেলার অভয়নগর এলাকার বাছের আলীর ছেলে আবুল হাতেম ও আলমগীর হোসেন, নামা বাতকুচি গ্রামের জহুরা খাতুন। নালিতাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সানোয়ার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। 

ভারি বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা উজানের ঢলে শেরপুরের নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার কমপক্ষে ১৫০টি গ্রাম এবং ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়ার ৫০টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে কয়েক লাখ মানুষ। 

অতিবৃষ্টির কারণে শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার কয়েকটি নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত শুক্রবার জেলার মহারশি, চেল্লাখালী ও ভোগাই নদীর বাঁধের অন্তত সাত স্থান ভেঙে ঝিনাইগাতী উপজেলা সদর ও নালিতাবাড়ী পৌর এলাকাসহ শ্রীবরদী উপজেলার দেড় শতাধিক গ্রাম ডুবে যায়। নালিতাবাড়ীর তিলানী-শেরপুর মহাসড়কের রানীগাঁও-৩ সেতুর দুই পাশ ভেঙে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। 

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট পৌর এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ রয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকান। 

শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ঝিনাইগাতী উপজেলায় ৩২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এছাড়া পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীর অন্তত ২১টি ইউনিয়ন। হাজার হাজার একর জমির উঠতি আমন ফসল তলিয়ে গেছে।

গতকাল ঝিনাইগাতী উপজেলায় নদীর পানি কমলেও এখনো বেশির ভাগ গ্রাম পানিতে তলিয়ে আছে। অন্যদিকে শ্রীবরদী উপজেলার প্রায় ছয়টি ইউনিয়ন পানিতে ডুবে আছে।

ঝিনাইগাতী বাজারের ব্যবসায়ী সুরুজ মিয়া বলেন, ‘প্রতিটি ঘরে পানি উঠেছিল, ধীরে ধীরে পানি কমছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রতি বছরই নদীর বাঁধ ভাঙে। কিন্তু কেউ নজর দেয় না। আমরা স্থায়ী বাঁধ চাই।’ 

শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান জানান, বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের শুকনা খাবার ও গোখাদ্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। 

অন্যদিকে গত বৃহস্পতিবার থেকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলায় পানি বাড়তে থাকে। এর মধ্যে হালুয়াঘাট পৌর শহরের নয়টি ওয়ার্ডসহ ১২টি ইউনিয়নই বন্যাকবলিত হয়েছে। পানি ঢুকে পড়েছে উপজেলা সদর হাসপাতাল চত্বরে। ধোবাউড়ায় টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নেতাই নদের বাঁধ ভেঙে উপজেলার অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এলাকাগুলো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ রয়েছে।

ময়মনসিংহ জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সানোয়ার হোসেন জানান, হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে এখন পর্যন্ত নারী-শিশুসহ সাত শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তাদের জন্য শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হালুয়াঘাট সীমান্তবর্তী দর্শা, মেনংছড়া, বোরারঘাট ও সেওলা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে। ওইদিন রাতেই বিভিন্ন স্থানে নদীর বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে প্রবল বেগে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। এতে ভুবনকুড়া ইউনিয়নের মহিষলেটি, ধোপাজুড়া, কড়ইতলী ও জুগলী ইউনিয়নের গামারীতলা, জিগাতলা, নয়াপাড়া, ছাতুগাঁও, কৈচাপুর ইউনিয়নের নলুয়া ও জয়রামকুড়া প্লাবিত হয়। এছাড়া গাজীরভিটা ইউনিয়নের বোরাঘাট নদীর পানি বাড়লে সূর্যপুর, সামিয়ানাপাড়া, মহাজনিকান্দক, আনচিংগি, বোয়ালমারাসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়। হালুয়াঘাট উপজেলার গাজিরভিটা ইউনিয়ন পরিরষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, ‘ইউনিয়নের মহাজনিকান্দক, আনচিংগি, বোয়ালমারা এলাকায় পানি বেশি। তবে সকালে পাহাড়ি ঢলে সীমান্তে সড়কের ওপর তিন ফুট পানি ছিল। এলাকার পুকুরের সব মাছ ভেসে গেছে।’ 

ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত শারমিন বলেন, ‘উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। বৃষ্টি বাড়লে পানি আরো বাড়তে পারে। বন্যাদুর্গতদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনা দেয়া আছে।’

হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. এরশাদুল আহমেদ বলেন, ‘পানি কিছুটা কমে গিয়েছিল। আজ আবারো প্রায় টানা ২ ঘণ্টা বৃষ্টি হওয়ায় পানি আবার বেড়ে গেছে। উপজেলায় চারটি ইউনিয়ন পুরোপুরি প্লাবিত হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য ১০ হাজার টন খাদ্যসহায়তা ঘোষণা করা হয়েছে। খাদ্যসহায়তা বিতরণ চলমান আছে।’

ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘মৎস্যচাষীদের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য এখনো আমাদের জানা নেই। উপজেলা মৎস্য অফিসারদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করে পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে।’

ময়মনসিংহ জেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, ধানের জমি প্লাবিত হয়েছে ১৫ হাজার ৪৩৮ হেক্টর। এর মধ্যে ডুবে গেছে ৯ হাজার ৭৮ হেক্টর, আংশিক ডুবেছে ৬ হাজার ৩৬০ হেক্টর এবং সবজি আংশিক প্লাবিত হয়েছে ১৫৮ হেক্টর। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে।

নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, তিনদিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জেলার প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ফের বন্যার আশঙ্কা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। জেলার কলমাকান্দায় উব্দাখালী নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমা ছুঁইছুঁই করছে। কংস নদের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এতে নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় নেত্রকোনার জারিয়া-জাঞ্জাইল পয়েন্টে ২০০ মিলিমিটার ও দুর্গাপুরে ১৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ বৃষ্টির ফলে জেলার সোমেশ্বরী, উব্দাখালী, কংস, ধনু ও মগড়া নদীর পানি বেড়ে চলেছে।

তিনি আরো জানান, গতকাল সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ উব্দাখালী নদীর পানি বেড়ে কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপৎসীমার দশমিক শূন্য ৩২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছে। কংশ নদের পানি বেড়ে জারিয়া-জাঞ্জাইল পয়েন্টে বিপৎসীমার দশমিক ৫৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছে। আজও বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় বিপৎসীমা ছাড়িয়ে তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়তে পারে। এছাড়া সোমেশ্বরীর পানি বেড়ে দুর্গাপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩ দশমিক ৩৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে ও হাওরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধনু নদের পানি বেড়ে খালিয়াজুরী পয়েন্টে বিপৎসীমার ২ দশমিক শূন্য ২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছে। 

নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, ‘অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হঠাৎ করে নদ-নদীর পানি বেড়েছে ঠিকই, তবে এখনো বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। খবর পেয়ে আমি দুর্গাপুর উপজেলার কাঁকরগড়া ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করেছি। স্থানীয়রা বলেছেন, বৃষ্টি না হলে পানি নেমে যাবে। কিছু নিচু এলাকার কিছু বাড়িঘরে পানি ঢুকেছে। তাদের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলা প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, গত জুন-জুলাইয়ে দুই দফায় নেত্রকোনার সাতটি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়।

আরও