পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সাড়ে তিন মাসের মাথায় এশিয়ান হাইওয়ে নড়াইলের কালনা এলাকায় দেশের প্রথম ছয় লেনের মধুমতী সেতু চালু হয়। এর পরই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা নড়াইলে শিল্পায়নের ছোঁয়া লেগেছে। সেতু দুটি চালু হওয়ায় রাজধানী ঢাকার সঙ্গে নড়াইলের দূরত্ব কমে যাওয়ায় যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সময় এবং খরচ সাশ্রয় হচ্ছে। ফলে
ব্যবসায়ীরা এ জেলায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে শুরু করেছেন। এতে হাইওয়ের পাশে জমির দাম বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। এদিকে সরকারিভাবে ভাঙ্গা-নড়াইল-বেনাপোল সড়কের পাশে কালনা পয়েন্টে ৩০০ একর জমি নিয়ে ইকোনমিক্যাল জোন ও নড়াইল শহরে সাড়ে ৩০০ একর জমি নিয়ে বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সব মিলিয়ে বদলে যাচ্ছে নড়াইলের চালচিত্র।
গত বছরের পর ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ১০ অক্টোবর নড়াইলের কালনা পয়েন্টে মধুমতী সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতু দুটি উদ্বোধনের পরই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রার মান বদলে যেতে শুরু করেছে। বিশেষ করে নড়াইলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব কমেছে কোথাও ১০০ কিলোমিটার, কোথাও ২০০ কিলোমিটার। বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে মধুমতী সেতু পার হয়ে ঢাকা যেতে সময় লাগছে মাত্র পাঁচ-ছয় ঘণ্টা। আর নড়াইল থেকে ঢাকা যেতে সময় লাগছে মাত্র দুই-তিন ঘণ্টা। এদিকে এশিয়ান হাইওয়ের অংশ ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল সড়কের নড়াইল অংশে নামিদামি কোম্পানি শিল্পপ্রতিষ্ঠান করার জন্য জমি কিনতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট শিল্প-কলকারখানা। এর প্রভাবে সড়কের পাশে জমির দাম বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। তবে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে, এ জেলায় গ্যাস সংযোগ চালু করার।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও বিসিক সূত্রে জানা গেছে, ভাঙ্গা-নড়াইল-বেনাপোল সড়কের পাশে কালনা পয়েন্টে মধুমতী সেতুর পাশে কালনা ও মশিয়াপাড়া মৌজায় ৩০০ একর জমি নিয়ে ইকোনমিক্যাল জোন করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এরই মধ্যে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া একই সড়কের পাশে নড়াইল শহরের অংশে উজিরপুর মৌজায় সাড়ে ৩০০ একর জমি নিয়ে বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে কৃষিনির্ভর জেলা নড়াইলে শিল্প উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নড়াইল-যশোর সড়কের দূর্বাজুড়ি এলাকায় হাইওয়ের পাশে কিষান ফিশফিল্ড নামে একটি বড় কারখানা চালু হয়েছে। এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে স্থানীয় দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ। বসুপটি এলাকায় চিত্রা বয়লার ফিড নামে একটি কারখানা চালু হয়েছে কয়েক মাস আগে। কারখানাটিতে প্রতিদিন উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ১০০ টন। এখানে কাজের সুযোগ পেয়েছে স্থানীয় শতাধিক নারী-পুরুষ। নড়াইলের সিতারামপুর এলাকায় সড়কের পাশে বেঙ্গল গ্রুপ প্রায় ২০ একর জমি কিনে রেখেছে। এছাড়া কয়েকটি স্থানে জমি কিনে বালি ভরাট করছে বিভিন্ন কোম্পানি।
স্থানীয়রা জানান, হাইওয়ের পাশে বিভিন্ন কোম্পানির কর্মকর্তারা জমি কেনার জন্য প্রতিনিয়তই ঘোরাফেরা করছেন। গত দুই বছরে এ হাইওয়ের পাশের জমির দাম বেড়ে গেছে কয়েক গুণ।
দত্তপাড়া গ্রামের শাহিন বারী জানান, এ সড়কের পাশে তার নিজের জমি রয়েছে। তার কাছে জমি কেনার জন্য প্রতিনিয়ত মানুষ আসে। একই এলাকার বাসিন্দা তরিকুল মিয়া জানান, দুই বছর আগে রাস্তার পাশে এক শতক জমির দাম ছিল ২৫-৩০ হাজার টাকা, বর্তমানে সে জমির দাম কয়েক গুণ বেড়ে হয়েছে দেড় লাখ টাকার বেশি।
নড়াইল দলিল লেখক সমিতির নেতা কাজী আনিস বলেন, ‘বছর দুয়েক হলো এ হাইওয়ের দুই পাশের জমি আগের তুলনায় বেশি কেনাবেচা হচ্ছে। দিন যাচ্ছে আর এ এলাকার জমির দাম বাড়ছে। দুই বছর আগে থেকে বর্তমানে জমির দাম পাঁচ-সাত গুণ বেড়ে গেছে।’
কিষান অ্যাকুমুলেটরস লিমিটেডের কর্মকর্তা শিল্পী পরশ জানান, এ সেতুর মাধ্যমে ভৌগোলিকভাবে নড়াইলের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। সেজন্য নড়াইলে কয়েকটি শিল্প-কলকারখানা স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। পরিবেশবান্ধব ব্যাটারি রিসাইকেল প্লান্ট ‘কিষান অ্যাকুমুলেটরস লিমিটেড’
ও ‘কিষান ফিশফিল্ড’
নামে দুটি কারখানা চালু করা হয়েছে। কারখানা দুটিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে স্থানীয় প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষের।
নড়াইল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হাসানউজ্জামান বলেন, ‘পদ্মা ও মধুমতী সেতু সড়ক
যোগাযোগের ক্ষেত্রে শুধু জাতীয় ক্ষেত্রেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে। ভারত, কলকাতা, আসামসহ দেশের মধ্যে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর, বেনাপোল ও নোয়াপাড়া নদীবন্দরের মধ্যে যোগাযোগের মাইলফলক রচিত হয়েছে। এর ফলে এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করেছে।’
বিসিক নড়াইল জেলা
কার্যালয়ের উপব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সোলায়মান হোসেন বলেন, ‘পদ্মা ও মধুমতী সেতু চালু হওয়ায় এ জেলার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। সেই বিষয়টি বিবেচনা করে নড়াইলে বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার জন্য কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে চলছে। বিসিক প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলছে। দ্রুত বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তোলা হবে।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পদ্মা ও মধুমতী সেতুর ফলে নড়াইল জেলার মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। ভৌগোলিকভাবে এ জেলার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। সে বিষয়টি মাথায় রেখে ভাঙ্গা-নড়াইল-বেনাপোল সড়কের পাশে কালনা এলাকায় ৩০০ একর জমি নিয়ে ইকোনমিক্যাল জোন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। একই সড়কের পাশে নড়াইল শহরের অংশে উজিরপুর মৌজায় সাড়ে ৩০০ একর জমি নিয়ে বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।