ময়মনসিংহে বন্যার অবনতি নতুন করে প্লাবিত ৫০ গ্রাম শেরপুরে উন্নতি

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। এসব অঞ্চলে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে আরো ৫০টি গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে তিন উপজেলার ২৩টি ইউনিয়নের প্রায় দেড় লাখ মানুষ। তবে শেরপুরের বন্যাকবলিত পাঁচ উপজেলা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। যদিও এখনো পানিবন্দি রয়েছে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। দুর্গত এলাকাগুলোয় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট। রোববার রাতে নকলায় পানিতে ডুবে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে শেরপুরে বন্যায় আটজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নেত্রকোনায় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় নদ-নদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা উন্নতি হয়েছে বন্যা পরিস্থিতির। তবে এখনো অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছে সেখানে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, শেরপুর ও ময়মনসিংহ জেলার ভোগাই নদের আশপাশের নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। বর্তমানে নেত্রকোনার সোমেশ্বরী নদী কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া জামালপুরের জিঞ্জিরাম নদী গোয়ালকান্দা পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে। জিঞ্জিরাম ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়ছে। তবে ভোগাই ও সোমেশ্বরী নদীর পানি কমছে এবং কংস নদের পানি স্থিতিশীল রয়েছে। আগামী তিনদিন ময়মনসিংহ বিভাগ ও উজানে অতি ভারি বৃষ্টি হতে পারে। তবে এ সময়ে ভোগাই নদের পানি কমতে পারে এবং শেরপুর ও ময়মনসিংহের নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলায় পানি কিছুটা কমলেও ফুলপুরের তিনটিসহ ১০টি ইউনিয়নে নতুন করে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনী ও দু-একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে কাজ করছে। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম না থাকায় সেখানে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন বিভাগ।

হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. এরশাদুল আহমেদ বলেন, ‘হালুয়াঘাটে সেনাবাহিনীও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে আমরা যে বরাদ্দ পেয়েছি তা দ্রুত পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছি। হালুয়াঘাটের ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার মধ্যে ছয়টি ইউনিয়নের পানি কমছে। অন্য ছয়টিতে অপরিবর্তিত রয়েছে।’

হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলার সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় নারী-শিশুসহ কয়েক হাজার পরিবার অবস্থান করছে। তবে সেখানে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে।

হালুয়াঘাটের মকিমপুর নগুয়া কান্দাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার ৭০ বছর বয়সে এমন বন্যা দেখিনি। আমাদের এলাকায় নৌকার ব্যবস্থা নেই। জীবনে এত পানি আসেনি। কলার ভেলা বানিয়ে এক আত্মীয়র বাড়িতে এসে উঠেছি। আমার ঘরে বুকসমান পানি। গরুগুলো বাঁচিয়ে আনতে পারলেও খাবার দিতে পারছি না। এখানে প্রায় ৬০টি পরিবার রয়েছে। সবার ঘরে পানি উঠেছে। অনেকের রান্না করার ব্যবস্থা নেই। অনেকে নৌকার অভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারছে না। ত্রাণ নিয়ে আমার এলাকায় এখন পর্যন্ত কেউ আসেনি। এভাবে চলতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে।’

বন্যাদুর্গতরা জানান, নিতাই, দর্শা, গাঙ্গিনা, লালা, কংসসহ বেশকিছু নদ-নদী উপচে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। এসব অঞ্চলের জমির ফসল পানির নিচে রয়েছে। ডুবে গেছে মাছের ঘের।

ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত শারমীন জানান, উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে চারটিতে পানি কমেছে। প্রায় ১০ হাজার পরিবার এখনো পানিবন্দি।

ফুলপুরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৭ হাজার পরিবার। পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এখনো পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি। নতুন করে সিংহেশ্বর, ছনধরা ও সদর ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম আরিফুল ইসলাম।

সার্বিক বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সানোয়ার হোসেন জানান, জেলায় ৬৩ টন চাল, ৭ লাখ টাকা ও দুই হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার দেয়া হয়েছে। আজ থেকে বন্যা পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হতে পারে।

শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার ভোগাই নদের পানি ১৩৮ সেন্টিমিটার, চেল্লাখালী নদীর পানি ৭৭ ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ৫৪০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া অন্য দুটি পাহাড়ি নদী মহারশী ও সোমেশ্বরীর পানি বিপৎসীমার নিচে রয়েছে। তবে পানি বেড়েছে দশানী ও মিরগী নদীতে।

বন্যাদুর্গতরা জানান, খাদ্য ও সুপেয় পানি সংকট দেখা দিয়েছে। যদিও সেনাবাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবীরা তাদের সহযোগিতা করছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে সড়কে স্পষ্ট হচ্ছে বন্যার ক্ষত। ঝিনাইগাতী-ফাকরাবাদ সড়কের বিভিন্ন অংশ ভেঙে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে মেরামত করায় কিছু কিছু এলাকায় যান চলাচল শুরু হয়েছে।

শেরপুর জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা সব জায়গায় ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করছি। এ কাজে সেনাবাহিনী সার্বিক তৎপরতা চালাচ্ছে ও সহযোগিতা করছে। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ব্যবসায়ীসহ সবাই এগিয়ে এসেছেন। সবাই মিলে আমরা দুর্যোগ মোকাবেলা করতে সক্ষম হব।’

নতুন করে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় নেত্রকোনায় নদ-নদীর পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে চারটি উপজেলায় এখনো অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। বন্যাকবলিত মানুষের জন্য খোলা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র। বিতরণ করা হচ্ছে ত্রাণসামগ্রী। বন্ধ রয়েছে ১৮৬টি সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সোমেশ্বরী নদীর পানি দুর্গাপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তবে উব্দাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার দশমিক ২৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে রয়েছে।

নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান জানান, নেত্রকোনায় তিনদিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৭৫৮ মিলিমিটার। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি না হওয়ায় নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে।

বন্যার্তদের সহযোগিতায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১১টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে ১১৫টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বন্যাদুর্গত এক হাজার পরিবারের মাঝে চাল, ডাল, তেল, শিশুখাদ্য ও গোখাদ্যের জন্য নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পূর্বধলায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় কয়েকটি গ্রামের মানুষ নতুন করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ওইসব গ্রামের ৮০টি পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছে। পানিবন্দি মানুষের মাঝে প্রশাসনসহ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে খাদ্য ও ত্রাণ দেয়া হচ্ছে।’

আরও