শেরপুরে বন্যায় ৩ জন নিহত, নিখোঁজ ৩

টানা ভারী বর্ষণ ও ভারতের মেঘালয় থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে শেরপুর ও ময়মনসিংহের ২ উপজেলায় আকস্মিক বন্যায় এ পর্যন্ত তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যার পানিতে প্রাণ হারানো তিন জনের মধ্যে দুই জনের নাম ও পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন, নালিতাবাড়ী উপজেলার খলিশাকুড়া গ্রামের ইদ্রিস আলী, বাঘবেড় গ্রামের মানিক মিয়ার স্ত্রী অমিজা খাতুন (৪৫)। নিহত অপরজনের নাম পরিচয় এখনো জানা যায়নি।

এছাড়াও বন্যাকালীন সময়ে নিখোঁজ রয়েছেন তিন জন। তারা হলেন, নালিতাবাড়ী উপজেলার অভয়নগর এলাকার বাছের আলীর ছেলে আবুল হাতেম ও আলমগীর হোসেন এবং নামা বাতকুচি গ্রামের জহুরা খাতুন।

নালিতাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সানোয়ার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা উজানের ঢলে শেরপুরের নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলায় কমপক্ষে ১৫০টি গ্রাম এবং ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়ায় ৫০টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির ফসল,ভেসে গেছে মাছের খামারের লক্ষ লক্ষ টন মাছ। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ। অতিবৃষ্টিতে শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার কয়েকটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শেরপুরে মহারশি, চেল্লাখালী ও ভোগাই নদীর বাঁধের অন্তত সাত স্থান ভেঙে ঝিনাইগাতী উপজেলা সদর ও নালিতাবাড়ী পৌর এলাকাসহ শ্রীবরদী উপজেলার দেড় শতাধিক গ্রাম ডুবে গেছে। নালিতাবাড়ী তিলানী-শেরপুর মহাসড়কের রানীগাঁও-৩ সেতুর দুইপাশ ভেঙে সড়ক যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট পৌর এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও দোকান বন্ধ রয়েছে। শেরপুরে গত শুক্রবার (৪ অক্টোবর) ভোর থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে এবং নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে।

শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ঝিনাইগাতী উপজেলায় ৩২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

এদিকে চলমান পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে জেলার আমন চাষের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। শেরপুরের মহারশি নদীর খৈলকূড়ায় তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে গতকাল শনিবার ঝিনাইগাতী উপজেলায় নদীর পানি অনেকাংশেই কমে গিয়েছে, বর্তমানে ঝিনাইগাতী সদর, গৌরিপুর, ধানশাইল, মালিঝিকান্দা ও হাতিবান্দা ইউনিয়নের নিচু এলাকার অন্তত ৫০টি গ্রাম পানিতে থৈ থৈ, আমান আবাদ পানির নিচে তলিয়ে গেছে, পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।

নালিতাবাড়ী উপজেলার শিমুলতলা, ঘাকপাড়া, মণ্ডলিয়াপাড়া, ভজপাড়া ও সন্নাসীভিটায় ভোগাই ও চেল্লাখালীর বাঁধ ভেঙেছে। এতে উপজেলার সবকটি ইউনিয়নে বন্যার পানি ঢুকেছে, নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে শেরপুর-নালিতাবাড়ী ভায়া গাজিরখামার সড়ক, নালিতাবাড়ী-ধারা সড়ক, এছাড়া জেলার প্রতিটি শহরে জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। পাহাড়ি ঢলের পানিতে আকস্মিক প্লাবিত হয়েছে নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীর অন্তত ২১টি ইউনিয়ন। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির উঠতি আমন ফসল।

শ্রীবরদী উপজেলার প্রায় ছয়টি ইউনিয়ন পানিতে ডুবে আছে। রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও কালভার্ট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন স্থানীয়রা। বাড়িঘরে পানি ওঠায় রান্না করতে পারছেন না এসব এলাকার লোকজন। ফলে মানুষ ও গবাদি পশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।

ঝিনাইগাতী বাজারের ব্যবসায়ী সুরুজ মিয়া জানান, প্রতিটি ঘরে পানি উঠেছিল, ধীরে ধীরে পানি কমছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক ব্যবসায়ীরই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। প্রতিবছরই নদীর বাঁধ ভাঙে আর আমাদের ক্ষতি হয়। কিন্তু কেউ এদিকে নজর দেয় না। এর জন্য নদীর স্থায়ী বাঁধ চাই আমরা।

কৃষক মাইন উদ্দীন জানান,এবারের বন্যায় আমাদের সব ফসল পানির নিচে চলে গেছে। ফসল নষ্ট হলে আমরা বাঁচবো কেমনে। ২০০১ সালে এত ক্ষতি হয়নি। এ বছর যে পরিমান ক্ষতি হয়েছে।

শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান জানান, শেরপুরের বন্যা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে বন্যার্তদের শুকনো খাবার ও গো-খাদ্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

অন্যদিকে বৃহস্পতিবার (৪ অক্টোবর) থেকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলায় পানি বাড়তে থাকে। পৌর শহরের ৯টি ওয়ার্ডসহ ১২টি ইউনিয়নই বন্যা কবলিত হয়েছে। উপজেলা সদরের হাসপাতাল চত্বরে পানি ঢুকে পড়েছে।

রানীশিমুল ইউনিয়নের হালুয়াহাটি গ্রামের কাশেম মিয়া বলেন, গতকাল ভোরে হঠাৎ বাড়ির উঠানে পানি দেখতে পান। দুপুরের দিকে একমাত্র বসতঘরটি প্রায় তলিয়ে গেছে। ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নেতাই নদের বাঁধ ভেঙে উপজেলার অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এলাকাগুলো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সেখানে মোবাইল নেটওর্য়াক বন্ধ রয়েছে।

ময়মনসিংহ জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সানোয়ার হোসেন জানান, হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এখন নারী শিশুসহ ৭ শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তাদের জন্য শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হালুয়াঘাট সীমান্তবর্তী চারটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দর্শা, মেনংছড়া, বোরারঘাট ও সেওলা নদীর তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়। পরে রাতেই বিভিন্ন স্থানে নদীর বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে প্রবল বেগে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। এতে ভূবনকুড়া ইউনিয়নের মহিষলেটি, ধোপাজুড়া, কড়ইতলী, জুগলী ইউনিয়নের গামারীতলা, জিগাতলা, নয়াপাড়া, ছাতুগাও, কৈচাপুর ইউনিয়নের নলুয়া, জয়রামকুড়া এলাকাসহ গাজীরভিটা ইউনিয়নের বোরাঘাট নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সূর্যপুর, সামিয়ানাপাড়া হাজনিকান্দক, আনচিংগি, বোয়ালমারাসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে বৃহস্পতিবার রাত থেকে হালুয়াঘাটের ভূবনকুড়া ইউনিয়নের দর্শা, সেওলা ও মেনংছড়া এবং গাজিরভিটা ইউনিয়নের বোরারঘাট নদীর তীরবর্তী বাঁধে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। ভাঙা অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করে কয়েক হাজার বাসাবাড়িতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। হালুয়াঘাট পৌরশহর, সদর ইউনিয়নসহ হালুয়াঘাট বাজারের বিভিন্ন অংশ পানি ঢুকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।

হালুয়াঘাট উপজেলার গাজিরভিটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, তার এলাকার মহাজনিকান্দক, আনচিংগি, বোয়ালমারা এলাকায় পানি বেশি। তবে সকালে পাহাড়ি ঢলে সীমান্তে সড়কের ওপরে তিন ফুট পানি ছিল। এলাকার পুকুড়ের মাছ সব চলে গেছে।

স্থানীয় ভূবনকুড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুরুজ মিয়া জানান, অতি বৃষ্টির কারণে স্থানীয় নদীগুলোতে পানি বাড়ছে। এরই মধ্যে শেওয়াল ও মেনেং নদীর দুটি অংশে পাড় ভেঙে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এতে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত শারমিন বলেন, উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। বৃষ্টি বাড়লে পানি আরো বাড়তে পারে। উপজেলায় মোট ৭টি ইউনিয়নের কিছু কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া দুটি ইউনিয়ন পুরোপুরি প্লাবিত হয়েছে। ওইসব এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় মোবাইলে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই, সঠিক তথ্য এখনো আমরা পাইনি। সঠিক তথ্য পেতে আরো সময় লাগবে। বন্যাদুর্গতদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনা দেয়া আছে।

হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবিদুর রহমান বলেন, পানি কিছুটা কমে গিয়েছিল। পরে আজ আবারো প্রায় টানা দুই ঘণ্টা বৃষ্টি হওয়ায় পানিও আবার বেড়ে গেছে। উপজেলায় ৪টি ইউনিয়ন পুরোপুরি প্লাবিত হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য ১০ হাজার টন খাদ্য সহায়তা ঘোষণা করা হয়েছে। খাদ্য সহায়তা বিতরণ চলমান আছে বলেও জানান তিনি।

ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, মৎস্য চাষিদের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার সঠিক কোনো তথ্য এখনো আমাদের জানা নেই। উপজেলা মৎস্য অফিসারদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করে পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে।

ময়মনসিংহ জেলা কৃষি অফিস সুত্র জানায়, ধানের জমি প্লাবিত হয়েছে ১৫ হাজার ৪৩৮ হেক্টর। এর মধ্যে ডুবে গেছে ৯ হাজার ৭৮ হেক্টর জমি, আংশিক ডুবেছে ৬ হাজার ৩৬০ হেক্টর এবং সবজি আংশিক প্লাবিত হয়েছে ১৫৮ হেক্টর। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে।

আরও