সরকারি হেলথ টেকনোলজি ইনস্টিটিউট

২৩ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের পদ শূন্য প্রায় ৬১%

আসন ফাঁকা ৩৫ শতাংশ, নির্মাণ হচ্ছে আরো ছয় ইনস্টিটিউট

মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে প্রয়োজন দক্ষ কর্মী। সে চাহিদা বিবেচনায় ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান জোগান দিতে সরকার দেশের বিভিন্ন জেলায় চালু করে ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি)। এসব শিক্ষালয়ে করানো হয় ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি কোর্স। তবে দেশে বর্তমানে ২৩টি সরকারি আইএইচটি থাকলেও নেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও ল্যাব সরঞ্জাম। শিক্ষক ও

মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে প্রয়োজন দক্ষ কর্মী। সে চাহিদা বিবেচনায় ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান জোগান দিতে সরকার দেশের বিভিন্ন জেলায় চালু করে ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি)। এসব শিক্ষালয়ে করানো হয় ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি কোর্স। তবে দেশে বর্তমানে ২৩টি সরকারি আইএইচটি থাকলেও নেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও ল্যাব সরঞ্জাম। শিক্ষক ও প্রশিক্ষকদের মোট ২৪১ পদের বিপরীতে রয়েছেন কেবল ৯৫ জন। সে হিসেবে মাত্র ৩৯ শতাংশ শিক্ষক দিয়ে চলছে স্বাস্থ্য খাতের এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম। ফলে প্রতি বছরই ফাঁকা থাকছে এক-তৃতীয়াংশের বেশি আসন। 

দেশে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যায় না—রোগী ও তাদের স্বজনের এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তাই সরকার বিভিন্ন স্থানে আইএইচটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে দক্ষ জনবল তৈরির উদ্যোগ নেয়। লক্ষ্য ছিল স্বাস্থ্য খাতে রোগীর ডায়াবেটিস, রক্ত, প্রস্রাব, মল ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ শনাক্তে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বাড়ানো। কিন্তু এসব ইনস্টিটিউটের ভবন করতে যতটা আগ্রহ সংশ্লিষ্টদের, জনবল নিয়োগে ততটা নেই। শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকা ইনস্টিটিউটগুলোর সংকট সমাধান না করে প্রতি অর্থবছরেই নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে চলমান রয়েছে ছয়টি আইএইচটি স্থাপনের কাজ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চালু থাকা আইএইচটিগুলোর জরুরি পদ অর্ধেকেরই বেশি ফাঁকা। এমনকি প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি করে প্রশিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়নি এত বছরেও। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পুরোদমে তাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। কোথাও কোথাও ধার করে দু-একজন প্রশিক্ষক এনে শুরু করা হয়েছে শিক্ষার্থী ভর্তি। শিক্ষা উপকরণ ও সরঞ্জামের ঘাটতিও প্রকট। যেহেতু কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়নি, সেহেতু আইএইচটিগুলোর ভবন কোনোটি পুরোটাই, কোনোটি আবার আংশিক খালি পড়ে আছে।

গাজীপুর মহানগরের গাছা এলাকায় ২০১৭ সালে নির্মাণকাজ শেষ হয় গাজীপুর ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির। প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম শুরু করে ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি। গত তিন বছরে সেখানে ভর্তি হয়েছেন ২৭৯ শিক্ষার্থী। প্রশিক্ষক রয়েছেন কেবল দুজন, তাও আবার অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে অস্থায়ীভাবে আনা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেক আশা নিয়ে আইএইচটিতে ভর্তি হলেও সব বিষয়ে প্রশিক্ষক না থাকায় নিয়মিত ক্লাস হয় না। পরীক্ষাগারে নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। ফলে হাতে–কলমে তেমন কিছুই শিখতে পারছেন না তারা।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ‘‌শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২২’-এর তথ্যানুযায়ী, সরকারি ২৩টি হেলথ টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে ১০ হাজার ২১৮ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন কেবল ৪৫ জন। অর্থাৎ প্রতিটি আইএইচটিতে গড়ে দুজন শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞানার্জনের সুযোগ পান ৪৪৪ শিক্ষার্থী। স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের আইএইচটিগুলোয় সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, লেকচারার, জুনিয়র লেকচারার, সিনিয়র লেকচারার, মেডিকেল অফিসার, সহকারী সার্জন, ইনস্ট্রাক্টর, টিউটরসহ মোট ২৪১ পদের বিপরীতে রয়েছেন ৯৫ জন। সে হিসেবে ৬০ দশমিক ৫৮ শতাংশ পদ শূন্য রেখেই চলছে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। এর মধ্যে আটটি সহযোগী অধ্যাপক পদের পাঁচটিই শূন্য, ৪২টি সহকারী অধ্যাপকের জায়গায় রয়েছেন কেবল ২৭, ছয়টি সিনিয়র লেকচারার পদের বিপরীতে নেই একজনও। এছাড়া ৬২ লেকচারার পদের ৪৫টিই ফাঁকা, মেডিকেল অফিসার ও সহকারী সার্জনের ১৪ পদে আছেন আটজন, ৯৯টি ইনস্ট্রাক্টর পদের ৬৯টিই শূন্য।

বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষকের অভাবে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি, আসবাব, শিক্ষক ও প্রশিক্ষক না থাকায় ব্যবহারিক ক্লাস করতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে তিনটি ব্যাচে শিক্ষার্থী রয়েছেন দুই শতাধিক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যক্ষের চেয়ার ফাঁকা। পদ সৃজন না হওয়ায় স্থায়ী শিক্ষকও নিয়োগ হয়নি এখনো। শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার জন্য কাশিয়ানী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সহকারী সার্জন ডা. প্রীতিলতাকে সংযুক্তিতে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনিই ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। 

জানতে চাইলে ডা. প্রীতিলতা বণিক বার্তাকে জানান, কাশিয়ানী ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে শিক্ষার্থী অনুযায়ী শিক্ষক দরকার কম করে হলেও চারজন। কিন্তু একজন মাত্র শিক্ষক হিসেবে তাকেই সামলাতে হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। মাঝেমধ্যে কিছু অতিথি শিক্ষক দিয়েও ক্লাস নেয়া হয়। তিনি বলেন, ‘ইংরেজি, ফিজিকস, কেমিস্ট্রির কোনো শিক্ষক নেই। এ বিষয়গুলো পড়ানোর জন্য আলাদা শিক্ষকের প্রয়োজন।’

জানা গেছে, ইনস্টিটিউটগুলোর শিক্ষক সংকট সমাধান না করেই নতুন করে নির্মাণ হচ্ছে আরো ইনস্টিটিউট। স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে ‘চতুর্থ স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা সেক্টর কর্মসূচি’র আওতায় প্রায় ৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা ব্যয়ে খুলনা, সুনামগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, কিশোরগঞ্জ ও কুষ্টিয়ায় পাঁচটি হেলথ টেকনোলজি ইনস্টিটিউট নির্মাণের কাজ চলমান। নতুন করে চাঁদপুরে নির্মাণ হচ্ছে আরো একটি ইনস্টিটিউট। 

স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন এলাকায় এসব ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা হচ্ছে। নতুন যেসব আইএইচটি তৈরি হচ্ছে সেগুলোয় যদি আগে থেকে পদ সৃজন করা, লজিস্টিকস সুবিধা, বিল্ডিং তৈরি, টিওএনই অনুমোদন সব একসঙ্গে এগোয় তাহলে এ সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো শুধু বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। কোনো পদ সৃজন হচ্ছে না, কোনো লজিস্টিক সাপোর্ট নেই। ডিপিপির মাধ্যমে যদি এসব প্রতিষ্ঠান গড়া হয় তাহলেই এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।’

জনবলের অভাবে ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম শুরু না হওয়া সুখকর নয় বলে মনে করেন স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) মো. আনোয়ার হোসেনও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌আমাদের কাজ অনুমোদিত জায়গায় প্ল্যান অনুযায়ী ভবন তৈরি করে দেয়া। আমরা এগুলো ফাংশনাল করতে পারি না। মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্টেকহোল্ডারদের চাহিদা, ফিল্ড লেভেলের চাহিদা ও তাদের অ্যাসেসমেন্টের ওপর আমরা কাজ করি। আমরা শুধু অবকাঠামো বাস্তবায়ন করি।’ 

বর্তমানে প্রতি শিক্ষাবর্ষে ২৩টি হেলথ টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান ৩ হাজার ৬১৯ শিক্ষার্থী। ‌শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২২-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিগত পাঁচ বছরে সরকারি হেলথ টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের মোট আসনের বিপরীতে গড়ে ৩৫ শতাংশের বেশি আসন ফাঁকা ছিল। এর মধ্যে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে মোট আসন ছিল ৩ হাজার ৬২৮টি। কিন্তু ১ হাজার ৬৫ আসন অর্থাৎ ৩০ শতাংশই ফাঁকা ছিল। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে আসন ফাঁকা ছিল ৪০ শতাংশ, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ৪৫, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ৩৩ ও ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে আসন ফাঁকা ছিল প্রায় ২৮ শতাংশ। 

স্বাস্থ্যশিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, শিক্ষক সংকট নিয়ে যে ইনস্টিটিউটগুলো চলছে সেগুলো থেকে যারা বের হচ্ছেন তারা অসম্পূর্ণ শিক্ষা নিয়ে বের হচ্ছেন। যেহেতু এটি মেডিকেল সম্পর্কিত এবং মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত, সুতরাং অদক্ষ, অর্ধদক্ষ কাউকে যদি কাজে লাগানো হয় তাহলে তাদের কাছে মানুষ নিরাপদ নয়। 

স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, যখন যারা দায়িত্বে এসেছেন তারা রাজনৈতিক বিবেচনায় আইএইচটি চালু করেছেন। জিওগ্রাফিক হোমোজেনিটি রক্ষা করা হয়নি। কোনো জেলায় একটি প্রতিষ্ঠানও নেই আবার কোথাও একাধিক। স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বর্তমান সচিব মো. আজিজুর রহমানের বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলায়। বর্তমানে ওই জেলায় রয়েছে দুটি আইএইচটি ও একটি মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস), নির্মাণাধীন রয়েছে আরো একটি। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের এলাকা সিরাজগঞ্জে রয়েছে একটি আইএইচটি ও দুটি ম্যাটস এবং বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নির্বাচনী এলাকা মানিকগঞ্জে রয়েছে একটি ম্যাটস ও আইএইচটি। 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মেডিকেল টেকনোলজিস্ট প্রয়োজন আছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয়া হয়। কোনো যৌক্তিক বিবেচনা ছাড়াই এসব নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষক ও জনবল নিয়োগ হচ্ছে না।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘বিষয়টি খুবই পরিষ্কার, যেসব ইনস্টিটিউট রয়েছে সেগুলো ফাংশনাল না করে, শিক্ষক সংকট দূর না করে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরির যৌক্তিকতা নেই। বর্তমানে যেগুলো চালু আছে সেগুলো ফাংশনাল করে রাষ্ট্রের যদি প্রয়োজন হয় তখনই নতুন ইনস্টিটিউট করা যেতে পারে।’

আরও