বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত তিন জেলার ২ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ

বৃষ্টি কমে আসায় জেলাগুলোয় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে ভেসে উঠছে বন্যার ক্ষতচিহ্ন।

কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ময়মনসিংহ, শেরপুর ও নেত্রকোনায় সৃষ্ট বন্যায় এ পর্যন্ত ২ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানিতে এখন পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আটজন শেরপুরের এবং দুজন ময়মনসিংহ জেলার বাসিন্দা ছিল। দেশের সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বিকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।

এ সময় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আলী রেজা জানান, এবারের বন্যায় শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনার ১৩টি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭৩টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা। মোট ৬৩ হাজার ১৭১টি পরিবার বন্যার কারণে পানিবন্দি হয়ে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ২ লাখ ৩৮ হাজার ৩৯১।

মো. আলী রেজা জানান, পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে আশ্রয় দিতে মোট ১৪০টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে ১ হাজার ৩৩৭ জন আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই পেয়েছে ৫৬১টি গবাদি পশু। তিন জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে ২০টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।

বৃষ্টি কমে আসায় জেলাগুলোয় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে ভেসে উঠছে বন্যার ক্ষতচিহ্ন। মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি আমন ফসল ও মৎস্যসম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে।

শেরপুর জেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এবারের বন্যায় জেলার পৌনে দুই লাখ কৃষকের প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এছাড়া তিন হাজার মাছের ঘের ভেসে গিয়ে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। বন্যার কারণে জেলার ২৪২টি প্রাথমিক ও ৮৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা দিয়েছে প্রশাসন।

জেলা খামারবাড়ির উপপরিচালক ড. সুকল্প দাস বলেন, ‘বন্যার পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিরূপণ সম্ভব হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করে তাদের সার-বীজ দেয়া হবে। এছাড়া কৃষকদের প্রণোদনা দেয়ার বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে জানানো হবে।’

নেত্রকোনার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, পূর্বধলা, বারহাট্টা ও সদরের প্রায় দেড় হাজার মাছচাষীর স্বপ্ন বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় জানিয়েছে, বন্যায় নেত্রকোনার পাঁচ উপজেলায় মৎস্যসম্পদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ৩১২ দশমিক ৫৯ হেক্টর জমির অন্তত ১ হাজার ৪৮০টি পুকুর এবং খামারের ৭২৩ দশমিক ৪৩ টন মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। এ কারণে ৮৯৬ জন মাছচাষী প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ২৪ লাখ ৬৫ হাজার ৩২০ টাকায়। এছাড়া ভৌত অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে আরো ১ কোটি ২১ লাখ টাকা। তবে চাষীদের দাবি, মৎস্যসম্পদের মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০ কোটি টাকার বেশি।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহজাহান কবির বলেন, ‘আকস্মিক বন্যায় মৎস্যসম্পদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তথ্য নিয়ে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় আট কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ চাওয়া হবে।’

এদিকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলায় বন্যার পানি ধীরগতিতে নামছে। নতুন করে কোনো এলাকা প্লাবিত হয়নি। এসব এলাকায় এক লাখের বেশি মানুষ এখনো পানিবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন।

ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যা দুর্গতদের সহযোগিতা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে। পানি নেমে গেলে ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।’ অন্যদিকে হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরশাদুল আহমেদ জানান, হালুয়াঘাটে ১৮ হাজার পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাময়িকভাবে তাদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষতি নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন পাঠানো হবে।

বাংলাদেশের উজানে পাহাড়ি ঢলে আগস্টের মাঝামাঝিতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার পর সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে টানা ভারি বৃষ্টিতে রংপুর, নীলফামারীসহ উত্তরের নিম্নাঞ্চলে বন্যা হয়েছে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহজুড়ে এমন বৃষ্টিপাতে নদীর পানি বেড়ে ময়মনসিংহ বিভাগের তিন জেলায় বন্যা শুরু হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বুধবার বলেছে, ময়মনসিংহ বিভাগের জিঞ্জিরাম, ভুগাই-কংস ও সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইলেও পানির সমতল এখন হ্রাস পাচ্ছে। আগামী তিনদিন ময়মনসিংহ বিভাগ ও তৎসংলগ্ন উজানে অতিভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম থাকায় এ সময়ে ওই তিন নদীর পানি আরো কমবে এবং নেত্রকোনা জেলার সোমেশ্বরী ও জামালপুর জেলার জিঞ্জিরাম নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে ধারণা করছে পূর্বাভাস কেন্দ্র।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন বণিক বার্তার ময়মনসিংহ প্রতিনিধি

আরও