প্রাথমিক শিক্ষকের বেতনে এশিয়ার অন্যতম সর্বনিম্ন বাংলাদেশ

লুক্সেমবার্গ, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এবং বেশি বেতনের চাকরিগুলোর একটি। আর বাংলাদেশে এদিক থেকে তা একেবারেই পেছনের সারিতে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনের পরিমাণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৫তম আর দক্ষিণ এশিয়ায় সপ্তম। এদেশের প্রাথমিকের

লুক্সেমবার্গ, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এবং বেশি বেতনের চাকরিগুলোর একটি। আর বাংলাদেশে এদিক থেকে তা একেবারেই পেছনের সারিতে। প্রাথমিক  বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনের পরিমাণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৫তম আর দক্ষিণ এশিয়ায় সপ্তম। এদেশের প্রাথমিকের শিক্ষকদের গড় বেতন ১৭০ ডলার ২ সেন্ট, যা দেশের মাথাপিছু গড় মাসিক আয়ের তুলনায় প্রায় ৬২ ডলার কম। 

বর্তমানে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে বেতন পান। এ গ্রেড অনুযায়ী তাদের মূল বেতন ১১ হাজার টাকা এবং বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ সর্বসাকল্যে পান সাড়ে ১৯ হাজার টাকার মতো। অথচ শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত হচ্ছে প্রাথমিক স্তর। বিশ্বব্যাংক ও ইউনেস্কোর মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো তাই প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের যোগ্যতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে সব সময় গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছে। 

শিক্ষকরা বলছেন বর্তমানে তাদের যে বেতন দেয়া হয় এ বেতনে সংসার চালানো অনেকটাই অসম্ভব এবং দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে অনেকেই দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। সাতক্ষীরার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তামান্না জাহান (ছদ্মনাম) বলেন, বাবা, মা এবং ছোট ভাই আমার ওপর নির্ভরশীল। গ্রামের স্কুল হওয়ায় আমার বেতন মাত্র ১৮ হাজার টাকা। এই টাকায় পুরো পরিবারের খরচ চালানো রীতিমত অসম্ভব। বিশেষত বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু সে অনুযায়ী বেতন বাড়েনি। সবকিছু সামলাতে গিয়ে গত কয়েকমাস ধরে নিয়মিতই ধার করে চলতে হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষকতা পেশা সামাজিক মর্যদায়ও পিছিয়ে আছে। আমরা যারা এ পেশায় আছি প্রতিনিয়তই আমরা আত্মীয় কিংবা পরিজনদের কাছ থেকে পরামর্শ পাই অন্য পেশায় যাওয়ার।

ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউর তথ্য অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনের দিক থেকে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে লুক্সেমবার্গ। ইউরোপের এ দেশটির প্রাথমিক শিক্ষকদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ৫ হাজার ৯৮৪ ডলার ৩০ সেন্ট। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জার্মানি। দেশটির প্রাথমিক শিক্ষকদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ৫ হাজার ৭৯৯ ডলার ৯১ সেন্ট। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা সুইজারল্যান্ডের শিক্ষকরা ন্যূনতম ৫ হাজার ৭৯ ডলার বেতন পেয়ে থাকেন।

এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে সিঙ্গাপুর। দেশটির সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষকদের গড় বেতন ৪ হাজার ২০৩ ডলার ২৫ সেন্ট। দেশটির ন্যাশনাল সেন্টার অন এডুকেশন অ্যান্ড দ্য ইকোনমির তথ্য অনুযায়ী শিক্ষকদের পাঁচ ধরনের বেতন কাঠামো রয়েছে, যেখানে মাসে ন্যূনতম বেতন ২ হাজার ৩৫৩ ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সৌদি আরবে শিক্ষকদের ন্যূনতম বেতন দেয়া হয় ৪ হাজার ১৬১ দশমিক ৮৩ ডলার। এছাড়া এশিয়ায় শীর্ষ আটে থাকা অন্য দেশগুলো হলো ওমান, কুয়েত, চীন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও দক্ষিণ কোরিয়া। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান এ মহাদেশের ৪৯টি দেশের মধ্যে ৪৫তম। বাংলাদেশের চেয়ে যে চারটি দেশ পিছিয়ে সেগুলোর সবই যুদ্ধবিধ্বস্ত। এর মধ্যে লেবাননে একসময় শিক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হতো এবং শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধার দিক থেকেও বেশ এগিয়ে ছিল। বর্তমানে দেশটিতে শিক্ষকদের গড় বেতন নেমে এসেছে মাত্র ১৯ ডলার ২৩ সেন্টে। এছাড়া লাওসে শিক্ষকদের গড় বেতন ১৪৩ ডলার ১৪ সেন্ট, ইয়েমেনে ৭৮ ডলার ৭৪ সেন্ট ও উজবেকিস্তানে ৭৮ ডলার ৭৪ সেন্ট। 

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে এ স্তরে যোগ্য শিক্ষক নিশ্চিত করা এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা বাড়ানো ও বেতন বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌দেশে শিক্ষার মান বাড়াতে শুধু বেতন বাড়ালেই হবে না, মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। আর মেধাবী শিক্ষকদের রাখতে হলে এ পেশার সামাজিক মর্যাদা, বেতনসহ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। যেমন আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে যাদের নিয়োগ দেয়া হয় তারা ক্যাডার সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত নন এবং অধিদপ্তরের দায়িত্বে যাওয়ার সুযোগ নেই। এমনটি হওয়া উচিত নয়। মালদ্বীপের দিকে তাকালে দেখা যাবে মন্ত্রী পর্যায় থেকে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সব পদেই রয়েছেন শিক্ষক। আমাদের দেশেও এমন সুযোগ থাকা উচিত।’

দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এ শিক্ষাবিদ আরো বলেন, ‘‌আমরা অনেকদিন ধরেই শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি করা হয়নি। শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো দ্রুত নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।’

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষকদের বেতন তুলনা করলে সবার পেছনে বাংলাদেশ। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বেতন পান মালদ্বীপের শিক্ষকরা। দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রাথমিকের শিক্ষকদের মাসিক গড় বেতন প্রায় ৯৫৩ ডলার ১৩ সেন্ট, যা বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ গুণ। এমনকি পাকিস্তানেও শিক্ষকদের গড় বেতন ২০৬ ডলার ৭ সেন্ট ও শ্রীলংকায় ২৫০ ডলার ৪৪ সেন্ট। ভারতে রাজ্য ও বিষয়ভেদে শিক্ষকদের বেতনের ভিন্নতা রয়েছে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বেতন কাঠামো নিয়ে তথ্য সংরক্ষণকারী সংস্থাগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভারতের শিক্ষকদের গড় মাসিক বেতন ২৮৪ ডলার ৬৪ সেন্ট। এছাড়া ভুটানে প্রাথমিকের শিক্ষকদের মাসিক গড় বেতন ৩৪১ ডলার ৭২ সেন্ট এবং নেপালে ৪৬৭ ডলার ৪৫ সেন্ট। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারেও শিক্ষকদের গড় বেতন ১৮৯ ডলার ২২ সেন্ট।

পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধিতে তুলনামূলক কম পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন ২০১০ সালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘দ্য ইমপ্যাক্ট অব দ্য সিক্সথ পে কমিশন অন টিচার স্যালারিস এসেসিং ইকুইটি অ্যান্ড এফিসিয়েন্সি ইফেক্টস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০০৪ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ছিল ৯০ ডলার ৪৯ সেন্ট এবং পশ্চিমবঙ্গে ছিল ১১১ ডলার ৮৪ সেন্ট। ২০০৯ সালে উত্তর প্রদেশে শিক্ষকদের বেতন প্রায় ১১৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২১৬ ডলার ৬৭ সেন্ট করা হয়। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গে ষষ্ঠ পে কমিশনের বেতন কাঠামো অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষকদের বর্তমান বেসিক বেতন ৩৪৭ ডলার ৯৬ সেন্ট। চীন, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়াসহ এশিয়ার অধিকাংশ দেশই প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রায় দ্বিগুণ করেছে বিগত কয়েক বছরে। 

প্রাথমিকের শিক্ষকরা বলছেন, দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় এখন অনেক মেধাবী শিক্ষক এলেও তাদের অনেকেই কম বেতন এবং সুযোগ-সুবিধার কারণে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। কেননা শিক্ষকদের বেতন দেয়া হয় তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর গ্রেডে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. মোস্তাফিজুর রহমান শাহিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শিক্ষকতা পেশায় সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র বিপরীত। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলাম, সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড ও প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড দেয়া হোক। এ নিয়ে আন্দোলনও করা হয়েছে। কিন্তু সরকার এখনো আমাদের দাবি বাস্তবায়ন করেনি। আমরা চাই সরকার যেন দ্রুত তা মেনে নেয় এবং সমাজে আমাদের একটি সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করে।’

আগের তুলনায় সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় সুযোগ বাড়িয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির মহাপরিচালক ফরিদ আহমেদ। যদিও প্রাথমিক শিক্ষকদের যে সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা এখনো পর্যাপ্ত নয় বলেও স্বীকার করেছেন তিনি। শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা আরো বাড়ানো জরুরি উল্লেখ করে ফরিদ আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষকতায় এলেও পরবর্তী সময়ে ব্যাংক, ক্যাডার সার্ভিসসহ বিভিন্ন চাকরিতে চলে যাচ্ছেন। যদি শিক্ষকতায়ও তারা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা পেতেন তাহলে এমনটি হতো না। আশা করি সরকার প্রাথমিক শিক্ষকদের সুযোগ আরো বৃদ্ধি করবে।’

ভবিষ্যতে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা আরো বৃদ্ধি করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য এসএম শাহজাদা। বণিক বার্তাকে এ সংসদ সদস্য বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থা আগে খুবই খারাপ ছিল, গত কয়েক বছরে তাদের বেতনসহ সুযোগ-সুবিধা বেশ বাড়ানো হয়েছে। সরকার প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে অত্যন্ত আন্তরিক এবং এ বিষয়ে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।’

আরও