নারী শিক্ষার্থীরা যেভাবে এগিয়ে নিয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলন

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় জুনে। তবে এ আন্দোলন তীব্রতা পেতে থাকে জুলাইয়ের শুরুতে। এ সময় ঢাকায় আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল শাহবাগ। শাহবাগকেন্দ্রিক মিছিল ও সভাগুলোর প্রতিটিতেই সামনের সারিতে ছিলেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী শিক্ষার্থী। এমনকি বিক্ষোভ সভাগুলোয় অধিকাংশ সময় স্লোগানও দিতে দেখা গেছে নারীদের।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় জুনে। তবে এ আন্দোলন তীব্রতা পেতে থাকে জুলাইয়ের শুরুতে। এ সময় ঢাকায় আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল শাহবাগ। শাহবাগকেন্দ্রিক মিছিল ও সভাগুলোর প্রতিটিতেই সামনের সারিতে ছিলেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী শিক্ষার্থী। এমনকি বিক্ষোভ সভাগুলোয় অধিকাংশ সময় স্লোগানও দিতে দেখা গেছে নারীদের। 

এবার নারী কোটার বিরুদ্ধেও শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন নারী আন্দোলনকারীরা। ‘নারী যেখানে অগ্রসর, কোটা সেখানে হাস্যকর’ এমন প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে তাদের হাতে। সভাগুলোয় নারীদের বক্তব্যেও বারবার উঠে এসেছে তারা বিশেষ কোনো সুবিধা নয় বরং নিজেদের যোগ্যতায় সামনে এগিয়ে যেতে চান। শুধু শাহবাগেই নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. সাঈদ ফেরদৌসের ভাষ্যমতে, রাষ্ট্রের নীতিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে; এ আন্দোলন সেটি আবারো প্রমাণ করেছে। 

বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা গত কয়েক বছর ধরেই দেখছি নারী শিক্ষার্থীরা ফলাফলের দিক থেকে এগিয়ে থাকছে। এ এগিয়ে থাকাই হয়তো তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছে যে তারা কোটা ছাড়াই এগিয়ে যেতে পারবে। আর সমাজ বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে নারীদের আগেও নিজস্ব চিন্তাভাবনা ছিল, মতামত ছিল। তবে এ আন্দোলনে আরো জোরালোভাবে নারীরা তাদের সাহস ও অগ্রসরতার জায়গাটি বুঝিয়ে দিয়েছে। পুলিশ, সমাজ বা রাষ্ট্র কারোরই আর নারীকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই।’

চলতি বছর প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী উচ্চ শিক্ষায় ছাত্রীর হার ৪৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪৭ লাখ ৫৬ হাজার ৭৪৭।  তাদের মধ্যে ছাত্র ২৫ লাখ ৪২ হাজার ৩৩১ জন এবং ছাত্রী ২২ লাখ ১৪ হাজার ৪০৯ জন। এদের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছেন ২১ লাখ ১৩ হাজার ৮২৬ জন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ১ লাখ ৫৮৩ জন। এ নারী শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশকে এবারের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে।

জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে কোটা আন্দোলন সারা দেশেই অত্যন্ত তীব্র আকার ধারণ করে। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ দিনও সামনের সারিতে ছিলেন নারী শিক্ষার্থীরাই এবং প্রথমে নারীদের ওপরই হামলার ঘটনা ঘটে। ওই দিনের ঘটনা বণিক বার্তার কাছে তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের ছাত্রী সীমা আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমরা সেইদিন সামনের সারিতে ছিলাম এবং আমাদের সবারই চিন্তা ছিল আমাদের ভাইদের যাতে কিছু না হয়। আমাদের বিশ্বাস ছিল আমরা সামনে থাকলে কেউ তাদের ওপর হামলা করার সাহস করবে না। কিন্তু সেইদিন আমাদের ওপর নৃশংসভাবে হামলা করা হয়। বেধড়ক মারধর করা হয়। আমার মাথায় ইট ছুড়ে মারা হয়েছিল। আমি কোনো মতে বেঁচে গেলেও মুখে মারাত্মক আঘাত পাই। ওইদিন শুধু ভিসি চত্বরে আমার আশপাশে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল, যার অধিকাংশ ছিল নারী।’

তিনি আরো বলেন, ‘নারীরা এখন শিক্ষিত হচ্ছে। তারা এখন আত্মসচেতন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। বিশেষ করে আমরা এ প্রজন্মের যারা আছি, তারা আরো আগে থেকেই অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। আমরা স্কুল-কলেজ পর্যায়ে সড়ক আন্দোলনে ছিলাম। এ আন্দোলন আমাদের একজন নাগরিক হিসেবে অধিকারের বিষয়ে, দায়িত্বের বিষয়ে সচেতন করে তুলেছে। আমরা নিজেদের কোনো বিভাজনের বাইরে গিয়ে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবেই সামনে এগোনোর চেষ্টা করি। আর এ কারণেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে গিয়ে সামনের সারিতে অধিকার নিশ্চিতের জন্য নেমেছিলাম।’ শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে নারীদের এ অংশগ্রহণ আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীমা সুলতানা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নারীরা এর আগেও বিভিন্ন আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা দেখিয়েছে। এ আন্দোলনে আবারো বুঝিয়ে দিয়েছে সে আর অনগ্রসর নয়। সে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী। সে কোনো করুণা দিয়ে নয় বরং নিজের যোগ্যতা দিয়ে সমান প্রতিযোগিতা করে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। আর এ আন্দোলনে শুধু নারী শিক্ষার্থীরা নয়, মায়েরা যেভাবে ভূমিকা পালন করেছেন তা সবাইকে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস জুগিয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘নারীরা যখন আন্দোলনের সামনে দাঁড়িয়েছে তখন সে কিন্তু অধিকার আদায়ের পাশাপাশি একজন বোন হিসেবে ভাইকে আগলে রাখতেও ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ আন্দোলনে আমরা নারীর প্রতি যে নৃশংসতা দেখেছি, যেভাবে নির্বিচারে শিক্ষার্থীসহ শিশু ও সাধারণ মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তা দেশের ইতিহাসে আর কখনো দেখা যায়নি। আর এখন যেভাবে নির্বিচারে শিক্ষার্থী গ্রেফতার করা হচ্ছে, এমন ঘটনাও বিশ্বে নজিরবিহীন। আমরা চাই আরিফ সোহেলসহ আটককৃত সব শিক্ষার্থীকে, নিরপরাধ ব্যক্তিকে মুক্তি দেয়া হোক এবং সব হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক। এ আন্দোলন এখন আর কোটা সংস্কারের আন্দোলন নেই। আমাদের এখন দরকার রাষ্ট্র সংস্কার।’

কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেশকিছু প্রতিবাদ কর্মসূচি প্রথম নারী শিক্ষার্থীদের হাতেই শুরু হয়েছিল। ১৬ জুলাই রাতে হলের তালা ভেঙে প্রথম বেরিয়ে এসেছিলেন রোকেয়া হলের ছাত্রীরা। এ সময় তাদের অনেকের হাতে ছিল স্টিলের প্লেট, চামচ বা খুন্তি। এগুলো দিয়েই আওয়াজ তোলেন তারা। সঙ্গে যুক্ত হয় স্লোগান। ছাত্রীদের স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। ‌রোকেয়া হলের ছাত্রীদের এ প্রতিবাদের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর একে একে অন্যান্য হল থেকে ছাত্ররাও বের হতে থাকেন। এ রাতেই নারী শিক্ষার্থীদের অন্যান্য হল থেকেও ছাত্রীরা প্রতিবাদী কণ্ঠে স্লোগান দিতে এসে জড়ো হন রাজু ভাস্কর্যের সামনে। আর পরে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য ক্যাম্পাসে। সে সময় অধিকাংশ ক্যাম্পাসেই নারী শিক্ষার্থীরা হলের তালা ভেঙে বেরিয়ে এসে প্রতিবাদে অংশ নেন। 

ওই দিনের ঘটনা বণিক বার্তার কাছে তুলে ধরেন রোকেয়া হলের এক শিক্ষার্থী। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসেছি, তারা অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এসেছি। আমরা জানতাম একবার কেউ সাহস করে এগিয়ে গেলে, বাকিরাও এগিয়ে আসবে। সে জায়গা থেকে আমরা কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম প্রতিবাদটি প্রথম আমরাই শুরু করব। এরপর কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলি, তারাও রাজি হয়।’ 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীম উদ্দীন খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ছেলেদের হলগুলোয় ছাত্রসংগঠনগুলো যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেটি ছাত্রী হলগুলোয় তুলনামূলকভাবে কম। এক্ষেত্রে মেয়েদের হলগুলোর প্রশাসন প্রশাসনিক কাজকর্মে অনেক বেশি ভূমিকা পালন করতে পারে। যেটা ছেলেদের হলে দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া বাকিগুলোয় অনুপস্থিত। এর ফলে মেয়েদের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে মোবিলাইজ হওয়াটা সহজ, যেটা ছেলেদের জন্য নয়। এর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে ও মেয়ের অনুপাত দেখলে বোঝা যায় সংখ্যাগতভাবে ছাত্রীদের সংখ্যা বেড়েছে। কিংবা কিছু ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদেরও চেয়েও ভালো করছে। একটি বিষয় লক্ষণীয়, যেহেতু মেয়েরা রাজনৈতিকীকরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এটিই হয়তো ভবিষ্যতে মূলধারা হবে। সেই সঙ্গে নারীদের অংশগ্রহণের ধরন বর্তমান থেকে ভিন্ন হবে। হয়তো নারীরা সিদ্ধান্ত তৈরির জায়গায় অগ্রগামী হয়ে থাকবে।’ 

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হওয়ার পর এ আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নেয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময়েও নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের ভাই-বোনদের ওপর নৃশংসা হামলা হওয়ার পর বিবেকবোধ থেকে ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। আর নারী এখন অনেক এগিয়ে। সে যে আর কারো বোঝা নয় বরং অন্যের সাহস হতে পারে, বিপদে সমানভাবে পাশে দাঁড়াতে পারে; সেটাই আমরা এ আন্দোলনে প্রমাণ করেছি।’

ঢাকার বাইরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনেও নারীরা সরব ভূমিকা রেখেছেন।

আন্দোলনে অংশ নেয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নাদিয়া হক মিথি বলেন, ‘আমরা অধিকার আদায়ের সব আন্দোলনেই ছিলাম, ভবিষ্যতেও থাকব। আমাদের যে অদম্য সাহস আছে, সেটি জাতিকে বুঝিয়ে দিতে চাই।’ 

নারীর এ ভূমিকাকে গর্ব করার মতো বিষয় হিসেবে দেখছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন। তিনি বলেন, ‘নারী এখন আর অনগ্রসর নয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনে তাদের যে সাহস দেখেছি, তা সত্যিই গর্বের। তবে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে সর্বপ্রথম নারীদের অগ্রযাত্রায় যেসব বাধা রয়েছে, সেগুলোকে অপসারণ করে তাদের ফ্রি স্পেস দিতে হবে এবং যে অপরাজনীতি বলবৎ রয়েছে তা থেকে মুক্ত করতে হবে। তাহলেই তারা সবার আগে এগিয়ে যাবে।’

আরও