সংঘর্ষের দুদিন একের পর এক আহত আসছিল আলোক হাসপাতালে

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ১৮ ও ১৯ জুলাই মিরপুর এলাকায় পুলিশের বেশ সংঘর্ষ হয়। সেখানকার হাসপাতালগুলোর তথ্য অনুযায়ী এতে অন্তত ১২ জন নিহত এবং পাঁচ শতাধিক আহত হয়। সংঘর্ষে হতাহতদের উদ্ধার করে তাৎক্ষণিক নেয়া হয়েছিল আশপাশের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আহতের ঢল নেমেছিল মিরপুর ১০ নম্বরের বেসরকারি আলোক

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ১৮ ও ১৯ জুলাই মিরপুর এলাকায় পুলিশের বেশ সংঘর্ষ হয়। সেখানকার হাসপাতালগুলোর তথ্য অনুযায়ী এতে অন্তত ১২ জন নিহত এবং পাঁচ শতাধিক আহত হয়। সংঘর্ষে হতাহতদের উদ্ধার করে তাৎক্ষণিক নেয়া হয়েছিল আশপাশের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আহতের ঢল নেমেছিল মিরপুর ১০ নম্বরের বেসরকারি আলোক হাসপাতালে। তাদের বেশির ভাগই ছিল গুলিবিদ্ধ। ইটপাটকেল ও লাঠি বা রডের আঘাতে আহত হয়েও কিছু মানুষ হাসপাতালে এসেছিল। আবার কেউ কেউ আসে কাঁদানে গ্যাসের কারণে অসুস্থ হয়ে।

আলোক হাসপাতালের কাছাকাছিই একটি ভবনের বাসিন্দা শাহরিয়ার আহমেদ। সংঘর্ষে আহত এক আত্মীয়কে নিয়ে ১৯ জুলাই তিনিও হাসপাতালটিতে গিয়েছিলেন। একটি চায়ের দোকানে বসে শাহরিয়ার আহমেদ সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করছিলেন, ‘আমার এক আত্মীয় আহত হয়েছে এবং তাকে আলোকে ভর্তি করা হয়েছে—সংবাদটি পেয়েই আমি ও আমার ভাই ছুটে যাই। গিয়ে দেখি অবস্থা বেশ খারাপ, অনেক মানুষ আহত। আত্মীয় হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তবে তার অবস্থা তুলনামূলক ভালো। প্রথমে আমরা পপুলারে যাই। কিন্তু সেখানে চিকিৎসা পাইনি। এরপর আলোকে যাই। হাসপাতালটিতে তখন হতাহতদের রাখারও জায়গা নেই। তাই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আমরা আহত আত্মীয়কে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চলে যাই।’

সম্প্রতি হাসপাতালটিতে সরজমিনে দেখা যায় সহিংসতায় আহত কেউ এখন আর ভর্তি নেই। তবে কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে কথা হয় সেখানকার দায়িত্বরত কয়েকজনের সঙ্গে। তাদের কেউই অবশ্য নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

আলোক হাসপাতালের দায়িত্বরত এক চিকিৎসক ১৯ জুলাইয়ের ঘটনা উল্লেখ করে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ওইদিন আমরা জরুরি বিভাগে যে পরিমাণ মনিুষ দেখেছি সেটি আমরা এর আগে কখনো দেখিনি। সবার নাম হয়তো লেখাও সম্ভব হয়নি। ফ্লোরজুড়ে ছিল শুধু আহত বক্তি। অবস্থা এমন ছিল যে আমরা সবাইকে বেডে শুইয়েও প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারিনি। ফ্লোরে শোয়া অবস্থায়ই কোনোমতে চিকিৎসা দিয়ে তাদের সরকারি হাসপাতালে রেফার করেছি। তবে আমরা কাউকে চিকিৎসা না দিয়ে ফিরিয়ে দিইনি। আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব হয়েছে তার সবটুকু দিয়েই সেবা দিয়েছি আহতদের।’ 

১৮ জুলাই দুপুর ১২টার পর থেকে সংঘর্ষে আহত ব্যক্তি আসা শুরু হয় বলে জানান হাসপাতালটির এক কর্মচারী। তবে ওইদিন যারা এসেছিলেন তাদের আঘাত তুলনামূলক কম ছিল। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয় ১৯ জুলাই। ওইদিন বেলা ৩টার পর হাসপাতালে আহতদের ঢল নামে। লোকজন ধরাধরি করে একের পর এক মানুষকে নিয়ে আসছিল। প্রায় সবাই ছিলেন গুলিবিদ্ধ ও রক্তাক্ত। কারো কারো অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন চিকিৎসকরা। 

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সংঘর্ষে ১৮ জুলাই আহত হয়ে অর্ধশতাধিক এবং ১৯ জুলাই চিকিৎসা নেয় শতাধিক ব্যক্তি। এর মধ্যে ১২৪ জনের তথ্য লিপিবদ্ধ আছে আলোক হাসপাতালে। এছাড়া সংঘর্ষের ঘটনায় ১৯ জুলাই পাঁচজনের মৃত্যুর তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। তারা হলেন দীপু (৩৫), মোহাম্মদ সেলিম (৩৪), শহিদুল ইসলাম (৬৩), সাগর (১৬) ও হৃদয় (২৪)। এর মধ্যে দুজনের মৃতদেহ পরিবার এবং তিনজনের মরদেহ গ্রহণ করে পুলিশ।

১৯ জুলাইয়ের সংঘর্ষে আহত মোহাম্মদ সেলিমকে আলোক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। কিছুক্ষণ পরই তার মৃত্যু হয়। পেশায় তিনি ছিলেন একজন ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী। প্রতিদিন ভ্যান নিয়ে আশপাশের এলাকায় ঘুরে ভাঙাড়ি সংগ্রহ করতেন এবং সেগুলো বিক্রি করে যা পেতেন তা দিয়েই চলত তার সংসার। মিরপুর ১০ এলাকায় ঝুটপল্লীতেই পরিবারসহ থাকতেন সেলিম। কথা হয় সেলিমের ছোট ভাই আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে। নিহত ভাইয়ের কথা জানতে চাইতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ওই যুবক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সেদিন আমার ভাই দুপুরের খাবার শেষে বের হয়েছিলেন সামনের গলির দোকান থেকে সিগারেট কিনতে। ভাইয়ের সঙ্গে ওটাই ছিল পরিবারের শেষ দেখা। এরপর সন্ধ্যার দিকে একজন আমাকে ফোনে জানায়, আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়েছে, আলোক হাসপাতালে আছে। তাৎক্ষণিক সেখানে যাই। গিয়ে দেখি সব শেষ, আমার ভাই আর জীবিত নাই। পরে হাসপাতাল থেকে মরদেহ নিয়ে আসি।’

সেলিমের তিন ছেলেমেয়ে। ছোট ছেলের বয়স সবে চার বছর জানিয়ে আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘ভাই আমার গ্রাম থেকে পরিবারসহ ঢাকায় এসছিল বেশি আয় করে ভালো থাকার জন্য। কাজ করে যা পেত তা দিয়েই ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনোমতে চলে যেত তার। কিন্তু এখন তো আর ভাই নেই। আমার নিজের অবস্থাও তেমন ভালো না। তার সংসারটা কীভাবে চলবে আল্লাহই জানেন।’

নিহতদের মধ্যে আরেকজন শহিদুল ইসলাম। মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে গুলিবিদ্ধ হন। শহীদুল ইমলামের মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা করেন হাসপাতালের এক প্রত্যক্ষদর্শী। নাম না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শহীদুল ইসলামকে নিয়ে এসেছিলেন তার মেয়ে। ২৪-২৫ বছর বয়স হবে। মেয়েটি যতটুকু বলেছে তারা বাড়ি যাচ্ছিল। পথেই গুলিবিদ্ধ হন তার বাবা। যখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তখন শহীদুল ইসলাম বেঁচে ছিলেন। মাথা থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তবে কোথায় গুলি লেগেছে দেখতে না দেখতেই তার মৃত্যু হয়।’

শুধু আলোক হাসপাতালই নয়, বণিক বার্তার পক্ষ থেকে মিরপুর ১০ নম্বরের আশপাশের মোট পাঁচটি স্বাস্থ কেন্দ্রে সরজমিনে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়। তবে হাসপাতালগুলোর দায়িত্বশীলদের অধিকাংশই সংঘর্ষের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। পরে চারটি হাসপাতাল তথ্য দিলেও নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তথ্য প্রদানকারী। এর মধ্যে দুটি হাসপাতালের দাবি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের তথ্য দিতে নিষেধ করা হয়েছে।

আরও