আলু পেঁয়াজের সিংহভাগ মজুদ কয়েক জেলায়

দেশে আলু ও পেঁয়াজ উৎপাদন চাহিদার চেয়ে বেশি হলেও কয়েক মাস ধরে অস্থিতিশীল রয়েছে পণ্য দুটির বাজার। উৎপাদন মৌসুমে দাম কম থাকলেও এর পরে দাম বেড়েছে দুই-তিন গুণ। বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সম্প্রতি পণ্য দুটির সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যদিও নির্ধারিত দামে কোথাও বিক্রি হচ্ছে না। মূলত মজুদ পর্যায়ে আলু ও পেঁয়াজের কারসাজি হয়

দেশে আলু ও পেঁয়াজ উৎপাদন চাহিদার চেয়ে বেশি হলেও কয়েক মাস ধরে অস্থিতিশীল রয়েছে পণ্য দুটির বাজার। উৎপাদন মৌসুমে দাম কম থাকলেও এর পরে দাম বেড়েছে দুই-তিন গুণ। বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সম্প্রতি পণ্য দুটির সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যদিও নির্ধারিত দামে কোথাও বিক্রি হচ্ছে না। মূলত মজুদ পর্যায়ে আলু ও পেঁয়াজের কারসাজি হয় বলে বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দুটি পণ্যেরই মজুদ এখন হাতে গোনা কয়েক জেলায় কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। 

মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মজুদকৃত আলুর মোট মজুদের প্রায় ৭৮ শতাংশই রয়েছে রংপুর, রাজশাহী, মুন্সিগঞ্জ, বগুড়া, জয়পুরহাট ও ঠাকুরগাঁও—এ ছয় জেলায়। আর পেঁয়াজের মোট মজুদের প্রায় ৭৬ শতাংশ রয়েছে পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, রাজশাহী, ঝিনাইদহ ও নাটোরে। 

আলু ও পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে গত বৃহস্পতিবার খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর সর্বোচ্চ মূল্য ৩৫-৩৬ টাকা এবং দেশী পেঁয়াজের মূল্য ৬৪-৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে দেশের কোথাও এ দামে পণ্য দুটি বিক্রি করছেন না ব্যবসায়ীরা। বাজারে এখন প্রতি কেজি দেশী পেঁয়াজ ৭৫-৯০ টাকা ও আলু ৪৮-৫৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, হিমাগার পয়েন্ট বা মজুদদারদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হওয়ায় তারা সরকার নির্ধারিত মূল্যে পণ্য দুটি বিক্রি করতে পারছেন না। 

কৃষি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদন মৌসুমে আলু ও পেঁয়াজের পর্যাপ্ত দাম পান না কৃষকরা। কিন্তু পরে কৃষকের হাতে যখন পণ্য দুটি থাকে না, তখন মজুদদাররা পণ্য দুটির বাজারকে অস্থিতিশীল করে দিচ্ছেন। সম্প্রতি সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বাজারের খুচরা দোকানগুলোয় অভিযান শুরু করলেও এখন প্রয়োজন পড়েছে হিমাগার বা মজুদ পর্যায়ে দাম নিয়ন্ত্রণের। অন্যথায় সরকারের মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত অকার্যকরই রয়ে যাবে। 

সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আলুর ক্ষেত্রে আমাদের উৎপাদন চাহিদার চেয়ে বেশি। এখানে বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার কোনো কারণ নেই। শুধু সিন্ডিকেশনের কারণে আলুর দাম বেড়েছে। খুচরা বাজারে অভিযান পরিচালনা করে আসলে কোনো লাভ নেই। কারণ তারা সিন্ডিকেশন করছে না। সিন্ডিকেশন হচ্ছে হিমাগার পর্যায়ে। মূল জায়গায় তদারকি বাড়াতে হবে। তা না হলে কোনো সুফল আসবে না। আর পেঁয়াজের ক্ষেত্রে কিছুটা আমদানি করতে হয়। সংকট আছে। কিন্তু তবুও একটি পক্ষ বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের চিহ্নিত করতে হবে। হিমাগার মালিক, আড়তদার ও মজুদদারদের তদারকি করতে হবে।’ 

দেশে আলুর চাহিদা প্রায় ৭০-৭৫ লাখ টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ১ কোটি ৪ লাখ ৩১ হাজার টন আলু উৎপাদন হয়। এর মধ্যে বীজ ও উৎপাদন-পরবর্তী অপচয় হয় প্রায় ২৫ শতাংশ। সে অনুযায়ী দেশে আলুর মজুদ উদ্বৃত্ত থাকার কথা। আবার হিমাগারগুলোয়ও মজুদ রয়েছে পর্যাপ্ত। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলার হিমাগারগুলোয় আলুদ মজুদ ছিল ১৫ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬ টন। 

আলু উৎপাদনে দেশের অন্যতম শীর্ষ জেলা বগুড়া। গত মৌসুমে জেলায় ১২ লাখ ২৪ হাজার টন আলু উৎপাদন হয়েছে। আলু সংরক্ষণের জন্য এখানে ৩৭টি হিমাগার রয়েছে। এসব হিমাগারে এখন প্রায় ২ লাখ ২ হাজার ১০০ টন আলু মজুদ রয়েছে, যা দেশের মোট মজুদের ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কয়েকদিন ধরে জেলাটির হিমাগার পয়েন্টে লাল জাতের পাকড়ি আলু ৪৭-৪৮ টাকা এবং অ্যাস্টেরিক্স জাতের আলু ৩৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। জেলার বাজারে এখন পাকড়ি আলু ৫৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। 

বগুড়া জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সজিব মিয়া জানান, অতিরিক্ত মুনাফায় আলু বিক্রি যেখানে করা হচ্ছে সেখানেই ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করছেন। কোল্ড স্টোরেজে ৬০ কেজি আলুর এক বস্তার ক্রয়মূল্য ছিল ৯৫০ টাকা, বস্তাপ্রতি হিমাগার ভাড়া ৩২০ টাকা, লোডিং-আনলোডিং চার্জ ২০ টাকা, পরিবহন খরচ ৩০ টাকা, অন্যান্য খরচ ৩০ টাকাসহ প্রতি বস্তা আলুর মোট খরচ ১ হাজার ৩৫০ টাকা, যা ২৫ শতাংশ লাভসহ বিক্রয়মূল্য হওয়ার কথা ১ হাজার ৬৮৭ টাকা (প্রতি কেজি ২৮ টাকা ১১ পয়সা দরে) কিন্তু তারা বস্তাপ্রতি বিক্রি করছেন ২ হাজার ২৫০ টাকায় (কেজি ৩৭ টাকা ৫ পয়সায়), যা নিয়মের বাইরে। এভাবে অতিরিক্ত মূল্যে আলু বিক্রি না করার ব্যাপারে সতর্ক করাও হচ্ছে।

এ পরিস্থিতির জন্য এখন মজুদদারদেরই দায়ী করছেন বগুড়া শহরের আলু ব্যবসায়ীরা। রাজাবাজারের সোবহান নামে এক খুচরা বিক্রেতা জানান, খুচরা বাজারে দাম কমানো ও বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কোল্ড স্টোরেজ থেকেই বেশি দামে ক্রয় করতে হচ্ছে। সেখান থেকে পরিবহন খরচ, খাজনা, শ্রমিক খরচ মিলিয়ে কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা বেড়ে যায়। এ কারণে পাইকারি ও খুচরা বাজারে ৪-৫ টাকা কেজিতে বাড়ছে কোল্ড স্টোরেজের তুলনায়।

মজুদদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দায়ী করছেন স্থানীয় কৃষকরাও। তারা জানান, গত উৎপাদন মৌসুম শেষে এখানে আলু উত্তোলনের পর শুরুতে বিক্রি হয়েছে ৮ থেকে ১২ টাকা কেজি। এসব কোল্ড স্টোরেজে যারা আলু মজুদ করেছেন, তাদের বেশির ভাগই আলু কিনেছেন ১২ টাকা কেজি। সে আলু এখন ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে ৫৫ টাকা কেজি দরে। 

বগুড়া সদরের কৃষক আহসানুল কবির বলেন, ‘‌মজুদদাররা আলুর দাম বাড়িয়ে লাভবান হচ্ছেন। আর লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। চাষীরা এখানে কোনোভাবেই লাভবান নন। আলুর বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে কৃষক ও ভোক্তা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’

বগুড়া কোল্ড স্টোরেজ মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ পরিমল প্রসাদ রাজ বলেন, ‘‌কোল্ড স্টোরেজের মালিকরা শুধু ভাড়া পেয়ে থাকেন। যারা আলু রাখে তারাই বিক্রি করে। এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই।’

শীর্ষ আলু উৎপাদনকারী জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম আরেক জেলা রংপুর। জেলাটিতে গত অর্থবছরে ১১ লাখ ৯৩ হাজার ৭৯৬ টন আলু উৎপাদন হয়। এখানে কোল্ড স্টোরেজ আছে ৩৯টি, যেগুলোর ধারণক্ষমতা ৪ লাখ ৬ হাজার ৩১৫ টন। চলতি মৌসুমের শুরুতে এখানে মজুদ ছিল ৩ লাখ ৪৩ হাজার টন। তবে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখানকার হিমাগারে আলু মজুদ আছে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ১১৭ টন, যা দেশের মোট মজুদের প্রায় ২১ শতাংশ। 

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, রংপুরের কোল্ড স্টোরেজগুলোয় বর্তমানে আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩৬ টাকা ৫০ পয়সায়। পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। 

অভিযানের কারণে মুন্সিগঞ্জের হিমাগারগুলো থেকে আলু বিক্রি এখন বন্ধ। জেলার ৬৮টি কোল্ড স্টোরেজের ধারণক্ষমতা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টন। এর মধ্যে সচল রয়েছে ৬৩টি। এসব হিমাগারে ২ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৩ টন মজুদ রয়েছে। জেলাটির হিমাগার পয়েন্টে সম্প্রতি প্রতি কেজি আলু ৩৫-৩৬ টাকা বিক্রি হলেও বর্তমানে সরকারি অভিযানের কারণে আলু বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। 

এছাড়া রাজশাহীতে ২ লাখ ৮০ হাজার ৮৯০ টন, মুন্সিগঞ্জে ২ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৩ টন, জয়পুরহাটে ৮০ হাজার ২৯৮ টন এবং ঠাকুরগাঁও জেলায় ৭৯ হাজার ৪৭৯ টন আলুর মজুদ রয়েছে। 

আলুর বাজারেরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এখন পেঁয়াজের বাজারেও। দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৮ লাখ টন। যদিও গত অর্থবছরে দেশে কৃষিপণ্যটি উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার টন। টানা কয়েক মাসের অস্থিতিশীলতার পর জুনে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। এরপর দাম কিছুটা স্থির হলেও কমেনি। দেশে বর্তমানে পেঁয়াজের মজুদ রয়েছে ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৫৩৯ টন। 

পেঁয়াজের মজুদও এখন কয়েকটি নির্দিষ্ট জেলাকেন্দ্রিক। এর মধ্যে পাবনা জেলায় ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মজুদ ছিল ৭৪ হাজার ৯০ টন। গতকাল তা আরো কমে দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ৬০ টন। বর্তমানে জেলাটিতে প্রতি কেজি পেঁয়াজ পাইকারিতে ৬২-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরায় মানভেদে ৭০-৮০ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে। 

জেলাটিতে এখন প্রশাসনের নেতৃত্বে বাজারে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। এ বিষয়ে পাবনার জেলা প্রশাসক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘‌আজ আমরা অভিযান চালিয়েছি। তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করতে ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানিয়েছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

বর্তমান পাবনা ছাড়াও ফরিদপুরে ৭২ হাজার ২২৫ টন, রাজবাড়ীতে ৪২ হাজার ৬০০ টন, রাজশাহীতে ৪০ হাজার ৩৭১ টন এবং নাটোরে ২০ হাজার ৮৩৫ টন পেঁয়াজ মজুদ রয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমি নিজেই বিভিন্ন জেলার হিমাগারগুলোয় যাচ্ছি। শক্তভাবে মনিটরিং করছি। হিমাগার পর্যায়ে আলু ২৭ টাকায় বিক্রি করতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনও অভিযান অব্যাহত রাখবে।’ 

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার বগুড়া প্রতিনিধি এইচ আলিম, পাবনা প্রতিনিধি শফিউল আলম দুলাল, রংপুর প্রতিনিধি এসএম পিয়াল ও মুন্সিগঞ্জ প্রতিনিধি শুভ ঘোষ)

আরও