নড়াইলে নবগঙ্গার ভাঙনে গ্রাম ছাড়ছে বাস্তুহারা মানুষ

নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামে নবগঙ্গা নদীর পাড়ে ঘর ছিল মো. ইমদাদ মাস্টারের। জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে নদীভাঙনের সঙ্গে।

নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামে নবগঙ্গা নদীর পাড়ে ঘর ছিল মো. ইমদাদ মাস্টারের। জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে নদীভাঙনের সঙ্গে। প্রতি বছরই হারিয়েছেন ফসলি জমি, ঘরবাড়ি। নতুন করে আবারো তৈরি করেছেন ঘর। এ নিয়ে তিনটি বাড়ি নির্মাণ করলেও কোনোটিতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারেননি। সবই নদীতে বিলীন হয়েছে। জীবনের শেষভাগে এসে যে বাড়িটি নির্মাণ করেছেন, সেটিও গত সপ্তাহে ভেঙে গেছে। নদীর কাছে হার মেনে এখন তিনি অসহায়। পরিবার নিয়ে মাথা গোঁজার মতো এক শতক জমিও তার অবশিষ্ট নেই। জীবনের বাকি দিনগুলো হয়তো রাস্তার পাশে অথবা খোলা কোনো স্থানেই থাকতে হবে তাকে।

নদীভাঙনের তিক্ত অভিজ্ঞতা শুধু মো. ইমদাদ মাস্টারের নয়। নবগঙ্গাপাড়ের বাসিন্দাদের কাছে এটি চিরচেনা বিষয়। প্রতি বছরই কালিয়া উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম নদীভাঙনের কবলে পড়ছে। তিন সপ্তাহ ধরে একটু একটু করে ভাঙছে নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকা। প্রতিদিনই নদীতে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। সব হারিয়ে এরই মধ্যে গ্রাম ছেড়ে আশপাশের গ্রামে চলে গেছেন অনেকে।

নদীপাড়ের বাসিন্দারা বলছেন, শরতের মাঝামাঝি সময় নবগঙ্গার ভাঙনের কবলে পড়েছে কালিয়া উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম। ১৫ দিনের অব্যাহত ভাঙনে নদীতে বিলীন হয়েছে অর্ধশতাধিক ঘর, গাছপালাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে আরো তিন শতাধিক বাড়ি, রাস্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

সরজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর গ্রামে প্রায় এক কিলোমিটারজুড়ে ভাঙছে নবগঙ্গা নদী। গেল দুই সপ্তাহের অব্যাহত ভাঙনে বিলীন হয়েছে ওই গ্রামের রিলু ফকির, জনি শেখ, মাহাবুর ফকির, মাকসুদ ফকির, রুকি বেগম, জহুর সরদার, শহিদুল মোল্লা, মহাদাদ শেখের বাড়ি। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে খোকন মোল্লা, শাহাদাদ সরদার, সাইফুল সরদার, কিবরিয়া শেখ, বিল্লাল সরদার, পারভেজ সরদার, আরিফ সরদার, সেতু মোল্লাসহ কয়েকশ মানুষের ঘরবাড়ি, পাকা রাস্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনা।

নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মাকসুদ ফকির বলেন, ‘বাড়িতে দুটি থাকার ঘর, একটি গোয়াল ও একটি রান্নাঘর ছিল। গাছপালা ভিটেমাটিসহ সব নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। অসহায়ের মতো শুধু তাকিয়ে দেখেছি। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি।’

রুকি বেগম বলেন, ‘আমার সাজানো সংসারের আর কিছু অবশিষ্ট নেই। নতুন করে বাড়ি করার মতো জমিও আমার নেই। এখন কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।’

নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, ভোটের সময় জনপ্রতিনিধিরা ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। তবে ভোট শেষ হলে তার বাস্তবায়ন করেননি কখনো। এখন আর আশ্বাস নয়, এবার নদীভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হবে, এমনটাই প্রত্যাশা তাদের।

বিষ্ণুপুর গ্রামের মুদি দোকানি আল-আমিন সরদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নদীতে আমার মুদি দোকানটা বিলীন হয়ে গেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগে দোকানসহ সব মালপত্র নদীগর্ভে চলে গেল। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এখন কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। দোকানটা ছিল আমার একমাত্র উপার্জনের উৎস।’

আরেক দোকানি মিল্লাদ সরদার বলেন, ‘চোখের পলকে আশপাশের বাড়িঘরসহ আমার দোকান নদীতে ভেঙে গেল। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। তখন আমাদের কারো কিছু করার ছিল না।’

নদীপাড়ের বাসিন্দা খোকন মোল্লা বলেন, ‘নদী ভাঙতে ভাঙতে বাড়ির পাশে চলে এসেছে। যেকোনো সময় আমার বসতভিটাও নদীতে বিলীন হতে পারে। আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারি না। ছেলে-মেয়ে নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি আমরা। প্রতি বছর নদী ভাঙলেও আমাদের খোঁজ নেউ নেয় না।’

এ ব্যাপারে বাপাউবো যশোর পানি উন্নয়ন সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. সাবিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন রোধের প্রাথমিক চেষ্টা করা হবে। পরবর্তী সময়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রকল্প তৈরি করে তা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। অনুমোদন পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

আরও