বিএসএফএমএসটিইউ

সাত বছরেও পায়নি পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাস, অস্থায়ী ভবনেই ক্লাস-পরীক্ষা

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএফএমএসটিইউ) যাত্রা শুরু ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর। সাত বছরে পা দেয়া এ বিদ্যাপীঠে এখনো অবকাঠামো নির্মাণের কাজই শুরু হয়নি। বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে অস্থায়ী ভবনে। ফলে পর্যাপ্ত শ্রেণীকক্ষ ও ল্যাবের অভাবে প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া প্রতিটি বিভাগে ন্যূনতম একজন অধ্যাপক থাকার

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএফএমএসটিইউ) যাত্রা শুরু ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর। সাত বছরে পা দেয়া এ বিদ্যাপীঠে এখনো অবকাঠামো নির্মাণের কাজই শুরু হয়নি। বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে অস্থায়ী ভবনে। ফলে পর্যাপ্ত শ্রেণীকক্ষ ও ল্যাবের অভাবে প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া প্রতিটি বিভাগে ন্যূনতম একজন অধ্যাপক থাকার নিয়ম থাকলেও তা নেই। এমনকি সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদারও কেউ নেই এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।  

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর এক বিশেষ আদেশবলে বিএসএফএমএসটিইউয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ হিসেবে আত্তীকরণ হয়  জামালপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজ। এর পর থেকে কলেজ ভবনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কলেজের ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস ব্যবহার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবন হিসেবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম চলে এক অস্থায়ী ভবনে, যেটি নির্মাণ হয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) ঋণে। এ ভবনে কক্ষ রয়েছে ৫০টি। এসব কক্ষই সাতটি বিভাগের শ্রেণীকক্ষ, ল্যাব, লাইব্রেরি ও শিক্ষকদের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। 

শিক্ষার্থীরা জানান, কোনো বিভাগের জন্যই নির্ধারিত শ্রেণীকক্ষ নেই। ফলে শ্রেণীকক্ষ নিয়ে প্রায়ই জটিলতায় পড়তে হয়। অনেক সময় শ্রেণীকক্ষের জন্য শিক্ষার্থীদের কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। অনেক ক্লাস স্থগিতও হয়। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখানে আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপযোগী পরিবেশ নেই। শিক্ষক, শ্রেণীকক্ষ, ল্যাব, আবাসন—কিছুই পর্যাপ্ত নেই। কোনোমতে কার্যক্রম চলছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষদ আছে ছয়টি। শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৮০০। ফিশারিজ ছাড়া কোনো বিভাগেই পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, সব মিলিয়ে শিক্ষক আছেন ৪৪ জন। এর মধ্যে গণিত বিভাগে চারজন, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ছয়, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তিন, ব্যবস্থাপনা বিভাগে ছয়, সমাজকর্ম বিভাগে সাত, ফিশারিজে ১৫ ও ভূতত্ত্ব বিভাগে তিনজন শিক্ষক রয়েছেন। সহকারী অধ্যাপকের সংখ্যা ২৯; বাকি ১৫ জন প্রভাষক। 

শিক্ষাবিদরা বলছেন, সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করলে তা শিক্ষার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম বলেন, ‘উচ্চ শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। একটি দেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ তৈরি হয় উচ্চ শিক্ষিত জনবলের চাহিদা বিবেচনা করে। আর প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে গত কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগই ছিল অপরিকল্পিত; রাজনৈতিক বিবেচনাও কাজ করেছে। ফলে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করেই প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং এতে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

ড. আব্দুস সালাম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা ও গবেষণার ক্ষেত্রে অধ্যাপকদের ভূমিকা অনেক বেশি থাকে। তারা অভিজ্ঞতার আলোকে প্রতিষ্ঠানকে সামনে এগিয়ে নিতে পারেন। বিশেষ করে গবেষণা ক্ষেত্রে অধ্যাপক ছাড়া এগোনো সম্ভব নয়। ফলে আমাদের দেশে এখন যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, তাতে উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।’

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাপরিকল্পনা (মাস্টারপ্ল্যান) অনুযায়ী ৫০০ একর জমিতে ক্যাম্পাস নির্মাণ হওয়ার কথা। কিন্তু এখনো কোনো ভূমি অধিগ্রহণ হয়নি। পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধা না থাকায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে থাকতে হয় ভাড়া বাসায়। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২৮ ছাত্র ও ১৩০ ছাত্রী আবাসন সুবিধা পান, যা মোট শিক্ষার্থীর এক-তৃতীয়াংশ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় প্রশাসনকে অবকাঠামো নির্মাণের ব্যাপারে একাধিকবার উদ্যোগ নিতে দেখেছি। একবার প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি করে জমা দেয়াও হয়েছিল। তবে জমি অধিগ্রহণসহ আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতায় শেষ পর্যন্ত অনুমোদন পায়নি।’

এ কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘বর্তমান ক্যাম্পাসের আয়তন মাত্র ১৫ একর। কিন্তু পরিকল্পনা রয়েছে ৫০০ একরের ক্যাম্পাস নির্মাণের। এতে আশপাশের অনেক জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। অধিগ্রহণের ব্যাপারে কারো কারো আপত্তি রয়েছে। তারা চান না ৫০০ একরজুড়ে ক্যাম্পাস হোক। এ ধরনের নানা জটিলতায় অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্প পাস হচ্ছে না।’

এসব বিষয়ে বিএসএফএমএসটিইউর কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একবার ডিপিপি জমা দেয়া হলেও অনুমোদন পায়নি। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করে ডিপিপি জমা দেয়ায় ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এখন সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এবং প্রকল্পের ডিপিপি একনেকে অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। প্রকল্পের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’

পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু সংকট রয়েছে, তবে কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে। অবকাঠামোগত দিক থেকে যেসব সংকট রয়েছে, সেগুলো প্রকল্পের কাজ শুরু হলে কেটে যাবে।’

অধ্যাপক না থাকার বিষয়ে কোষাধ্যক্ষ বলেন, ‘অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলেও বেশির ভাগ সময় কাউকে পাওয়া যায় না। কারণ অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তারা আসতে চান না। তবে আমাদের কয়েকজন শিক্ষক এরই মধ্যে সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।’

ইউজিসির সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ‘কভিড মহামারীর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রকল্প কিছুটা পিছিয়ে গেছে। তবে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দিতে বলেছি। গত বছর বিএসএফএমএসটিইউ পাঁচটি বিভাগের অনুমোদন চেয়েছিল। কিন্তু ইউজিসি অনুমোদন দেয়নি। ডিপিপি অনুমোদন ও প্রকল্পের কাজ না হওয়া পর্যন্ত নতুন বিভাগের অনুমতি দেয়া হবে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে সম্প্রতি ইউজিসির পক্ষ থেকে একটি নিয়ম করা হয়েছে। আগে অবকাঠামো তৈরি হবে, পরে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে এ নিয়ম কঠোরভাবে প্রতিপালন করা হবে।’

আরও