দেড় দশকে ৮৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ, তবু লোকসানের ‍বৃত্তে রেল

সমাপ্ত ও চলমান প্রকল্প মিলিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত সাড়ে ১৫ বছরে দেশের রেলওয়ে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা। এ টাকায় নতুন রেলপথ নির্মাণ ও ইঞ্জিন-কোচ সংগ্রহ করা হয়েছে। পুরনো রেলপথ সংস্কার, সিগনাল ব্যবস্থা আধুনিকায়নসহ উন্নয়ন করা হয়েছে বিভিন্ন অবকাঠামো। বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে রেলের লোকসান। বন্ধ হয়েছে

সমাপ্ত ও চলমান প্রকল্প মিলিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত সাড়ে ১৫ বছরে দেশের রেলওয়ে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা। এ টাকায় নতুন রেলপথ নির্মাণ ও ইঞ্জিন-কোচ সংগ্রহ করা হয়েছে। পুরনো রেলপথ সংস্কার, সিগনাল ব্যবস্থা আধুনিকায়নসহ উন্নয়ন করা হয়েছে বিভিন্ন অবকাঠামো। বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে রেলের লোকসান। বন্ধ হয়েছে একের পর এক স্টেশন। সংকুচিত হয়েছে বিভিন্ন সেবা। অন্যদিকে ট্রেনের সংখ্যা বাড়লেও কমেছে সময় মেনে চলাচলের হার। অদূরদর্শী ও অপরিকল্পিত বিনিয়োগের সঙ্গে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে রেলের এ দুরবস্থা বলে মনে করেন পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা। 

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০০৯ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ৮৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এসব প্রকল্পে খরচ হয়েছে ২১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। চলমান আছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকার ৩২টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৬৬ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। সমাপ্ত ও চলমান প্রকল্প মিলিয়ে গত ১৫ বছরে রেলওয়ের উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে মোট ৮৭ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা।

কোনো সংস্থা বা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কতটা দক্ষ, তা সহজেই যাচাই করা যায় ‘অপারেটিং রেশিও’র মাধ্যমে। এটি মূলত একটি নির্দিষ্ট সময়ে মোট ব্যয়কে মোট আয় দিয়ে ভাগ করে নিরূপণ করা হয়। অপারেটিং রেশিও যত বেশি হয়, প্রতিষ্ঠানের পরিচালন দক্ষতা তত দুর্বল হিসেবে গণ্য হয়। 

বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য বলছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর সংস্থাটির অপারেটিং রেশিও ছিল ১৫৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে ১ টাকা আয়ের বিপরীতে রেলওয়ের ব্যয় হয়েছে ১ টাকা ৫৯ পয়সা। অপারেটিং রেশিও নিয়ে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরের তথ্য প্রকাশ করে সংস্থাটি। এতে দেখা যায়, ওই অর্থবছরে অপারেটিং রেশিও বেড়ে দাঁড়ায় ২৫৮ শতাংশে। অর্থাৎ এ সময়ে প্রতি ১ টাকা আয় করতে গিয়ে ২ টাকা ৫৮ পয়সা ব্যয় করেছে রেলওয়ে। ওই সময় সব মিলিয়ে রেলওয়ের লোকসান হয়েছে ১ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা।

যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করে যা আয় হয়, তার চেয়ে বেশি ব্যয় হয়ে যায় ট্রেন পরিচালনায়। ফলে গুনতে হয় লোকসান। ২০২২ সালে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ধারাবাহিক লোকসানের পেছনে রেলওয়েতে চলমান নানা অনিয়ম ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি দায়ী। পাশাপাশি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার না করা এবং যাত্রীসেবার মান না বাড়ানোয় লোকসান কমানো সম্ভব হচ্ছে না বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। 

রেলে লোকসানের জন্য অনিয়ম-দুর্নীতিকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরাও। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিগত এক যুগে রেলে অনেক বিনিয়োগ হয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে আমরা এতদিন শুনে এসেছি, রেলওয়েকে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু এ সময়ে যে বিনিয়োগ হয়েছে তা পুরোপুরি এককেন্দ্রিক। শুধু নতুন নতুন অবকাঠামো তৈরিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামোও তৈরি হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন স্টেশন বানানো হয়েছে, সেগুলোয় ট্রেন থামে একটা বা দুইটা। হাজার হাজার কোটি টাকায় তৈরি নতুন রেলপথ দিয়ে দিনে একটির বেশি ট্রেন চলে না। আমি মনে করি, পরিকল্পনায় অদূরদর্শিতা, এককেন্দ্রিক ও অপ্রয়োজনীয় বিনিয়োগ এবং অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও সংস্থা হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার বদলে উল্টো পেছনে হাঁটা শুরু করেছে রেলওয়ে।’

যাত্রীসেবায় খুবই কম বিনিয়োগ হয়েছে দাবি করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘‌সরাসরি যাত্রীসেবাকে প্রভাবিত করবে, বিগত দেড় দশকে এমন বিনিয়োগ আমরা খুব কমই দেখেছি। রেলওয়ের আধুনিকায়ন করতে হলে সবার আগে দরকার ছিল সংস্থাটির পরিচালন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন। দক্ষ জনবল, উন্নত প্রযুক্তির মিশ্রণে একটি যুগোপযোগী রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ ছিল। এসব দিকে নজর না দিয়ে শুধু নতুন অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করা হয়েছে। যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে এসব বিনিয়োগ কতটা কাজে লাগছে তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে সংস্থাটি।’

সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়ের লক্ষ্য হলো ‌নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য অর্থ ও সময়সাশ্রয়ী রেল পরিবহন সেবা প্রদান। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের অন্যতম একটি সূচক হলো ট্রেন চলাচলে সময়ানুবর্তিতার হার। রেলওয়ের তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে মিটার গেজ রেলপথে চলাচল করা আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর সময়ানুবর্তিতার হার ছিল ৮৮ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২১ সালে সময় মেনে আন্তঃনগর ট্রেন চলাচলের হার কমে দাঁড়ায় ৮০ দশমিক ১ শতাংশে। একই সময়ে মেইল ও এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোর সময়ানুবর্তিতার হার ৮৪ থেকে কমে ৭৬ শতাংশ ও লোকাল ট্রেনগুলোর সময়ানুবর্তিতার হার ৬২ থেকে কমে ৫৮ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সময়ে ব্রড গেজ রেলপথে আন্তঃনগর, মেইল ও এক্সপ্রেস ট্রেনের সময়ানুবর্তিতার হার বাড়লেও কমেছে লোকাল ট্রেনের।

রেলের সময়ানুবর্তিতার হার কমে যাওয়ার পেছনে গত দেড় দশকের ‘‌ভুল’ বিনিয়োগকে দায়ী করেছেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. সামছুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌রেলওয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে সমন্বয়ের একটা বড় ঘাটতি আছে। কোন কাজটি আগে করতে হবে, কোনটি পরে হবে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে না। বিনিয়োগ প্রকল্পের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়নের দিকেই সবার ঝোঁকটা বেশি। রেলওয়েতেও তাই হচ্ছে। রেলপথ সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণ একটি নিয়মিত কার্যক্রম। এতে যদি ছেদ পড়ে তাহলে ট্রেনের শিডিউল এলোমেলো হওয়াটাই স্বাভাবিক। পাশাপাশি রেল নেটওয়ার্কে যতগুলো ট্রেন চলার কথা, বাস্তবে চলছে তার চেয়ে বেশি। আমাদের রেললাইন খারাপ, সক্ষমতার চেয়ে ট্রেন চলাচল বেশি। এসব সমস্যার সমাধান না করে গত দেড় দশকে শুধু বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে।’ 

বিগত দেড় দশকে রেলে বিপুল বিনিয়োগ ও বিনিয়োগের বিপরীতে অর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী।

আরও